চলচ্চিত্রের বেহাল দশায় নায়করাজের ক্ষোভ
ঢাকাই চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক। সেলুলয়েডের ফিতায় তার অসংখ্য চরিত্র অমর হয়ে আছে দর্শকের হৃদয়ে। বলা যায় ঢাকাই ছবির অহংকার তিনি।
অভিনয়ের এই বরপুত্রকে গেল শুক্রবার এফডিসিতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র গ্রাহক সংস্থা চলচ্চিত্রের ৬০ বছর পুর্তি উপলক্ষে এক সংবর্ধনা প্রদান করে। সেখানে বক্তৃতাকালে নায়করাজ রাজ্জাক ঢাকাই চলচ্চিত্র শিল্পের এই ক্রান্তিকালে চলচ্চিত্র গ্রাহক সংস্থার প্রতি দেশের গুণী শিল্পী ও মানুষদের পুরস্কৃত করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। এবং ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে নানা কথা বলেন।
প্রথমেই নায়ক রাজ ক্ষোভ ঝাড়েন হালের যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণের উপর। বলেন, ‘আজকাল নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ হচ্ছে। এটা যৌথ প্রযোজনা নয়, আমি বলবো যৌথ প্রতারণা। তাছাড়া এদেশ থেকে একজন নায়িকা নিয়ে ওদেশে গিয়ে সম্পূর্ণ কলকাতার ছবির আদলে ছবি নির্মাণ করা হচ্ছে। সেগুলোকে কৌশলে এদেশের হলে চালানো হচ্ছে। এটা লীলাখেলার সামিল।’
রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের চলচ্চিত্র কি ছিল আর কোথায় যাচ্ছে? বর্তমানে আমাদের চলচ্চিত্র উঠছে আর নামছে। এই ওঠা নামাটা হচ্ছে প্রক্ষাগৃহে ছবি প্রদর্শনের জন্য উঠছে এবং দু’দিন পরই নেমে যাচ্ছে।’
অনেকটা হতাশা নিয়েই রাজ্জাক বলেন, ‘এখন আর এফডিসি কেন্দ্রিক ছবি হচ্ছেনা বলেই সবাই বাইরের দেশে গিয়ে ছবির শুটিং করছে। তাছাড়া আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেকে টেলিফিল্মকেই জোর করে চলচ্চিত্র বানিয়ে দিচ্ছেন। যেটা চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে ধোঁকা হিসেবে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে তারা ছবি দেখা ছাড়ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের হলগুলোর পর্দা ডিজিটাল করা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু হলগুলোর পরিবেশ এখনো সেই মান্ধাতার আমলের। ফলে ছবি মুক্তির পর তা প্রদর্শনের জন্য প্রোজেকশন ভাড়া নিতে হচ্ছে। যদি এভাবেই চলে তাহলে চলচ্চিত্র লাভের মুখ দেখবে কিভাবে? আমি নিজেও ছবি বানিয়ে হতাশ হয়েছি। কারণ প্রেক্ষাগৃহে ছবি চালাতে গিয়ে আলাদাভাবে ক্যামেরা এবং অন্যান্য উপকরণ ভাড়া নিতে হয়েছে।’
এ সময় নতুনদের উদ্দেশ্যে নায়করাজ বলেন, ‘এখন অনেক ভালো ছেলেমেয়ে চলচ্চিত্রে কাজ করতে আসছে। তাদের অনেকেই প্রতিভাবান। তবে এ সময়ের আবার অনেক অভিনয় শিল্পীকেই দেখা যায় সম্মানী নিয়ে বাড়াবাড়ি করে এবং শিডিউল ফাঁসায়। তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলব যে বেশি অর্থ নিয়ে ভালো ছবি দর্শকদের উপহার দেওয়া যায়না। ভালো ছবি উপহার দেওয়ার জন্য প্রয়োজন কাজের প্রতি আন্তরিকতা। সেটা তোমাদের বেশিরভাগেরই নেই। তারকাখ্যাতির অহমবোধ কাজ করলে তাকে কেউ মনে রাখে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘সিনিয়রদের প্রতি আজকাল জুনিয়রদের অনেক বাজে আচরণের কথা শুনে আহত হই। একজন সিনিয়র অভিনেতা যিনি একসময় নায়ক ছিলেন, আজ তাকে তরুণ একজন নায়কের চেয়ে অবমূল্যায়ণ করা হয়। যারা পরিচালক তারাও সম্মান দিচ্ছেন না, যারা নায়ক তারাও তাদের অগ্রজদের মূল্যায়ণ করছেন না। সালাম নেই, আদব নেই। তাদের ধারণা, আমরা ইন্ডাস্ট্রি চালাই, বুড়োদের কেন মূল্য দেব? কিন্তু তারা ভুলে যায়, বুড়োদের ঘামের স্রোতেই আজকের ইন্ডাস্ট্রি এসেছে। এইসব মানসিকতা আরো উন্নত করতে হবে। যার যেটা পাওনা তাকে সেটা দিতে হবে।’
চলচ্চিত্রের সোনালী অতীতের শক্তিমান এ অভিনেতা আরো বলেন, ‘এখন কিছু শিল্পীদের থেকে তাদের মায়ের বায়না থাকে আরো বেশি। মায়েরা প্রোডাকশনকে জানায় ‘আমার মেয়ে নাস্তায় পাঁচ তারকা হোটলের স্ন্যান্ডুইচ খাবে। আউটডোরে শুটিংয়ে গেলে বিলাসবহুল হোটেলে থাকবে।’ এসব কেন হচ্ছে?’
এক্ষেত্রে তিনি নিজের অভিজ্ঞতার কথা টেনে বলেন, ‘আমি পাচঁ টাকার সম্মানী নিয়েও চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। আর এখনতো তোমাদের ভালো খাবার, ভালো থাকার জায়গা, ভালো সম্মানির ব্যবস্থা করে দিচ্ছে পরিচালক-প্রযোজকেরা! তারপরও কেন আজেবাজে কথা শুনতে পাওয়া যায়। নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে কেন মা বা বাবা-বন্ধুকে নিয়ে মুখরোচক গল্প ছড়াবে। আমাদের সময় সমাজ ছিলো অনেক বেশি রক্ষণশীল। কই তখন তো নায়িকাদের সঙ্গে মায়েরা আসতেন না। তবে এই আধুনকি সময়ে কেন মেয়েকে পাহাড়া দিয়ে শুটিংয়ে পাঠাতে হচ্ছে? তাই আমি বলবো এজন্য শিল্পীদের পেশাদার মনোভাবের পরিচয় দিতে হবে। শুধু টাকা দিয়ে পেশাদার মনোভাব গড়ে উঠে না, সেটা কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে।’
বাংলাদেশের সুস্থ ধারার সিনেমা নির্মাণে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের অবদান উল্লেখ করে নায়করাজ বলেন, ‘ইমপ্রেস টেলিফিল্ম আমাদেরকে অনেক ভালো ভালো চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি আমাদের ছবির উদ্ধারকর্তা বলা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে যতগুলো ছবি দেশের বাইরে প্রদর্শিত হচ্ছে তার সিংহভাগ অবদান এই ইমপ্রেস টেলিফিল্মের।’
অনেকটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বর্ষীয়ান এই নায়ক বলেন, ‘আমাদের এফডিসি কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র বাড়াতে হবে। সবাইকে একযোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই ধ্বংসপ্রায় শিল্পকে বাঁচাতে হবে। সেজন্য যেকোনো ভালো কাজ এবং আন্দোলনে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সকলে যদি চায় তবে প্রয়োজনে আমি শেষ বয়সে এসে আবারো রাস্তায় এসে দাঁড়াবো।’
এনই/এলএ