বেশি কিছু চাননি জুয়েল

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , উপ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০৯:২৬ এএম, ৩১ জুলাই ২০২৪
হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল (১৯৬৮-২০২৪)। ছবি: সংগৃহীত

যতটা ভালোবাসা প্রাপ্য ছিল, ততটা পাননি জুয়েল। যতটা মনোযোগ, সমাদর, সম্মান তিনি পেয়েছেন, তারচেয়ে সামান্য বেশি তাকে দেওয়াই যেত। সামান্য, বেশি কিছু নয়। বেশি কিছু চাননি শিল্পী জুয়েল। আমরাও দিতে পারিনি। কারণ স্পষ্ট।

বিনোদন অঙ্গণ একটা অস্থির মঞ্চ। সবচেয়ে বেশি আলো ও শব্দ নিয়ে যিনি সামনে থাকবেন, মানুষগুলো তার দিকেই মুখ ঘুরিয়ে রাখে। আগে কে কে আলো ছড়িয়ে গেছে, কে কে মন রাঙিয়ে গেছে, তাদের কথা খুব কমই মনে রেখেছে মানুষ। জুয়েলকেও তাই ভুলে গিয়েছিল অনেকে। অথচ তার গানগুলো একসময় বাজতে শোনা যেত ব্যান্ডক্লান্ত শ্রোতাদের কারো কারো বাড়িতে।

হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল একটি বিশেষ কারণে একই সঙ্গে সৌভাগ্যবান এবং দুর্ভাগা। কারণটি হচ্ছে, গানের ভুবনে তাকে হাত ধরে টেনে এনেছিলেন বাংলা সংগীতাঙ্গনের এক জাদুকর – আইয়ুব বাচ্চু। শুরু থেকে জুয়েলকে, জুয়েলের কণ্ঠ, গানের কবিতাগুলোকে আলাদা করা যেত। কবিতার সঙ্গে সুরের, তার স্বরের ও সুরযন্ত্রের যে বন্ধুতা, সেটার পেছনের কারিগর ছিলেন বাচ্চু।

ধরা যাক ‘এ কোন ব্যাথায় বুক ভেঙে যায় / কখনও বোঝোনি তুমি / এক নীড় ভাঙা পাখি একাকী কাঁদে / কখনও শোনোনি তুমি / কতটা ব্যাথা পেয়ে কেঁদেছি এই আমি কী করে তোমাকে বোঝাই …’ গানটির কথা। সৈয়দ আওলাদের লেখা গীতিকবিতায় সুর দিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সংগীতা থেকে বের হওয়া ‘বেশি কিছু নয়’ অ্যালবামের এই গানটি যারা শুনেছেন, তারা হয়তো একমত হবেন যে, সত্যিকারের বুক ভাঙা এক প্রেমিকের স্বর শুনেছেন তারা। কৃতিত্ব আইয়ুব বাচ্চুর।

বেশি কিছু চাননি জুয়েল

জুয়েল ও আইয়ুব বাচ্চু। ছবি: সংগৃহীত

শুধু সুর নয়, আইয়ুব বাচ্চু জুয়েলের জন্য লিখেছিলেনও। ‘কোথায় রাখো আমাকে’ শিরোনামে অসম্ভব হৃদয়স্পর্শী গানটি জুয়েলের জন্যই বেঁধেছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। লেখা, সুর, সংগীতায়োজন সবই তার! ‘কোথায় রাখো আমাকে তুমি বলো না / দৃষ্টি না হৃদয়ে আমি জানি না / কোথায় আছি আমি তা জানি না / তোমার সুখে না দুঃখে তুমি বলো না’ গানটি প্রথমবার যিনি শুনেছেন, যে অনুভূতিতে অবগাহন করেছেন, বহুকাল পর শুনলে সেই পুরোনো অনুভূতি আবারও ভেসে উঠবে হৃদয়ে। এখানেই জুয়েলের যুগপৎ সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য হাত ধরাধরি করে হাঁটে।

আইয়ুব বাচ্চু দুর্দান্ত সফল একজন গিটারিস্ট, কণ্ঠশিল্পী, ব্যান্ডতারকা, সুরকার ও গীতিকার। যে ঘরানার সুরে তিনি নিজে গাইতেন, সেটা ছিল রক। অন্যদিকে জুয়েলের জন্য তিনি বাঁধতেন বিপরীতধর্মী নিস্তেজ প্রশান্ত সুর। এমন উচ্চমানের সুর তার গানকে তুলে ধরতো উচ্চাঙ্গের পর্যায়ে। অমন উঁচু মানে পৌঁছলে পরে আর নিচে নামা শক্ত। জুয়েল নামতে পারেননি। বরিশাল থেকে ঢাকায় এসেই তিনি পরেছিলেন জাদুকরের তালুতে। তাকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি, ফিরতে চাননি তিনি। দুকদম নিচে নামাকে রুচিসম্মত মনে করেননি। তাই জুয়েল জায়গায় থেমে যাওয়াকেই যথাযথ মনে করেছিলেন। পরে জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘আমি কখনই ফুলটাইম মিউজিশিয়ান ছিলাম না। আমার একটা ভিন্ন ক্যারিয়ার ছিল। গানকে আমি রুটি-রুজি করতে চাইনি। কারণ যখনই কোনো প্রতিষ্ঠান বুঝবে যে, গান গেয়ে আপনার বাচ্চার দুধ কিনতে হবে, তখনই সে আপনাকে কোথাও কিনবে কোথাও বেচবে। আমি তাদের কাছে বিক্রি হতে চাইনি। আমি বুঝেছি যে, তাদের হাতে নিজেকে সঁপে দিলে তারা আমার গানকে নিয়ন্ত্রণ করবে। দেখা যাবে, যেসব গান আমাকে মানায় না, তেমন গানও গাইতে হচ্ছে।’

অন্যদিকে জুয়েলকে আবিস্কার ছিল আইয়ুব বাচ্চুর আরেক প্রতিভার উন্মোচন। রীতিমতো খনি থেকে হীরা তুলে সেটা ধুয়ে ধার কেটে যথাস্থানে অধিষ্ঠানের মতো কাজ করেছিলেন তিনি। সে প্রসঙ্গে জুয়েল একবার বলেছিলেন, ‘আমাকে আবিষ্কার করেছিলেন বাচ্চু ভাই। বলেছিলেন, “গাও।” তিনি বাজিয়েছেন, আমি গেয়েছি। আমার কণ্ঠ শুনে তিনি ঠিক করে দিয়েছিলেন, আমাকে ‘রোমান্টিক-স্যাড ব্যালাড’ ঘরানার গান গাইতে হবে। প্রথম অ্যালবাম “কুয়াশা প্রহর” করেছিলেন তিনি। এরপর যা হওয়ার তাই হলো। একবার কমেডিয়ান চরিত্রে ভালো করলে সারা জীবন তাকে কমেডিয়ান হিসেবেই কাজ করতে হয়। আমার ক্ষেত্রে সবাই ধরেই নিলেন যে, জুয়েলের জন্য এ রকম সুরের গানই করতে হবে। আমিও তেমন “ছ্যাঁকা খাওয়া” ছেলেদের শিল্পী হয়ে রইলাম।’

বেশি কিছু চাননি জুয়েল

আইয়ুব বাচ্চুর সুরে জুয়েলের ‘বেশি কিছু নয়’ অ্যালবামের প্রচ্ছদ

তবে ক্যারিয়ার নিয়ে জুয়েলের এক সৎ স্বীকারোক্তি ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা শিল্পী-সুরকার-গীতিকার-কম্পোজার, যারা এই শিল্প নিয়ে কাজ করি, সবাই একসঙ্গে ব্যর্থ হয়েছি। মন দিয়ে চেষ্টা করলে আমিও হয়তো কিছু একটা করতে পারতাম। কিন্তু ছোটবেলা থেকে অনেক কাজের কাজী হয়েছিলাম বলে, কিছুই ঠিকমতো করা হয়নি। কবিতা লিখেছি, নাটক করেছি, ছবি তুলেছি, পরিচালনা, প্রযোজনা কিছুই বাদ দিইনি। এখন মনে হয়, আসলে এত কিছু না জানলেও হতো।’

সামান্য হোক, গানের অঙ্গনে জুয়েল যা করেছেন, সেও কম নয়। রকস্টার আইয়ুব বাচ্চুর ভেতরে হয়তো ঠান্ডা গান করতে না পারার আকুতি ছিল। জুয়েলকে দিয়ে তিনি সেটা পূরণ করেছন। জুয়েলও তারুণ্যের যত বিরহের অনুভূতি কণ্ঠে ধরে পৌঁছে দিয়েছেন হৃদয় থেকে হৃদয়ে।

আরএমডি/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।