‘ভিডিওটা প্রধানমন্ত্রী দেখবে, তারপর তুমি আপলোড করবা...’

বিনোদন ডেস্ক
বিনোদন ডেস্ক বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:০০ পিএম, ১৭ আগস্ট ২০২৪
তাসরিফ খান। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে

সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে একটি ভিডিও তৈরি করতে চাপ দেওয়া হয়েছিল গায়ক তাসরিফ খানকে। বলা হয়েছিল, এ জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়া হবে তাকে। কাজটিকে ‘না’ করলে হুমকিও দেওয়া হয়েছিল এই তরুণ শিল্পীকে। সম্প্রতি সরকার পতনের পর সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন তাসরিফ খান।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে গত ৫ জুলাই থেকে সক্রিয় হন তাসরিফ খান। ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্ট ও কবিতা লিখতে শুরু করেন তিনি। তার গাওয়া ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ গানটা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ায় সরকারি বাহিনীর হুমকিতে বাসার বাইরে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল তাকে। তখনকার বর্ণনা দিয়ে তাসরিফ লিখেছেন, ‘২৩ জুলাই রাত ১টায় একজন সিনিয়র ইনফ্লুয়েন্সার কল দিয়ে বললো, “তাসরিফ, তোর বাসার নিচে নাম, চা খাইতে আসতেছি, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে।” আমি বাসার সামনে যাই তার সাথে দেখা করতে। গাড়ি থেকে ৬-৭ জনের মতো নেমে আসে। ইনফ্লুয়েন্সার সাহেব আমাকে একটু সাইডে নিয়ে আস্তে করে বুঝিয়ে বলে, “সাথে যারা আছে, তারা একটা এজেন্সির লোক এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কয়েকজনও আছে।” আমি তার কাছে জানতে চাই তারা কেন এসেছেন, কী চাচ্ছেন? তিনি বলেন, “সরকারি একটা কাজ আছে। এই সরকার আরও ৭-৮ বছর ক্ষমতায় থাকবো। আমরা ঠিক মতো বাঁচতে চাইলে সরকারের পক্ষে কাজ করতে হইবো, এর বাইরে কোন রাস্তা নাই।” এই কথা বলে উনি আমাকে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। সেই ৬-৭ জনের মধ্য থেকে একজন আমাকে বলে, “তাসরিফ, তোমাকে আমরা চিনি। আমরা তোমাকে একটা স্ক্রিপ্ট দিতেছি, ছোট্ট একটা ভিডিও করতে হবে। এই ভিডিওটা আমাদের কালকের মধ্যে লাগবে। পরশু সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এই ভিডিওটা দেখবে এবং তারপর তুমি আপলোড করবা।”

গত ১৫ আগস্ট তাসরিফ খান তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে ‘কিছু নির্মম ইতিহাস টাইমলাইনে থাকুক’ শিরোনামে ঘটনার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে ওই ইনফ্লুয়েন্সারের নাম উল্লেখ না করে তাসরিফ লিখেছেন, ‘সেই ইনফ্লুয়েন্সার তাদের সাথে সুর মিলিয়ে আমাকে বলে, “দেখ তাসরিফ, পিএম-এর চোখে পড়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। ভিডিওটা ভালো করে কর, সরকার যতদিন আছে, সুবিধা পাবি।” কথা শেষ করার আগেই উনি পকেট থেকে এক লাখ টাকার তিনটা বান্ডেল, মোট তিন লাখ টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, “এইটা ছোট একটা গিফট! টাকা যত চাস, তত দেয়া হবে, ভিডিওটা সুন্দর কইরা কর।”

‘ভিডিওটা প্রধানমন্ত্রী দেখবে, তারপর তুমি আপলোড করবা...’

ভয় দেখিয়ে ভিডিও বানাতে বাধ্য করতে তাসরিফের ব্যন্ড সদস্যকে পেটানো হয়েছিল। ওই পোস্টে তাসরিফ লিখেছেন, ‘ঠিক ওই সময়ে আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তর নম্বর থেকে আমার ফোনে একটা কল আসে। ফোন রিসিভ করতেই শান্ত আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “তাসরিফ! পাঁচ-ছয় জন পুলিশ এবং সিভিল ড্রেসের কয়েকজন মিলায়ে আমাকে রোল দিয়া সারা শরীরে মারছে!” শান্তর কথা শুনে আমার হাত-পা এক রকম কাঁপতে থাকে। আমি বোঝার চেষ্টা করি, এই মাইর কি আমাকে এদিকে রাজি করানোর জন্য ভয় দেখাতে? শান্তর লাইন কেটে যায়। আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিচয় দেওয়া লোকেদের বলি, “ভাই, এইমাত্র কয়েকজন মিলে আমার ভাই, আমার ব্যান্ডের ড্রামার শান্তকে প্রচুর মারছে!” ওরা জাস্ট আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “আরেহ! দেশের যে অবস্থা, এখন কিছু করা যাবে না। ওরে বলো বাসায় চলে যাইতে।”

তাসরিফ লিখেছেন, ‘আমার তখন মাথায় আসে, এখন যদি আমি ওদের টাকা ফিরিয়ে দিই বা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাই, তবে তারা আমাকে চাইলেই গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে ভিডিও করিয়ে জোরপূর্বক আপলোড করাতে পারে। তাই মাথা ঠান্ডা করে ওদের বলি, ঠিক আছে, আমি দেখতেছি কী করতে পারি, কালকের মধ্যে জানাচ্ছি। ওরা আমাকে তখন এক রকম থ্রেট দিয়ে বলে, “ভাই জানাচ্ছির সুযোগ নাই! সিচুয়েশন তো বুঝেনই। ভিডিও কালকেই লাগবে।” ওই ইনফ্লুয়েন্সারও আমাকে বলে, “তাসরিফ, ভিডিওটা তো পিএম দেখবে, সো বুইঝা-শুইনা সুন্দর কইরা করিস।”

বন্ধু শান্তর মার খাওয়ার ঘটনাটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি তাসরিফ। তিনি লিখেছেন, ‘ঘটনার ঘণ্টাখানেক আগে শান্ত আমাকে ফোন করে বলেছিল, “খান, বাসায় আম্মা নাই। এদিকে কারফিউ চলছে, দুপুর বেলা খাওয়া হয়নাই, একটা দোকানও খোলা নাই। আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লাগছে, কী করব?” আমি শান্তকে বলছিলাম, “এক বড় ভাই ফোন দিছে, আমার বাসার সামনে যাওয়া লাগতেছে। তুমি আমার বাসায় চইলা আসো, দুই ভাই একসাথে খাবো।” ছেলেটা চাইছিল আমার বাসায় এসে ভাত খাইতে, অথচ তাকে রাস্তায় বেধড়ক মার খাইতে হইল। মার খাওয়ার পরে ফোনকলে সে আমাকে এটাও বলছিল যে, “খান! সবাই আমারে একসাথে রোল দিয়ে মারতেছিল আর একজন বন্দুক তাক করে চিল্লায়ে বলছিলো, চুপচাপ মাইর খা অমুকের পোলা, নাইলে গুলি কইরা মাইরা ফালামু, লাশ খুঁজে পাইবো না তোর পরিবার!” শান্ত এই কথাটা বলতে বলতে কাঁদতেছিল যে, “আমাকে ছাত্র বইলা ওরা মারছে আর বারবার বলতেছিল যে এই অমুকের পোলা ছাত্র! ওরে মার!”

তারপর কী করেছিলেন তাসরিফ? তার লেখা বর্ণনা থেকে জানা যায়, একদিকে ডায়াবেটিসের রোগী মা, ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবা আর তার নিজের গুম হয়ে যাওয়ার চিন্তা! অন্যদিকে দেশের সঙ্গে বেইমানি করতে বাধ্য করার প্রস্তুতি পাশাপাশি কানে বাজতে থাকা বন্ধুর আর্তনাদ ভরা কান্না! কী করার ছিল এই তরুণ শিল্পীর?

ভিডিও করতে রাজি না হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন তাসরিফ খান। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘ওই রাতে আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাই। কয়েকটা পোস্ট, কবিতা, “রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম”-এর মতো কিছু গান ছাড়া দেশের জন্য তেমন কিছুই করতে পারিনি। আমি জানি, আমি আবু সাঈদের মতো পথে গিয়ে বুক পেতে দিতে পারিনি। হয়তো এত সাহস আমার তখন হয়নি। তবে আল্লাহ জানেন আর আমি জানি, আমি টাকার কাছে বিক্রি হইনি আর দেশের সাথে বেইমানি করিনি।’

‘ভিডিওটা প্রধানমন্ত্রী দেখবে, তারপর তুমি আপলোড করবা...’

তাসরিফের গাওয়া ‘রাজার রাজ্যে সবাই গোলাম’ গানটি তরুণ প্রজন্মকে ভীষণ আলোড়িত করেছিল। শিল্পীরা যখন মুখ বুজে সব অন্যায় দেখে যাওয়ায় অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলেন, সেসময় গানটি করেছিলেন এই তরুণ। ফেসবুক, ইউটিউবের মতো প্লাটফর্মে ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন এই শিল্পী।

আরএমডি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।