ভালোবাসা তারে কয়


প্রকাশিত: ০৭:৩৮ এএম, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬

লোডশেডিং। ঘুটঘুট্টি অন্ধকার। এতোক্ষণে জেনারেটরে বিকল্প বিদ্যুৎ চলে আসার কথা। কি হলো কে জানে! কোকিলটা  দেয়াল ঘড়ি থেকে গলা বের করে কুপ কুপ গান গেয়ে জানান দেয়, রাতের এখন আট। জানান দেয় সময় পেড়িয়েছে দুঘণ্টা আগে। অপেক্ষার কষ্টগুলো জমে জমে রাগ হয়। রাগগুলো উসিলা খুঁজে। সিন্দাবাদের ডাইনি হয়ে তারপর লোডশেডিংয়ের ঘাড়ে সওয়ার হয়। উফ, মরণ!! দিনে চল্লিশবার কারেন্ট না গেলে আর শান্তি নেই। রাগে গজরায় শাপলা।

আড়াই হাজার স্কয়ার ফিটের অভিজাত এপার্টমেন্টটিতে মানুষ সবে দুটি। শাপলা আর শুভ। সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি এখানে একা থাকে শাপলা। বিয়ের বয়স দুই, চেনাজানার পাঁচ। কোনো এক কনে দেখা আলোছায়া সন্ধ্যায় দেখা হয়েছিলো দুজনাতে। কুড়িতে পা দেয়া মেয়ে সেই ক্ষণেই জেনেছিলো, আঙ্গুলের হীরায় থাকবে পঁচিশের ওই যুবকের নাম।
- আমি কি তাহার অপেক্ষাতেই ছিলাম এতো`কটা দিন! সে যখন নাম ধরে ডাকে, বেজে উঠে সেহনাই। ছলকে উঠে রক্ত শিরায় শিরায়। ঝোপে ফুটে একশো গোলাপ। ব্যাংগমা আর ব্যাংগমী বলে,           
- রোসো বাছা, তোমার অপেক্ষার দেও খ্যান্ত। তুমি এতো`কটা দিন তাহার জন্যেই বেঁচে ছিলে।    

একদিন যায় দু`দিন যায়। তৃতীয় দিনে বিছানার উপর বেজে উঠে স্যামসাং। তনুলতায় শিহরণ জাগিয়ে মনিটরে ভাসে তার নাম। তানানা তানানা ধীন তানা ধেরে না। বুকের ভেতরে হার্টবিট কয়েক বার মিস হয়। স্থানুর মত বসে থাকে বিবসা তরুণী। যেন সে কখনো কারো ফোন রিসিভ করেনি। যেন এই প্রথম বার ভাঙ্গনের আলামত হয়ে বেজে উঠলো ঈশ্রাফীলের শিঙ্গা।   
-হ্যালো। কথাটা স্পষ্ট হয় না। গলায় শ্লেষ্মা জড়িয়ে থাকে।  
-তোমার নাম শাপলা?
-হুঁ
-আমি অতবড় নামে ডাকতে পারবোনা। শোনো, আমি তোমাকে পলা বলে ডাকবো। তুমি কেমন আছো পলা?   
-খুব একটা ভালো নেই। দু`রাত ঘুমোইনি। মা বকাঝকা করছিলো ঠিক করে খাইনি বলে। সেই যে আমার নাম্বার সেভ করে নিয়েছিলে, দু`দিন আমি ফোন নিয়েই গোসলে গেছি। আমি ভালো নেই তেমন। তোমার লাগি মন পুড়ে। এসব কথা সে মনে মনে বলে। মুখে বলে,  ভালোইতো। আপনি?
-তুমি আমার সাথে দেখা করবে আমি যদি বলি।
-সেটা কি আজই, এক্ষুণি?
-আমি তোমার অপেক্ষাতেই আছি।

বলাকা সিল্কের শাড়িতে বাধ ভাংগে  নীল। কারচুপির জরিগুলোকে আকাশের বুকে হাজার তারার মেলা মনে হয়। ভেজা চুল থেকে জল গড়ায় মাটিতে। গলায় রুপোর গয়না সেই সাথে কানের দুল। নীল চুড়িগুলো আল্গুছে পড়ে। দূরে কেউ গান শুনে। কি গান ওটা? চিরকুটের গান ঠিক- তোমার প্রেমেতে আমি বুঁদ হয়ে রই।

অন্ধকারটা এখন আর যন্ত্রণা দিচ্ছে না। বিছানার উপর হাতরে হাতরে ফোনটা খুঁজে পায় শাপলা। এক নাম্বার বাটনে সেভ করা আছে শুভর নাম। এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কি হয়েছে ওর। মনের কোণে কু-পক্ষি ডাকে। নাহ, নিশ্চই ভালো আছ তুমি। নিরাপদে আছ। তুমি নিরাপদে থাকবে প্রিয় যতদিন আমি বেঁচে আছি। মনে আছে, ঈশ্বর যেদিন মাটির ডেলায় তোমার আদল দিচ্ছিলো আমি ছিলাম তোমার পাশে। আমি তোমার ঈভ। ভুল করে ভুল ফল ভক্ষণে সহস্রযুগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম একে অপরের। খুঁজতে খুঁজতে কৃষ আমি সেদিন সন্ধ্যায় দেখেই চিনেছিলাম তোমাকে। তুমিওকি তাই? বৃক্ষ সাক্ষী, পুষ্প সাক্ষী, মন পবনে সাক্ষী আমার প্রেম-আমার নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি তোমার মাঝেই বিরাজ করি। স্বর্ণলতা হয়ে জড়িয়ে থাকি সুপারি বৃক্ষদেহ। ওগো আমার অগ্রে পশ্চাতে কেউ নাই। তুমি ছাড়া আমার কেহ নাই। ছিলোনা কোনোকালে।

ঝলমলে আলোয় ঘর ভরিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি ফিরে আসে। দেয়ালে ঝুলানো ছবিটায় চোখ যায়। মাস ছ`য়েক আগে তোলা। দিবসের প্রায় শেষ। যেমন আহ্লাদে প্রিয়তম যুবকের কোলে সোহাগে ঢলে পরে কিশোরী কন্যা, রাতের বুকে তেমনি সমর্পিত হয় বিকেলের লালচে সূর্য। সমুদ্রের জলে তার ছায়া পরে। আঁচলের কোনটুকু ছুয়ে শুভ বলেছিলো,
-দেবী, তুমি আমার। তোমার ঠোঁটের কোণের বক্ররেখা, নাকের উপর জমে উঠা ফোটা ফোটা ঘাম, তোমার চুড়ির রিনঝিনে শব্দ-সবসহ তুমি আমার।
কলিংবেলের শব্দ পাওয়া যায় এতোক্ষণে। আহা, এরচেয়ে মধুর করে বাজাতে পারেনি বিসমিল্লাহ্ খাঁ-তাঁর সানাই কোনোদিন। কোকিল কি এরচে মিষ্টি কণ্ঠে গাইতে পারে গান কখনো! অতপর শাপলা নগ্নপায়। হাঁটেনা- দৌড়োয়। কবাটের মাঝে নব, তারপর সুরক্ষা শিকল, উপরে আগল। সব খুলতে কত সময় খরচা! দরোজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় পুরুষ। শাপলা অধোমুখি হয়। অভিমান ছুয়ে যায় এই এতোক্ষণে।
-রাগ হয়েছে পাখিটার। তোকে সারপ্রাইজ দেবো বলেইতো এতো আয়োজন।
-কি উদ্ধার করছিস তুই আমার
-হইছে কি শোন, আবীরের বৌয়ের আজ জন্মদিন। পাগলা একা কিছু পছন্দ করে কিনতে পারে না। কইলো দোস্ত একটু হেল্প কর। অফিস থেকে বাড়াইয়া ওর সাথে গেলাম বেইলীরোড, ওর বৌয়ের লিগা শাড়ি কিনতে। গিয়াতো আমার  মাথা পুরা আওলা। এতো সুন্দর সুন্দর সব শাড়ী। আমি কই, বৌতো আমারো আছে। না হোক জন্মদিন। খোদার প্রতিটাদিনই আমাদের খুশির দিন। আমাদের ঈদের দিন। জানি দেরি হইলে তুমি বার বার ফোন দিবা। জিজ্ঞেস করলে মিথ্যা বলতে পারবোনা। তো আর সারপ্রাইজ থাকে কই। দিলাম ফোন বন্ধ কইরা। কমপক্ষে দশবার কল দিছিলা আন্দাজ করি।
-বাইশবার

শুভ হাসতে হাসতে শাড়ীর প্যাকেট হাতে তুলে দেয়। এটা নতুন কোনো বিষয় না। এই কাজটা প্রায়শই সে করে। হুট করে কিছু একটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবে, সারপ্রাইজ। ভদ্রলোকের চুক্তি, এরপরে সেই সারপ্রাইজ গায়ে পরে একপাঁক নেচে দেখাবে শাপলা। এই নাচের আলাদা সাজন আছে। পেল্লায় সাইজের একটা শার্ট। গায় দিলেই শাপলাকে লাগে কাকতাড়ুয়ার মতো। পুতুল নাচের সুতোয় বাঁধা পুতুলের মত দু চারটা মুদ্রা। সেই ছবি শুভর ফোন গ্যালারিতে আছে। মাঝে মাঝেই ব্ল্যাকমেইল করে সে শাপলাকে। ভয় দেখায় ফেসবুকে আপ করে দেবে বলে। এই ভয় দেখিয়ে শাপলাকে দিয়ে অনেক কিছু করিয়ে ফেলতে পারে শুভ। কোনো রাতে শাপলা নিমরাজি থাকলে এই বুদ্ধি বেশ কাজে দেয়।

প্যাকেট খুলে জলপাই রঙ্গা তাঁতের শাড়ি বের করে শাপলা। মিছে রাগ দেখায়,
-বুড়োটে রং, সস্তার শাড়ী। কেমন ফালতু রুচি তোর বল। পড়লে আমায় ঠিকে ঝিয়ের মত লাগবে
-দেশে বিদেশে যেখানেই বেড়াতে যাস, লোহা লক্কর ইট পাথরের গয়নাতো কম কিনিসনা। ওইগুলা সাথে পর। দামী দেখাবে। প্রিন্সেস অফ পার্সিয়া।

মাছ পটলে রাতের খাওয়া চলে। কথায় দুজনার মিলে না কখনোই। সারাক্ষণ চেচামেচি, ঝগড়া।
-এইটা কি। চিংড়িতে টমেটো দেস নাই কেন। নাকি টমেটো  সব মুখে মেখে ফেলছিস।
- উইকেন্ডেতো আইলসার মতো ঘুমাস দিনরাত। এই সপ্তাহে বাজার করছিলি বল সত্যি কইরা। শুভ, যা রান্না করছি সোনামুখ করে খা।

বাইরে রাত বাড়ে। শহরের পশ এই এলাকায় এখনো ঝিঁ ঝিঁ পোকা দেখা যায় খুব। একঘেয়ে ঝিমঝিমে তান ধরে ঘুম পাড়ানি গানের মত। জলপাই রং শাড়ী যত্নে পরে শাপলা। লো-কাট লাল ব্লাউজের হাতায় চিকন জরি। কুল ওয়েভ পারফিউমকে শাপলার শরীরের গন্ধ থেকে আলাদা করা যায় না। জিরো পাওয়ারের নীল আলোয় মোহমায়া ছড়িয়ে শুভর সামনে দাঁড়ায় মূর্তিমযী ভালোবাসা। চাঁদে গ্রহণ লাগে। বিশ্ব চরাচরে নেউ নেই। নিশী ঘোর লাগা মানব এগোয় প্রিয়তমা মানবীর দিকে। নিঃশেষে নতজানু। শুভ্রর হাত ছুঁয়ে যায় শাপলার কটি। পীঠময় অবাধ্য খোলাচুলে মুখ ডোবায় শুভ। কেশের সুবাশের পর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
-পলা, আমি তোকে অনেক ভালোবাসি
কণ্ঠের মদিরতা ছুঁয়ে যায় শাপলাকে। আর সে ভেঙ্গে যায়। চুড়ে যায়। সলতেয় আগুন লাগা মোমের মত গলে গলে যায়। ছেলে বেলায় শেখা কবিতার লাইন মনে পড়ে: ওগো শোনো কান পেতে, মোরা আছি গানে মেতে।

এইচআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।