সুচিত্রা সেনের জন্মভিটার সংস্কার চায় পাবনাবাসী


প্রকাশিত: ০৭:৩২ এএম, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের পৈতৃক নিবাস পাবনা। সুচিত্রাকে নিজেদের মেয়ে ভাবতেই গর্ববোধ করে পাবনাবাসীরা। তাই মহানায়িকার জন্মভিটা ও তার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটিকে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে সংস্কার করে তার নামে স্মৃতি আর্কাইভ করার দাবিও দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে তারা।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এ বিষয়ে শিগগিরই কিছু একটা ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়ে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও কিছুই করতে পারেনি সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা। হয়নি বাড়িটির সংস্কারও। সুচিত্রার প্রয়াণের দ্বিতীয় বছরে এক সম্মরণানুষ্ঠানে তাই পাবনাবাসীদের গলায় শোনা গেল আক্ষেপের সুর।

রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় পাবনা প্রেসক্লাবে সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ আয়োজিত স্মরণসভায় এ নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন উপস্থিতিরা। তারমধ্যে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. রামদুলাল ভৌমিক বলেন, ‘দেড় বছর হলো সুচিত্রা সেনের পৈত্রিক নিবাসটি জেলা প্রশাসন উদ্ধার করার পর আজও সেখানে কোনো কিছু করা হয়নি। সাড়ে ৩ কোটি টাকার প্রকল্প সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হলেও কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার। অবিলম্বে বাড়িটি ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে দ্রুত সংস্কার করে স্মৃতি আর্কাইভ করা হোক।’

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. এম আবদুল আলীম বলেন, ‘সুচিত্রা সেনের বাড়িটি বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে আরেকটি অবরুদ্ধ অবস্থায় ফেলা হয়েছে। পাবনার বাতাসে কান পাতলে আজও সুচিত্রা সেনের গান, অভিনয় শোনা যায়। সুচিত্রা সেনের জীবন, চলচ্চিত্র নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।’

সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি ও জেলা পরিষদ প্রশাসক এম সাইদুল হক চুন্নু বলেন, ‘আন্দোলনের মাধ্যমে বাড়িটি আমরা উদ্ধার করেছি। কিন্তু অবমুক্ত হলেও বাড়িটিতে এখনো আমরা কিছু করতে পারিনি। এ বছর চলচ্চিত্র উৎসব হবে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।’

পরিষদের সভাপতি ও জেলা পরিষদ প্রশাসক এম সাইদুল হকের সভাপতিত্বে স্মরণসভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. রামদুলাল ভৌমিক। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- প্রেসক্লাবের সভাপতি রবিউল ইসলাম রবি, সাবেক সভাপতি শিক্ষাবিদ প্রফেসর শিবজিত নাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. এম আবদুল আলীম, ছাত্র উপদেষ্টা ড. হাবিবুল্লাহ, পাবনা অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক আব্দুল মতীন খান, সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা মেহরে সুলতানা, সাংবাদিক এ বি এম ফজলুর রহমান, কৃষিবিদ অধ্যাপক জাফর সাদেক, রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পী আবুল হোসেন ও পাবনা ড্রামা সার্কেলের সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান।

সভার শুরুতে সুচিত্রা সেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। পরে সুচিত্রা সেনের প্রতিকৃতিতে ফুলের মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান অতিথিরা। পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আবৃত্তিকার স্বাধীন মজুমদার।

প্রসঙ্গত, সুচিত্রা সেনের বাড়িটি পাবনা শহরের দিলালপুর মহল্লায় হেমসাগর লেনে অবস্থিত। এখানে তিনি বাবা-মা ও ভাইবোনের সঙ্গে শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন। ১৯৪৭ সালে নবম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার দিবানাথ সেনের সঙ্গে সুচিত্রার বিয়ে হয়। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে তিনি কলকাতায় চলে যান। সে সময় সুচিত্রার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত পাবনা পৌরসভার স্বাস্থ্য পরিদর্শক ছিলেন। ১৯৫১ সালে করুণাময় অবসরে যান।

১৯৬০ সালে করুণাময় বাড়িটি জেলা প্রশাসনের কাছে ভাড়া দিয়ে পরিবার নিয়ে কলকাতায় চলে যান। এ সময় প্রশাসন বাড়িটি সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোয়ার্টার বানায়। ১৯৮৭ সালে বাড়িটি ইজারা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের সঙ্গে তদবির শুরু করে জামায়াত। পরে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সৈয়দুর রহমান বাড়িটিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ইমাম গাজ্জালী ট্রাস্টকে ইজারা দেয়। এই ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কেন্দ্রীয় জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান ও সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিলেন জেলা জামায়াতের আইনবিষয়ক সম্পাদক আবিদ হাসান।

দিলালপুর মহল্লার বাসিন্দারা জানান, করুণাময় কলকাতায় চলে যাওয়ার সময় বাড়িটির স্থাপত্যশৈলী অনেক সুন্দর ছিল। বাড়িটিতে ছাদসহ একটি একতলা ভবন ছিল। পামগাছ, করবী, রজনীগন্ধাসহ ফুলে ফুলে সাজানো ছিল বাড়ির চারপাশ। কিন্তু জামায়াতের লোকজন ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে ভবনের ছাদ ভেঙে টিন লাগিয়েছে। মূল্যবান সব গাছ কেটে ফেলেছে।

সুচিত্রা সেন সংস্কৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সম্পাদক রাম দুলাল ভৌমিক জানান, বাড়িটি স্থায়ীভাবে দখলের জন্য ট্রাস্ট কর্তৃপক্ষ নানা কৌশল নিয়েছিলো। ১৯৮৭ সালের জেলা প্রশাসন ওই ট্রাস্টকে বাড়িটি বার্ষিক ইজারা দিয়েছিল। ১৯৯১ সালের ১৮ জুন ট্রাস্ট বাড়িটি স্থায়ী বন্দোবস্ত নেওয়ার আবেদন করে। তবে ওই বছরের আগস্ট মাসে ভূমি মন্ত্রণালয় তাদের স্থায়ী বন্দোবস্ত না দিয়ে আবারও বার্ষিক ইজারা দেয়। পরবর্তীকালে ইজারার টাকা পরিশোধ না করায় ১৯৯৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রণালয় ইজারা বাতিল করে। ট্রাস্টের নেতারা বকেয়া পরিশোধ সাপেক্ষে ১৯৯৫ সালের ১৫ আগস্ট পুনরায় ইজারা নবায়ন করান। এর পর থেকেই বাড়িটি তাদের দখলে ছিলো।

তবে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী জামায়াতের দখল থেকে সুচিত্রার পৈতৃক বাড়িটি মুক্ত করে ‘সুচিত্রা সংগ্রহশালা’ গড়ে তুলতে জেলাবাসী ঐক্যবদ্ধ ছিলো। তারই ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ আন্দোলনের পথ পাড়ি দিয়ে ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই আদালতের নির্দেশে বাড়িটি জামায়াতের হাত থেকে দখলমুক্ত হয়। এরপর থেকেই বাড়িটিকে সরকারি হেফাজতে নিয়ে এটিকে ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে সংস্কার করে সুচিত্রা সেনের নামে স্মৃতি আর্কাইভ করার দাবি করে আসছে পাবনাবাসী।

এলএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।