মানুষের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি তার ঋণ শোধ করা যাবে না: রিয়াজ
ছিলেন বিমান বাহিনীর পাইলট। সেখান থেকে ১৯৯৫ সালে ঘটনাক্রমে চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে তার। নিজের স্টাইল, অভিনয়ের সাবলীলতা আর কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা তাকে তার সময়ের সেরা নায়কের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিল। জনপ্রিয়তার আকাশ ছুঁয়েছেন তিনি বহু হিট-সুপারহিট সিনেমা দিয়ে। সালমান পরবর্তী সময়টাতে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন নির্মাতাদের প্রথম ও সেরা পছন্দ। পেয়েছেন তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। সিনেমার বাইরে টিভি নাটকেও তিনি মাইলফলক সাফল্য পেয়েছেন। ‘জোছনার ফুল’, ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ ধারবাহিকগুলোসহ বহু একক নাটক তার উদাহরণ। বলছি চিত্রনায়ক রিয়াজের কথা।
সর্বশেষ ‘কৃষ্ণপক্ষ’ সিনেমা মুক্তি পেয়েছে তার ২০১৬ সালে। এরমধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু’ ছবিতে অভিনয় করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ চরিত্রে। এবার নতুন করে কাজ শুরু করেছেন তিনি ‘রেডিও’ সিনেমায়। অনন্য মামুন পরিচালিত ছবিটির গল্প ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেক্ষাপটে।
ছবিটির শুটিং শুরু হয়েছে মানিকগঞ্জে। হরিরামপুর থানার বেশকিছু এলাকায় ও চরে চলছে দৃশ্যায়ণ। সেখান থেকেই জাগো নিউজের মুখোমুখি হলেন এক সময়ের হার্টথ্রব এই নায়ক। লিখেছেন লিমন আহমেদ-
জাগো নিউজ : সিনেমায় আপনি নিয়মিত নন। হঠাৎ ‘রেডিও’ ছবিটিতে কেন কাজ করতে রাজি হলেন?
রিয়াজ : ধন্যবাদ। এই ছবিটির গল্প যখন শুনি তখনই ভালো লেগে যায়। সাবজেক্টটা, যেটি নিয়ে গল্পটি খুবই ইন্টারেস্টিং লেগেছে। ৭ মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণকে কেন্দ্র করে গল্প। আমরা সবাই জানি এই ভাষণ সারা বিশ্বের জন্যই একটি সম্পদ। গল্পটি শুনিয়ে অনন্য মামুন যখন বললেন করবেন নাকি, বললাম, ‘অবশ্যই করবো। আমি ছবিটি করতে চাই যদি তুমি আমাকে নাও’।
জাগো নিউজ : ছবির গল্পে ‘৭ মার্চ এবং রেডিও’- কীভাবে ভূমিকা রাখবে?
রিয়াজ : ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। তখন উত্তাল সারাদেশ। চারদিকে নানা রকম ঘটনা ঘটছিল। এরমধ্যে একটি অখ্যাত গ্রাম। যে গ্রামটির চারদিকে পানি। চরের মধ্যে গ্রাম। এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না। সব খবরই দেরিতে পৌঁছায়। সেই গ্রামের দুটি রেডিও নিয়ে সিনেমার গল্প। যেখানে দেখা যায় দুই দল মানুষ। এক দল মানুষ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে চায়, স্বাধীন হতে চায়। আরেক দল তাদের গলা চেপে ধরতে চায়। এটা নিয়েই ছবিটি এগিয়েছে। দেশপ্রেম, পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতি, মানব-মানবীর প্রেমও এখানে উপজীব্য হয়ে ধরা দেবে।
জাগো নিউজ : ‘রেডিও’-তে আপনাকে কেমন চরিত্রে দেখা যাবে?
রিয়াজ : আমি ওই গ্রামটির স্কুল মাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করবো। যার নাম নহবত মাস্টার। যে সবাইকে নানাভাবে সচেতন করে, দেশপ্রেমে উৎসাহী করে তুলে। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর এলাকার। সে মানুষের কথা বলে, বঙ্গবন্ধুর কথা বলে। সবাইকে নেতৃত্ব দেয় স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে।
জাগো নিউজ : দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অনেক গুণি ও নামী পরিচালকদের সঙ্গে আপনি কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এ প্রজন্মের নির্মাতা অনন্য মামুনকে নিজের পরিচালক হিসেবে কীভাবে দেখছেন? তার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
রিয়াজ : মামুনকে যখন প্রথম দেখি তখন সে অনেক ছোট। এখনো সে ছোটই আছে। বাট সে অনেক পরিপক্ষ। তার টিম বেশ দক্ষ। গুছিয়ে কাজ করছে। তার সঙ্গে ফার্স্ট কাজ করছি। আমি ইমপ্রেসড। ওর মধ্যে অনেক ভালো কিছু করার প্রবল ইচ্ছে আছে। বাট ও কতোদূর কি করতে পারবে সেটাই দেখার বিষয়। কারণ আমাদের এখানে যেটা হয় যে এ ধরনের ছবিতে প্রচুর লিমিটেশন্স থাকে। বাজেটের লিমিটেশন, লোকেশনের প্রতিবন্ধকতা, কস্টিউমসে লিমিটেশন্স থাকে। আপনারা দেখছেন ট্রলারে দেড় ঘণ্টায় নদী পার হয়ে একটা রিমোট এলাকায় এসে কাজ করছি। খাবারের সুব্যবস্থা নেই। পানিটাও এখানে হিসেব করে খরচ করতে হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। বিদ্যুৎ নেই। এতকিছুর মধ্যেও মামুন একটা পিরিওডিক্যাল ছবি বানাতে এসেছে এবং সে হেসেখেলে বানিয়েও ফেলছে। এটা আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে। তার সাহস ও ইচ্ছেটা আমাকে সত্যি মুগ্ধ করেছে।
জাগো নিউজ : লাক্স তারকা জাকিয়া বারী মম ২০০৭ সালে প্রথম সিনেমায় কাজ করে। ‘দারুচিনি দ্বীপ’ নামের সেই ছবিতে তার নায়ক ছিলেন আপনি। ১৫ বছর পর আবারও দুজনে একসঙ্গে কাজ করছেন। এ নিয়ে কিছু বলবেন?
রিয়াজ : ‘দারুচিনি দ্বীপ’ একটা নস্টালজিয়া। অনেক স্মৃতি রয়েছে সে ছবিতে আমাদের। ছবিটিতে মম ছিল জরী চরিত্রে। আমি কাজ করেছিলাম শুভ্র চরিত্রে। দর্শকপ্রিয় ছিল ছবিটি। তখন মম ছিল নতুন একটা মেয়ে। আর এখন যে মমকে দেখছি সে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ।
জাগো নিউজ : এ ছবিতে কি আপনাকে ও মমকে জুটি হিসেবে দেখবো?
রিয়াজ : ‘দারুচিনি দ্বীপ’ ছবিতে একটা চমৎকার কেমিস্ট্রি ছিল আমাদের। জরী ও শুভ্রর রোমান্টিকতা মুগ্ধ করেছিল দর্শককে। আবার ১৫ বছর পরে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। এখানেও আমরা জুটি হিসেবেই দেখা দেবো। তবে এটি সো কলড রোমান্টিক সিনেমা হবে না। এখানে আসলে একটা ম্যাচিউর রিলেশন দেখানো হবে। দুজনেই দেশের জন্য কাজ করছে। তাদের একটা কেমিস্ট্রি আছে ৭ মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করে গল্পের ভেতর।
জাগো নিউজ : একটু আগেই বলছিলেন রিমোট এরিয়ায় অনেক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কাজ করছেন। দেড় ঘণ্টা ট্রলারে করে পদ্মা নদী পার হতে হয়েছে। যা বেশ ঝুঁকিরও। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে এসে ‘রেডিও’ সিনেমার নহবত মাস্টার হয়ে উঠতে আপনার যে ডেডিকেশন বা পরিশ্রমটা দেখা যাচ্ছে এর প্রেরণা বা আত্মবিশ্বাসটা কোথায়?
রিয়াজ : একটি ভালো কাজের প্রত্যাশা ডেডিকেশন তৈরি করে দেয়। তাছাড়া আমি মনে করি অভিনয়টা এখনো শিখছি। এতোটা দক্ষ আমি না। প্রতিদিনই চেষ্টা করি শিখতে। আর শেখার জন্য ডেডিকেশনটা খুব মাস্ট। আর এ ধরনের পিরিওডিক্যাল ছবি করতে গেলে রিয়াজকে ভেঙে নহবত মাস্টার হয়ে উঠতে গিয়ে যে কি না একাত্তরের সেই মাস্টার, বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে রেডিওতে, শুনে শুনে উজ্জীবীত হয়; এ চরিত্রটা করতে গেলে কষ্ট করতেই তো হবে। না করলে তো হয় না। ইজ নট এ ভেরি ইজি থিং। সহজ কিছু না আসলে।
জাগো নিউজ : অনেক নাটক-সিনেমায় মাস্টার চরিত্রে অভিনয় করেছেন আপনি। ‘রেডিও’-তেও আবার মাস্টার। ব্যক্তিজীবনে কখনো মাস্টারি করেছেন?
রিয়াজ : (লাজুক হেসে) বাস্তব জীবনে মাস্টারি সেই অর্থে করা হয়নি। তবে টিউশনি করিয়েছি। মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেরই ছাত্রজীবনে টিউশনি করানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেক মজার অভিজ্ঞতাও থাকে। (জোরে হেসে) রোমান্টিক অভিজ্ঞতাও থাকে অনেকের। আমার তেমন কিছু মনে নাই।
জাগো নিউজ : সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায় আপনার ভক্ত-অনুরাগীরা প্রায়ই বলেন, ‘রিয়াজকে অভিনয়ে দেখতে চাই’। অভিনয়ে নিয়মিত হবার ব্যাপারে কিছু জানতে চাই-
রিয়াজ : দেখুন, নানা রকম সংকট ও ব্যস্ততা গেছে। বাট এফডিসি ও অভিনয় দিয়েই আমি রিয়াজ। মানিকগঞ্জের এই লেছড়াগঞ্জের গঙ্গাদর্দি চরে কাজ করতে এসে আমি অভিভূত হয়েছি। মেকাপ নিয়ে বসেছিলাম শুটিং করবো বলে। হঠাৎ এক বৃদ্ধা এসে আমার দুই গালে দুই হাত রেখে আদর করে দিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘তুমি আমার ছেলের মতো। তোমাকে ভালো লাগে।’এই যে আন্তরিকভাবে তিনি আদরটা করলেন, এটা আমাকে অভিভূত করেছে। আমার মেকাপটা নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা ঠিক করতে হয়েছে। বাট এই আদর, দোয়াটা তো অমূল্য। এ মানুষগুলোর জন্য আমি নিয়মিত সিনেমা করতে চাই। ভালো সিনেমা, ভালো গল্প, কাজের সুযোগ; সবকিছু মিলিয়ে যদি হয় তাহলে কাজ না করার কোনো কারণ নেই।
জাগো নিউজ : গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা হলো। তারা জানালেন যে এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই করুণ। বিদ্যুৎ এসেছে এক মাস আগে। গ্রামে টিভি নেই। সেই এক মাইল দূরে বাজার। সেখানে গিয়ে তারা সিনেমা দেখেন এবং তারা শুধু রিয়াজকেই চেনেন। রিয়াজের ছবি হলেই তারা ওই এক মাইল দূরে গিয়ে দেখে। এ বিষয়টা নিয়ে আপনার অনুভূতি শুনবো-
রিয়াজ : এটা সত্যি অত্যন্ত আনন্দের একটি ব্যাপার। অনেক বড় প্রাপ্তি বলেও মনে করি আমি। এই গ্রামের বাচ্চা থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, সবার কাছ থেকে আমি যে আতিথেয়তা পাচ্ছি সেটাও বলে শেষ করা যাবে না। ঘরের ছেলের মতো তারা বরই পেরে দিচ্ছেন, কেউ গরুর দুধ নিয়ে আসছেন, পেঁপে আনছেন। কেউ আবার সরিষা দিয়ে মাখিয়ে ঘরে তৈরি মুড়ি নিয়ে আসছেন বিকেলে। এই যে ভালোবাসা, এই ভালোবাসার দাম আমার কাছে অনেক। আমি মনে করি সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত আমার প্রতি, বাংলার মানুষের, এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের অকৃত্রিম যে আদর-ভালোবাসা আমি পেয়েছি তার ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না।
জাগো নিউজ : দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বৈচিত্রময় গল্প ও চরিত্রে কাজ করেছেন। শহর, গ্রাম বাংলার সব শ্রেণির দর্শকের জন্য আপনি কাজ করেছেন। জানতে চাই এমন কোনো চরিত্র বা গল্প আছে কি না যে চরিত্রে কাজের স্বপ্ন ছিল বা এখনো স্বপ্ন দেখেন?
রিয়াজ : অনেক চরিত্রই আছে যেগুলোতে কাজের স্বপ্ন দেখি। শিল্পীর তো আসলে কোনো তৃপ্তি থাকে না কাজের ক্ষেত্রে। তবে ‘বঙ্গবন্ধু’ সিনেমায় কাজ করতে পারে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। বড় বাজেট, দুই দেশের মিলিত সিনেমা। এতে কাজ করে আমি আনন্দিত। আর জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় মন্তু চরিত্রে কাজ করতে পারাটাকেও আমি সৌভাগ্য মনে করি।
জাগো নিউজ : একটু অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাই। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে নানা রকম সমালোচনা হচ্ছে। আপনি এ পুরস্কারের জুরিবোর্ডের একজন সদস্য। আপনার কিছু কথা শুনতে চাই-
রিয়াজ : দেখুন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে প্রতিবারই সমালোচনা হয়। এ নিয়ে তাই বিশেষ করে বলার কিছু নেই। তবে জুরিবোর্ড মানেই এই পুরস্কারে শেষ কথা নয়। তবে আমি বলবো সবারই নিজের প্রতি সৎ হওয়া জরুরি। শিল্পচর্চায় সততা না থাকলে হয় না।
জাগো নিউজ : এমন সমালোচনাও উঠেছে যে আপনি জুরিবোর্ডে ছিলেন বলেই দশের শীর্ষ নায়ক শাকিব খান এবার পুরস্কার পাননি। সিয়াম পেয়েছেন-
রিয়াজ : (মজা পাওয়ার ভঙ্গিতে হেসে) এসব কথাবার্তা শুনতেও ভালো লাগে। দেখুন স্পষ্ট করে বলছি, জুরিবোর্ড যে মার্কিং করে সেটি কোনো শীর্ষ নায়ক দেখে হয় না। অভিনয় দক্ষতা, পারফরমেন্স এবং সিনেমার সঙ্গে তার একাগ্রতা দেখে মার্কিংটা হয়। এখানে কে শীর্ষ আর কে শীর্ষ না তা দেখে মার্কিং হয় না। আর জুরিবোর্ড কয়েকজনের সমন্বয়ে একটি টিম। একা এখানে কেউ কিছু নয়। আমার ধারণা আমি ক্লিয়ার করতে পেরেছি। সবাই বুঝতে পারবেন।
এলএ/জেআইএম