৬২ বছরে রাইসুল ইসলাম
স্বনামধন্য অভিনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা রাইসুল ইসলাম আসাদ -এর আজ জন্মদিন। আজ থেকে ৬১ বছর আগে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বছরের ১৫ই জুলাই ঢাকাতে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। শিশুকাল কাটিয়েছেন ঢাকাতেই, বড় হয়েছেন ঢাকার অলিগলিতে। পল্টনে বড় হয়ে উঠার কারণে এ এলাকার রাজনৈতিক হাওয়াটা উপেক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠেনি তাঁর পক্ষে। সে সময়ে তাদের পাড়ায় উঠতি বয়সীদের একটা ক্লাব ছিল, নাম-একতা বিতান। সেই ক্লাবে খেলাধূলার পাশাপাশি তিনি রাজনীতি নিয়ে তর্ক-বিতর্কেও মেতে থাকতে পছন্দ করতেন।
ছোটবেলা থেকেই মূলত তার মাথায় ঢুকে যায় যে, পাকিস্তানি আর আমরা এক জাতি নই। তাদের ভাষা আলাদা, পোশাক আলাদা, খাবার আলাদা। তারা সংখ্যায় কম হলেও সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ওরাই পাচ্ছিলো। সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসার কম, সরকারী সিভিল সার্ভিসে বাঙালি অফিসার কম। মেধা ও দক্ষতা থাকলেও সরকারী চাকরিতে একটা পর্যায়ের পরে বাঙালিদের প্রমোশন দেওয়া হয় না। আমাদের দেশের সোনালী আঁশ রপ্তানির টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানে গড়ে তোলা হচ্ছে বড় বড় ভবন আর কারখানা-ইন্ড্রাষ্ট্রি। এই বৈষম্য আর শোষণ তার তরুণ মনে তীব্র রেখাপাত করে।
এর মাঝে চলে আসে ২৫ মার্চ। সেই কালোরাতের গণহত্যার পর তাঁর পাকিস্তান বিদ্বেষ পরিণত হয় প্রচন্ড ঘৃণায়। তাই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে তিনি সূযোগ খুঁজতে থাকি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার। সে সময়ে ঢাকায় তরুণদের খুঁজে বের করে করে মেরে ফেলা হচ্ছিলো , তাই পালিয়ে যান তিনি। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পালিয়ে প্রথমে জিঞ্জিরায়, তারপর বিক্রমপুরে গিয়ে উঠেন। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে ঢাকায় ফিরে এসে চলে যান যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে আগরতলায়। ট্রেনিং নিয়ে এসে কলেজিয়েট স্কুলের মেধাবী এই ছাত্র ঢাকার উত্তর সেকশনের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের সামনে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে পাকিস্তানি মিলিটারিদের ভ্যান উড়িয়ে দেওয়ার অপারেশনটি মুক্তিযোদ্ধের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েই থাকবে তার কাছে আজীবন।
যুদ্ধ শেষেই এই গুণী অভিনেতা যুক্ত হয়ে পড়েন মঞ্চ নাটকের সাথে। ১৯৭২ সালে রাইসুল ইসলাম আসাদ প্রথম মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন। `আমি রাজা হব না` এবং `সর্পবিষয়ক গল্প` নামের ২টি নাটক করেন তিনি যার মাঝে কোন বিরতি ছিল না। এরপরে একে একে অভিনয় করেন আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে `পশ্চিমের সিঁড়ি` নাটকে। ১৯৭৩ সালে তিনি কয়েকজনকে সাথে নিয়ে গঠন করেন ঢাকা থিয়েটার। এরপরে অভিনয় করেন সংবাদ কার্টন, সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ নাটকে। এর পর থেকে ঢাকা থিয়েটারে একের পর এক সাড়া জাগানো নাটকে অভিনয় করেন তিনি।
ঢাকা থিয়েটার গঠনের বছরেই মুক্তি পায় তার প্রথম চলচিত্র `আবার তোরা মানুষ হ`, এরপরে একে একে অভিনয় করেছেন বহু সংখ্যক সিনেমাতে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পদ্মা নদীর মাঝি, লাল দরজা, লালন, পতঙ্গ (হিন্দি), মনের মানুষ, হঠাৎ বৃষ্টি, ঘুড্ডি, একই বৃত্তে, উত্তরা, আমার বন্ধু রাশেদ, দুখাই, লালসালু, মনের মানুষ ইত্যাদির মত দর্শকপ্রিয় সব সিনেমা।
শুধু চলচিত্র ও মঞ্চ নয়, গুণী এই অভিনেতা বেতার, টেলিভিশনেও সমান জনপ্রিয়। নিজের নানা কাজের জন্য একাধিকবার জাতীয় পদকও জয় করেছেন তিনি। এখনও বিরামহীনভাবে নিয়মিত অভিনয় করে যাচ্ছেন মহান এই অভিনেতা। শুধু অভিনয় করছেন তাই নয় জনপ্রিয়তা ও তারকাদের অবস্থানের কাতারে তিনি রয়েছেন শীর্ষে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তাঁর অভিনয় ও তার অভিনীত চলচ্চিত্র বাপক প্রশংসিত হয়েছে। তিনি অভিনয় করেছেন গৌতম ঘোষ এবং তানভীর মোকাম্মেলের মতো পরিচালকের সাথে তাদের সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্রে। `লালন` সিনেমায় তিনি `লালন` চরিত্রে এবং `মনের মানুষ` সিনেমাতে লালনের গুরু `সিরাজ সাঁই` চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। এছাড়াও পদ্মা নদীর মাঝিতে তিনি কুবের চরিত্রেও অভিনয় করে নিজের অভিনয় জীবন সমৃদ্ধ করেছেন।
এছাড়াও তিনি অভিনয় করেছেন বহু সংখ্যক নাটকে। তার অভিনীত জনপ্রিয় নাটকগুলোর মাঝে আছে হৃদয়ের ছবি, পৌষ ফাগুনের পালা, চিঠি আসে না ইত্যাদি। কাজ করেছেন টেলিফিল্মেও যার মধ্যে আছে ১৯৭১, ইত্যাদি। শুধ অভিনয় নয় গুণী এই ব্যাক্তি করেছেন পরিচালনার কাজও। ২০১০ সালে পরিচালনা করেন ধারাবাহিক নাটক `আলো ছায়া` যার রচয়িতা ছিলেন আজাদ আবুল কালাম।
গুণী একজন মানুষের কর্মপরিধি শুধুমাত্র এক স্থানেই আটকে পড়ে থাকেনা। শিল্পের সব শিখরই ছুঁয়ে যান তিনি। এর জ্বলন্ত উদাহরণ গুণী অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ। শুধু অভিনয়ে সীমাবদ্ধ থাকেননি এই গুণী মানুষটি। গানও গেয়েছেন তিনি। ঘুড্ডি সিনেমাতে গান গেয়েছিলেন এই অভিনেতা। সম্প্রতি সরকারি অনুদানে নির্মিত গাজী রাকায়েত পরিচালিত ‘মৃত্তিকা মায়া’ ছবির গানে আবারো কণ্ঠ দেন তিনি।
জন্মদিনে তাঁর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা। কর্মজীবনে অমরত্বের মাইলফলক ছুঁয়ে আসুন তিনি।