নায়ক ফারুকের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন যে নায়িকারা

বিনোদন ডেস্ক
বিনোদন ডেস্ক বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৪৮ পিএম, ১৫ মে ২০২৩

ঢাকাই সিনেমাকে তুমুল জনপ্রিয় করতে যেকজন নায়ক অসামান্য অবদান রেখেছেন চিত্রনায়ক ফারুক তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তার অভিনয়ের রোশনাই ঢাকাই সিনেমাকে উদ্ভাসিত করেছে। সমৃদ্ধ করেছে বহুগুণে।

অভিনয় করতে করতে তিনি সবার কাছে ‘মিয়া ভাই’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। অভিনয় নৈপুণ্যতা এবং দর্শকপ্রিয়তার কারণে এক সময় সিনেমার নাম ভূমিকায় ফারুকের নামের আগে দেখা যেত ‘সুপারস্টার’ তকমাটি। নায়ক ফারুক শুধু রূপালি পর্দায় নয়, সাধারণ দর্শকের কাছেও সুপারস্টার হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছেন। তিনি যেন হয়ে উঠেছিলেন রূপকথার এ মহানায়ক।

স্বাধীনতার আগে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় পূর্ব পাকিস্তানের দুরন্ত কিশোর ফারুকের যে অদম্য যাত্রা শুরু হয়েছিল রাজনীতির অঙ্গনে। সিনেমায় এসেও যেন সেই ফারুক সাফল্যের জয়রথে ছুটে চলেন বাধাহীন।

নায়ক ফারুক একের পর এক ব্যবসা সফল সিনেমা দিয়ে মাতিয়ে রাখেন পুরো দেশ। তার অভিনীত ‘সুজন সখী’, ‘নয়ন মণি’, ‘সারেং বউ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’সহ তার অনেক সিনেমা কালজয়ী হয়েছে। এখনো চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের আলোচনায় নায়ক ফারুক ও তার চলচ্চিত্রের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়।

আরও পড়ুন: নায়ক ফারুক আর নেই

নায়ক ফারুকের সঙ্গে জুটি বেঁধে অনেক নায়িকা জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যান। সে সময়ের নায়িকারা তার সঙ্গে অভিনয় করার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। তার সঙ্গে রোমান্স করেছেন পর্দায়, হাসিয়েছেন-কাঁদিয়েছেন দর্শককে অনেক নায়িকা।

বিভিন্ন সময় নায়ক ফারুক তার নায়িকাদের স্মৃতিচারণ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন-

কবরী

দেশ তখন স্বাধীনতা লাভের আনন্দে ভাসছে। নতুন করে তৈরি হচ্ছে নতুন বাংলাদেশের পরিকল্পনা। এমনি সময়ে চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হন চিত্রনায়ক ফারুক ‘জলছবি’ নামের সিনেমায়। এইচ আকবর পরিচালিত এ সিনেমা তার নায়িকা ছিলেন কবরী। জানা যায়, এটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৭২ সালে। প্রথম ছবির গল্প জানাতে গিয়ে নায়ক ফারুক কবরীর স্মৃতিচারণ করে বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘কবরী তখন সুপারস্টার। তার মতো নায়িকার সঙ্গে জুটি বেঁধে সিনেমা শুরু করতে পারাটা আমার জন্য আনন্দের। তবে ব্যাপারটি অতোটা সহজ ছিলো না। আমি খানিকটা ডানপিটে ছিলাম। আমি মারামারি করি এমনটাও প্রচার ছিলো। যখন ‘জলছবি’ সিনেমার প্রযোজক আমাকে তার ছবির নায়ক করলেন কবরী কারও মাধ্যমে জানতে পারলেন যে আমি গুন্ডা কিসিমের। সে শুনেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। আমার সঙ্গে ছবি করবে না বলে আপত্তি তুলেছিলো। তবে পরে তাকে বোঝানো হলে তিনি রাজি হন। অভিনয় করতে এসে আমার সম্পর্কে তার ভুল ধারণাটি ভেঙে গিয়েছিলো।’

সেই শুরু। এরপর ফারুক-কবরীকে দেখা গেছে বেশ কিছু জনপ্রিয় সিনেমাতে। ‘সারেং বউ’, ‘দিন যায় কথা থাকে’, ‘আরশিনগর’, ‘তৃষ্ণা’, ‘সুজন সখী’ ইত্যাদি। এরমধ্যে আব্দুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বউ’ সিনেমাটি ফারুক-কবরী জুটিকে দিয়েছে অনন্য মর্যাদা। আর খান আতার চিত্রনাট্যে প্রমোদ করের ‘সুজন সখী’ সিনেমাটি এ জুটিকে সেরা পাঁচটি রোমান্টিক জুটি হিসেবে ঢালিউডের ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছে। এই সিনেমাটি পরে রিমেক করা হয়। সেখানে জুটি বেঁধে সফল হয়েছিলেন সালমান শাহ ও শাবনূর।

আরও পড়ুন: মিয়া ভাইয়ের বর্ণাঢ্য জীবন

ববিতা

চিত্রনায়ক ফারুক জুটি প্রথায় বিশ্বাসী নন বলে দাবি করেন। তার মতে, বহু নায়িকার সঙ্গেই তিনি জুটি বেঁধে সফল হয়েছেন। জুটি প্রথা বলতে যা বোঝায় তেমনটি তিনি অনুসরণ করেননি। তবে ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি সিনেমা তিনি করেছেন ববিতার সঙ্গে। তাই নিজের সফল বা প্রিয় নায়িকা হিসেবে ববিতাকেই এগিয়ে রাখেন তিনি। তাছাড়া ঢালিউডে জনপ্রিয় ও সফল দশটি জুটির একটি বলে মনে করা হয় ফারুক-ববিতা জুটিকে। ১৯৭৩ সালে ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমা দিয়ে প্রথমবারের মতো জুটি হন তারা। এরপর ‘আলোর মিছিল’, ‘কথা দিলাম’, ‘প্রিয় বান্ধবী’, ‘লাঠিয়াল’, ‘সুর্যগ্রহণ’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমনি’, ‘মিয়া ভাই’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদিসহ ৩৩টি ছবিতে অভিনয় করেন তারা। তারমধ্যে কালজয়ী হয়ে আছে ‘আলোর মিছিল’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবিগুলো। আর ‘নয়নমনি’ সিনেমার মিষ্টি রসায়নে ফারুক-ববিতা আজও দর্শকের মনে নিটোল প্রেমের প্রতীক হয়ে আছেন।

ফারুক-ববিতা সর্বশেষ জুটিকে দেখা গিয়েছিল ২০০৮ সালে, ‘ঘরের লক্ষী’ নামের সিনেমায়। দুজনের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কটাও খুব জমজমাট এই দুই তারকার। নানা উপলক্ষেই একজন আরেকজনের বাসায় নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন, আড্ডায় মেতে ওঠেন। চোখ ভেজান সোনালি অতীতের রোমান্স-রোমাঞ্চকর দিনগুলোর স্মৃতিচারণে।

অঞ্জনা

মিয়া ভাই খ্যাত নায়ক ফারুকের সঙ্গে চিত্রনায়িকা অঞ্জনা জুটি বেঁধে অভিনয় করে অনেক সুপার হিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন। এদেশের সিনেমাপ্রেমীদের কাছে তারা জুটি হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। ফারুক-অঞ্জনা অভিনীত উল্লেখ্যযোগ্য সুপারহিট সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘মাটির মায়া’, ‘প্রিয় বান্ধবী’,  ‘ছোট মা’, ‘চোখের মনি’, ‘সখি তুমি কার’, ‘মাসুম’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’,  ‘সুখের সংসার’,  ‘মেহমান’, ‘ভাগ্যলক্ষ্মী’,  ‘রক্তের বাধন’, ‘অন্ধবধু’ ও ‘ফুলেশ্বরী’। এই জুটির অনেক সিনেমার গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এখনো অনেকেই তাদের গান গুনগুনিয়ে গেয়ে থাকেন। নতুন প্রজন্মের অনেক শিল্পীরা এই জুটির সিনেমার গান কভার করছেন।

আরও পড়ুন: নায়ক ফারুকের প্রথম জানাজা সিঙ্গাপুরে

প্রয়াত চিত্রনায়ক ফারুককে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে চিত্রনায়িকা অঞ্জনা তার ফেসবুকে লেখেন, আমার তৃতীয় মাইলস্টোন চলচ্চিত্র ‘মাটির মায়া’ ছায়াছবিতে প্রথম ফারুক ভাইয়ের সাথে আমার অভিনয় এরপর অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কতো মধুময় স্মৃতি যা ভেবে চোখ বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে যাচ্ছে। কান্নায় বুক ভার হয়ে যাচ্ছে। ফারুক ভাই জীবত থাকাকালে সব সময় বলতেন এতো চলচ্চিত্রে জীবনে অভিনয় করেছি কিন্তু ‘ফুলেশ্বরী’ আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র। যার গান সব সময় আমি গুনগুন করি গাই-‘নদীরে কতো রঙ্গ দেখালি আমায়’। এ কথাগুলো কখনোই ভুলে যাবার নয়। ফারুক ভাই আপনি বেঁচে থাকবেন আপনার অনবদ্য শ্রেষ্ঠ কর্মের মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশে। কোটি দর্শকের হৃদয়ে অনন্তকাল।

রোজিনা

ফারুক সফল হয়েছেন রোজিনার সঙ্গেও। বেশ কিছু চলচ্চিত্রেই এই জুটির সাফল্য ছিলো ঈর্ষণীয়। তার মধ্যে ‘সাহেব’, ‘সিকান্দার’, ‘শেষ পরিচয়’, ‘যন্তর মন্তর’, ‘অন্ধ বধু’, ‘বন্ধু আমার’, ‘দুঃখীনী মা’, ‘হাসু আমার হাসু’, ‘মান অভিমান’, ‘ভুল বিচার’, ‘সুখের সংসার’, ‘দাঙ্গা ফ্যাসাদ’ ইত্যাদি ছবিগুলো উল্লেখযোগ্য। নায়ক ফারুক মনে করেন, তার ক্যারিয়ারে গতানুগতিক জুটি বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু সত্যি হয়ে থাকলে সেটি ছিলো রোজিনার সঙ্গে। খুব সহজেই দুজনে মিশে যেতে পারতেন চরিত্রের সঙ্গে। জমে উঠতো অনস্ক্রিন রসায়নও।

শাবানা

কবরী ও ববিতার সমসাময়িক আরও কজন নায়িকাদের সঙ্গে ফারুক জুটি বেঁধেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম শাবানা। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় ‘মেহমান’, ‘লাল কাজল’, ‘সখী তুমি কার’, ‘ভাই ভাই’র মতো কিছু ছবিতে তারা জুটি হয়েছেন। তবে দর্শক কোনো এক কারণে এই জুটিকে গ্রহণ করেননি। নায়ক ফারুকের বক্তব্য, ‘অনেক পরিচালকই আগ্রহ নিয়ে শাবানাকে আমার বিপরীতে কাজ করিয়েছেন। আমরা বেশ ভালো গল্প নিয়েই কাজ করেছিলাম। দুজনের অভিনয়ও ভালো ছিলো। কিন্তু শাবানার সঙ্গে কেন জানি না আমার রসায়নটা ঠিক জমতো না। দর্শকও খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। তবে শাবানার অভিনয় ও তার ব্যক্তিত্ব চমৎকার। তার সঙ্গে কাজ করে আমি আনন্দিত ছিলাম।’

সুচরিতা

চিত্রনায়িকা সুচরিতার সঙ্গেও অনেকগুলো সিনেমায় নায়ক হয়েছেন ফারুক। সেইসব সিনেমা পেয়েছে ব্যবসায়িক সাফল্য ও জনপ্রিয়তাও। উল্লেখ করা যায় ‘লাখে একটা’, ‘নাগর দোলা’, ‘কোটি টাকার কাবিন’, ‘ছক্কা পাঞ্জা’ ইত্যাদি ছবির নাম।

অঞ্জু ঘোষ

নায়ক ফারুকের ক্যারিয়ারে চিত্রনায়িকা অঞ্জু ঘোষ একটি উল্লেখযোগ্য নাম। অঞ্জু ঘোষের সঙ্গে তিনি বেশ কিছু জনপ্রিয় সিনেমা দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। ফারুক-অঞ্জু ঘোষ অভিনীত ‘শক্তিশালী’ ও ‘যাদুমহল’ নামের সিনেমা দুটি দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

সুনেত্রা

বলা হয়ে থাকে গ্রামীণ চরিত্রে নায়ক ফারুক ছিলেন অনবদ্য। গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের সিনেমার জন্য পরিচালকদের সেরা পছন্দের ছিলেন তিনি। সেই ধাঁচের কিছু সিনেমাতে সুনেত্রার বিপরীতে নায়ক হয়েছেন ফারুক। দুই তারকার মধ্যে বয়সের গ্যাপ থাকলেও জমজমাট পর্দা রসায়ন জনপ্রিয় করে তুলেছিলো ফারুক-সুনেত্রা জুটির ‘শিমুল পারুল’, ‘পালকী’ সিনেমাগুলোকে।

ফারুক তার ক্যারিয়ারের অন্যতম ব্যবসা সফল ছবি ‘ঝিনুক মালা’য় নায়িকা হিসেবে পেয়েছিলেন নিপা মোনালিসাকে। চিত্রনায়িকা জুলিয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন ‘দোস্তী’ সিনেমায়।

আজ এ খ্যাতিমান নায়ক ফারুকের অনন্ত যাত্রার মধ্যদিয়ে ঢাকাই চলচ্চিত্র হারালো তার এক সূর্য সন্তানকে। তিনি চিরবিদায় নিলেও বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন।

এমআই/এমএমএফ/জিকেএস

 

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।