গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
ড. তপন বাগচী
গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি নয়। দেখা-সাক্ষাৎ খুব বেশি হয়নি। ত্রিশ বছর ধরে তাকে দূর থেকে দেখেছি। সবাই জানেন যে, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আর মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান— দুই ভাই বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দাপুটে গীতিকার। দেশের গান ও আধুনিক গানেও তাদের সমকক্ষ ছিলেন হাতেগোনা দু-একজন।
আধুনিক গান বলতে চলচ্চিত্রের গানও বোঝায়। চলচ্চিত্রের গান একেবারেই কাহিনির প্রয়োজনে রচিত, আর কাহিনি প্রয়োজন ব্যতিরেকে যে সব গান তারা লিখেছেন সেগুলোকেই আধুনিক গান বলেছি। তবে ইদানীং কেউ কেউ ‘লোকসংগীত’ লিখছেন বলে পত্রিকায় সংবাদে পড়ি।
আরও পড়ুন: প্রখ্যাত গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান শোনালেন জীবনের জয়গান
লোকসংগীত যে আধুনিক কালের একক কোনো রচয়িতার পক্ষে লেখা সম্ভবপর নয়, তা ওই তথাকথিত গীতিকারও কি জানেন না? আসলে তারা পল্লিগীতিকেই ‘লোকসংগীত’ বা ‘লোকগীতি’ বলে চালাতে চায়। তো পল্লিগীতিও লিখেছেন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান।
আবার একেবারেই ঘোরের মধ্যে ডুবে গিয়ে তিনি লিখেছেন ভণিতাযুক্ত মরমিগান, যা ‘ঘোর’ নামে গ্রন্থিত হয়েছে। ঘোরের গানগুলো এমনই ধাঁচের যে, কোনো কোনো গানের ভণিতায় জামানের বদলে লালন কিংবা বিজয় কিংবা পাগলা কানাইয়ের নাম বসিয়ে দিলে কেউ বুঝতেই পারবেন না।
আমি যখন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের গান নিয়ে গবেষণা করতে যাই, তখন তার বাসায় এক বিকেল কাটিয়েছি। অগ্রজের সম্পর্কে তথ্য জানার জন্য অনুজের কাছে ধরনা দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তিনি আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। তবে তখন আমি গান লিখতে আসিনি। তখন গান লিখতে এলে প্রত্যক্ষ শিষ্যত্ব গ্রহণের সুযোগ পেতাম।
এরপর কবি আবিদ আনোয়ারের জয়দেবপুরের বাড়িতে একটি ঈদের দিন কাটিয়ে একসঙ্গে ঢাকা ফিরেছি। সঙ্গে প্রিয় ভাবিও ছিলেন। এছাড়া কালেভদ্রে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। কথা হয় অল্পবিস্তর। যেটুকু তাঁর সম্পর্কে জানি, তা তাঁর বই পড়ে আর আবিদ আনোয়ার এবং অনুপ ভট্টাচার্যের মুখে নানান পরিপ্রেক্ষিতে। তাঁকে আশিরনখর কবি বলেই জানি।
ছবিতে (বাম থেকে) মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, ড.তপন বাগচী, কবি আবিদ আনোয়ার
অনেক বড় গীতিকার দেখেছি এই দেশে। একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গানের কবিকেও দেখি ভুল ছন্দে গান লিখতে। কাহিনির প্রয়োজনে, সুরের প্রয়োজনে বিষয় ও শব্দের কাছে কখনো আপস করতে হতেই পারে, কিন্তু কবিতার ছন্দের কাছে কেনো আপস করতে হবে?
বাংলাগানের পঞ্চকবিকে তো এরকম ছন্দছুট চরণ লিখতে হয়নি, তবে কেনো খান আতা কিংবা সৈয়দ শামসুল হককে ছন্দ এবং অন্ত্যমিলের অশুদ্ধ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। সৈয়দ শামসুল হক তো পঞ্চাশ দশকের সেরা কবিদের একজন, কবিতার করণকৌশল তিনি জানতেন বলেই মানি। তাঁর গানের বাণীতেও শিথিলতা দেখে অবাক হতে হয়।
আবার কবিত্বের গুণে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও আবু হেনা মোস্তাফা কামালের গানের কবিতা উতরে যায়। সাহস করে বলতে পারি, অনেক খ্যাতিমান গীতিকারে নাম করতে পারি—অজস্র শুদ্ধ গান লিখলেও, এবং সুরে ও গায়কিতে তা উতরে গেলেও তাঁদের কিছু কিছু গানের বাণীর ছন্দ ও অন্ত্যমিলের দুর্বলতাকে তো অস্বীকার করা যাবে না। এই ক্ষেত্রে প্রবল ব্যতিক্রম হচ্ছেন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। তিনি গানের কবিতার শুদ্ধতা রক্ষায় সর্বদা সতর্ক থেকেছেন, লড়াকু থেকেছেন।
আনন্দের সঙ্গে উল্লেখ করা যায় মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘বাংলা গান রচনাকৌশল ও শুদ্ধতা’ গ্রুপের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের বেশ কিছু গীতিকার শুদ্ধতার শিক্ষা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন।
রফিকভাই কবিতার চেয়ে গানের কবিতাচর্চায় বেশি মন দেওয়ায় এবং সফলতা অর্জন করায় কবিতার মূল ধারায় তাঁর নাম কম উচ্চারণের দায় সাহিত্যের সমালোচকদেরই ওপর বর্তায়।
রফিকউজ্জামান ‘বাংলা গান: রচনাকৌশল ও শুদ্ধতা’ এবং ‘আধুনিক বাংলাগান রচনার কলাকৌশল’ নামে দুটি বই লিখে নতুন প্রজন্মকে শুদ্ধতার পথে অগ্রসর হতে সহায়তা করেছেন।
এ-যাবৎ ছন্দ নিয়ে যারা বই লিখেছেন, তাঁদের লক্ষ্য ছিল কবিতার ছন্দ। কিন্তু মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানকেই কেবল গানের ছন্দ আর করণকৌশল, শুদ্ধতা রক্ষা নিয়ে ভাবতে দেখি।
লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলা একাডেমি
এমএমএফ/জিকেএস