গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শোক
কিংবদন্তি গীতিকার, সুরকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তার হঠাৎ মৃত্যুতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুণী এই ব্যক্তিত্বকে নিয়ে শোক-শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন চিত্রনায়ক শাকিব খান, অনন্ত জলিল, ওমর সানী, নিরব, সংগীতশিল্পী কনকচাঁপা, বাপ্পা মজুমদার, সিঁথি সাহাসহ অনেকে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের একটি ছবি পোস্ট করে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শাকিব খান লেখেন, বাংলা গানে এক অনন্য-অসাধারণ গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার আঙ্কেল আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। পরম শ্রদ্ধেয় এই মানুষটির মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ ও বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
‘বর্ণিল কর্মময় জীবনে গাজী আঙ্কেল গানের বাইরে বিকশিত হয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাণ, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক হিসেবেও। শিল্প-সংস্কৃতির প্রায় প্রতিটি সেক্টরে তিনি রেখেছেন বিস্ময়কর সব সাফল্য।’
তিনি আরও লেখেন, মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম, বিরহ, স্নেহ; বৈচিত্র্যময় সব অনুভূতি প্রকাশে এ দেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আজীবন ভীষণ প্রিয় হয়ে থাকবে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের অমর সব সৃষ্টি।
অনন্ত জলিল লেখেন, পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত কিংবদন্তি গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও অনেক কালজয়ী গানের স্রষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার। এই র্কীতিমান মহান মানুষটির প্রয়াণে গভীর শোক ও বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
ওমর সানী লেখেন, আমার বাবা আর শ্বশুর ইন্তেকালের পর আমি একজনকে বাবা বলে ডাকতাম, শ্বশুর বলে ডাকতাম, বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় নক্ষত্র, একজন বাংলাদেশ, গাজী মাজহারুল আনোয়ার ইন্তেকাল করেছেন।
নিরব লেখেন, দেশবরেণ্য কিংবদন্তি গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার কিছুক্ষণ আগে মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মহান আল্লাহ গাজী চাচার পরিবারকে এই শোক সইবার শক্তি দিন।
কনকচাঁপা লেখেন, আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় গীতিকবি, চলচ্চিত্র পরিচালক, সাংস্কৃতিক জগতের মহীরুহ গাজী মাজহারুল আনোয়ার আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
বাপ্পা মজুমদার লেখেন, বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে কিংবদন্তি গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ারের আত্মার শান্তি কামনা করছি!
সিঁথি সাহা লেখেন, মানতে পারছি না। স্যারের সঙ্গে দুই সপ্তাহ আগে দেখা হলো, স্যার গান তুলে দিলেন আমাকে নতুন একটা। দেশবরেণ্য কিংবদন্তি গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার কিছুক্ষণ আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। স্যারের আত্মার শান্তি কামনা করি। ঈশ্বর উনার পরিবারকে এই শোক সহ্য করার শক্তি দিন।
রোববার (৪ সেপ্টেম্বর) সকাল ৭টায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান গাজী মাজহারুল আনোয়ার।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে ২১ বছর বয়সে রেডিও পাকিস্তানে গান লেখা শুরু করেন তিনি।
পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখেন ১৯৬৭ সালে। ওই চলচ্চিত্রের নাম ছিল ‘আয়না ও অবশিষ্ট’।
১৯৬৭ সালে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও গান লেখাতেও দক্ষতা দেখান তিনি। তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ মুক্তি পায় ১৯৮২ সালে। তিনি মোট ৪১টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন।
গাজী মাজহারুলের পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম- শাস্তি, চোর, শর্ত, স্বাধীন, সমর, রাগী, আর্তনাদ, জীবনের গল্প, পাষানের প্রেম, তপস্যা, ক্ষুধা, পরাধীন, এই যে দুনিয়া, হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ।
অসংখ্য কালজয়ী গানের রচয়িতা গাজী মাজহারুল আনোয়ার। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান লিখেছেন। ২০ হাজারেরও বেশি গানের রচয়িতা গাজী মাজহারুল।
‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ ও ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’ তার লেখা তুমুল জনপ্রিয় দুটি গান। বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান পেয়েছে তার লেখা তিনটি গান।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ‘পীচ ঢালা পথ’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘অবুঝ মন’, ‘চাষীর মেয়ে’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ডুমুরের ফুল’, ‘মহানগর’, ‘নতুন বউ’, ‘নাজমা’, ‘অভিযান’, ‘মা ও ছেলে’, ‘রাজলক্ষী শ্রীকান্ত’, ‘রাঙা ভাবী’, ‘ছুটির ফাঁদে’, ‘বাবার আদেশ’, ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে গান লিখেছেন।
২০০২ সালে ‘একুশে পদক’ লাভ করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ২০২১ সালে তিনি সংস্কৃতিতে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ অর্জন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য গাজী মাজহারুল স্বাধীন দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার ‘বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন।
এছাড়াও গাজী মাজহারুল আনোয়ার পাঁচবার ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’, একাধিকবার ‘বাচসাস পুরস্কার’, ‘বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন।
এমআই/আরএডি/জেআইএম