লোকগানের বিস্ময়কর শ্রষ্টা শাহ আব্দুল করিম
এ দেশের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতির প্রেমে পড়ে কেউ হয়েছেন, শিল্পী, কবি, আধ্যাত্মবাদী কিংবা দার্শনিক। আবার কেউবা হয়েছেন একতারা হাতের বাউল।
অপরূপ বাংলার মোহে বাউল হয়েছেন শাহ আবদুল করিম। বাউল গান লিখে এবং গেয়ে তিনি ‘বাউলসম্রাট’ আখ্যা পেয়েছেন। দেশে-বিদেশে তিনি খ্যাতি লাভ করেছেন। আজকের এই দিনে শাহ আব্দুল করিম পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অনন্তের পথে পাড়ি জমান।
আরও পড়ুন: আজ শাহ আব্দুল করিমের ১০২তম জন্মদিন
বাউল সম্রাট খ্যাত কিংবদন্তি এই শিল্পী প্রকৃত অর্থে কোনো প্রাথিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তিনি প্রকৃতির কাছ থেকে পাঠ নিয়ে বাউল গান চর্চা করতেন।
জানা গেছে, মাত্র আট দিন ব্রিটিশদের পরিচালিত নৈশ বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন তিনি। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে গুজব রটানো হয়, বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। সেই আশঙ্কায় সব ছাত্রের সঙ্গে তিনিও বিদ্যালয় ত্যাগ করেন।
তবে থেমে থাকেননি শাহ আব্দুল করিম। কিন্তু নিজের চেষ্টা আর সাধনায় কাজ চালানোর মতো পড়াশোনা ঠিকই শিখেছিলেন তিনি। সেই পড়াশোনা আর জীবনের বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে রচনা করে ফেলেন প্রায় দেড় হাজার গান।
শাহ আব্দুল করিমের এসব গানের অধিকাংশই মানুষের মুখে মুখে। তার অনেক গান রয়েছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও তার গান তুমুল জনপ্রিয়। বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম পুরোজীবন দেশের মানুষকে গান দিয়ে আনন্দ দিয়েছেন। বিভিন্ন গণ-আন্দোলনে অধিকার আদায়েও তিনি কণ্ঠে তুলে নিয়েছে গান।
শাহ আব্দুল করিম বাউল গানে অসামান্য অবদান রাখার জন্য ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়াও তিনি কথাসাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরী পদক, রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার, লেবাক অ্যাওয়ার্ড, সিটিসেল-চ্যানেল আই আজীবন সম্মাননা মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস, বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননাসহ অসংখ্য ম্মাননা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহ আবদুল করিম সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইব্রাহিম আলী ও মা নাইওরজান। দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে তিনি বড় হয়েছেন। দারিদ্র্য ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া শাহ আবদুল করিমের সংগীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই।
শাহ আব্দুল করিম ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ, প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি সব অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।
শাহ আবদুল করিম দেড় হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন।
তার সৃষ্টি জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে, ‘বন্দে মায়া লাগাইছে’, ‘পিরিতি শিখাইছে’, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’, ‘গাড়ি চলে না’, ‘রঙ এর দুনিয়া তরে চায় না’, ‘তুমি রাখ কিবা মার’, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ুরপংখী নাও’, ‘তোমার কি দয়া লাগে না’, ‘আমি মিনতি করিরে তোমারও পিরিতে বন্ধু’, ‘সাহস বিনা হয় না কভু প্রেম’, ‘মোদের কি হবেরে’, ‘মানুষ হয়ে তালাশ করলে’, ‘আমি বাংলা মায়ের ছেলে’, ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী’, ‘কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া’, ‘কোন মেস্তরি নাও বানাইছে’, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু’সহ অনেক গান।
বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম বাংলা গানের ভুবনে কিংবদন্তি তারকা। এদেশের মাটির, বায়ু, পানির ও সবুজ প্রকৃতির মমতা ফুটে উঠতো তার গানে। তিনি আমাদের মাঝে না থাকলে তার গান থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্মের মাঝে।
এমএমএফ/এএসএম