আশার বছর হতাশায় কাটিয়ে নতুন প্রত্যাশা
চলে যাওয়া ২০১৫- বছরটা শুরু হয়েছিল বেশ আশার মধ্য দিয়েই। কিন্তু বছর শেষে সেই আশার জায়গায় অনেকখানিই জুড়ে রয়েছে হতাশা। এর কারণ বছরটিতে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলোর ব্যবসায়িক ব্যর্থতা। যদিও গেল বছর দেশজুড়ে সার্বিক পরিবেশ ছিল স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক। তারপরও ২০১৫ সালে মোট ছবি মুক্তি পেয়েছে মাত্র ৬৭টি।
অন্যদিকে ২০১৪ সালে দেশজুড়ে বেশ ভালো রকম অস্থিতিশীল পরিবেশ থাকলেও ছবি মুক্তি পেয়েছিল ৭১টি। অর্থাৎ কি না ২০১৫ সালে আগের বছরের তুলনায় ছবি মুক্তি পাবার সংখ্যা কমেছে। তার উপর ২০১৫ সালে যে সব ছবি মুক্তি পেয়েছে তার প্রায় ৯০ ভাগের উপর ছবি ব্যবসায়িকভাবে সফলতা অর্জন করতে পারেনি। আর তাই বেশীরভাগ প্রযোজকদের ঘরে ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে।
এক পলকে দেখে নেওয়া যাক গেল ২০১৫ সালে কোন কোন ছবিগুলো মুক্তি পেয়েছিল :
১. গেইম, ২. পুত্র এখন পয়সাওয়ালা, ৩. রোমিও বনাম জুলিয়েট, ৪. কমিশনার, ৫. বিগ ব্রাদার, ৬. জিরো ডিগ্রি, ৭. ভালোবাসা সীমাহীন, ৮. কার্তুজ, ৯. এই তো প্রেম, ১০. হৃদয় দোলানো প্রেম, ১১. পাগলা দিওয়ানা, ১২. হরিযুপিয়া, ১৩. গুন্ডা-দ্য টেরোরিস্ট, ১৪. ছুঁয়ে দিলে মন, ১৫. চিনিবিবি, ১৬. ওয়ার্নিং, ১৭. বোঝে না সে বোঝে না, ১৮. আয়না সুন্দরী, ১৯. অ্যাকশন জেসমিন, ২০. অচেনা হৃদয়, ২১. ঘাসফুল, ২২. সুতপার ঠিকানা, ২৩. দুই বেয়াইয়ের কীর্তি, ২৪. ইউটার্ন, ২৫. ভালোবাসার চ্যালেঞ্জ, ২৬. মনের অজান্তে, ২৭. দুই পৃথিবী, ২৮. পদ্মপাতার জল, ২৯. লাভ ম্যারেজ, ৩০. অগ্নি -২, ৩১. অমি ও আইসক্রিমওয়ালা, ৩২. নদীজন, ৩৩. প্রার্থনা, ৩৪. ভালো আমাকে বাসতেই হবে, ৩৫. খোকাবাবু, ৩৬. ব্ল্যাকমানি, ৩৭. আরো ভালোবাসব তোমায়, ৩৮. ব্ল্যাকমেইল, ৩৯. লাভার নাম্বার ওয়ান, ৪০. দ্য স্টোরি অব সামারা, ৪১. ভালোবাসতে মন লাগে, ৪২. মা বাবা সন্তান, ৪৩. জালালের গল্প, ৪৪. রাজাবাবু, ৪৫. আশিকী, ৪৬. সুরিনগর, ৪৭. ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল, ৪৮. রানআউট, ৪৯. নগর মাস্তান, ৫০. আজব প্রেম, ৫১. ভালোবাসার গল্প, ৫২. অশান্ত মেয়ে, ৫৩. চুপি চুপি প্রেম, ৫৪. অন্তরঙ্গ, ৫৫. গাড়িওয়ালা, ৫৬. আই লাভ ইউ প্রিয়া, ৫৭. মহুয়া সুন্দরী, ৫৮. গ্যাংস্টার রিটার্নস, ৫৯. ব্ল্যাক, ৬০. এপার ওপার, ৬১. শোভনের স্বাধীনতা, ৬২. অনিল বাগচীর একদিন, ৬৩. নয়ছয়, ৬৪. বাপজানের বায়োস্কোপ, ৬৫. লালচর ও ৬৬. স্বর্গ থেকে নরক,৬৭.অচেনা হৃদয় ।
উপরের তালিকায় যে ছবিগুলোর নাম উল্লেখ করা হয়েছে কাকরাইল পাড়ার হিসাব অনুযায়ী মাত্র ৫টি ছবি তাদের পুঁজি ঘরে নিতে সক্ষম হয়েছে। এই ৫টি ছবি হলো ‘লাভ ম্যারেজ’ (শাকিব-অপু বিশ্বাস), ‘রাজাবাবু’ (শাকিব-অপু বিশ্বাস), ‘ব্ল্যাকমানি’ (সাইমন-কেয়া-মৌসুমী হামিদ), ‘অগ্নি -২ (মাহি -ওম), ‘আশিকী’ (নুসরাত ফারিয়া-অঙ্কুশ)!
এখন প্রশ্ন হলো যদি একটি বছরে ৬৭টি ছবি মুক্তি পায় এবং তার মধ্যে মাত্র ৫টি ছবি পুঁজি ঘরে ফেরত নিতে পারে তাহলে পুরো চলচ্চিত্র ব্যবসার অবস্থা কতোটা ভয়াবহ সেটা বোঝার জন্য কি কারো চলচ্চিত্র বোদ্ধা হবার প্রয়োজন আছে? যাই হোক এত হতাশার মধ্যেও কিছুটা আশার আলো জ্বালিয়ে এ বছর অনেক নতুন নায়ক-নায়িকার অভিষেক ঘটেছে চলচ্চিত্রে। এর মধ্যে রয়েছেন পরীমনি (ভালোবাসা সীমাহীন, পাগলা দিওয়ানা, আরো ভালোবাসব তোমায়,মহুয়া সুন্দরী, লাভার নাম্বার ওয়ান, নগর মাস্তান), মৌসুমী হামিদ (ব্ল্যাকমানি, ব্ল্যাকমেইল ও জালালের গল্প), অমৃতা খান (গেইম, গুন্ডা-দ্য টেরোরিস্ট, পাগলা দিওয়ানা), পিয়া (গ্যাংস্টার রিটার্নস, দ্যা স্টোরি অব সামারা), নুসরাত ফারিয়া (আশিকী), মম (ছুঁয়ে দিলে মন), মৌসুমী নাগ (প্রার্থনা ও রানআউট), আলিশা প্রধান (অন্তরঙ্গ), সোহান খান (কার্তুজ), রিক্তা (কার্তুজ), তানিয়া বৃষ্টি (ঘাসফুল ও লাভার নাম্বার ওয়ান ), কাজী আসিফ (ঘাসফুল), আশিক চৌধুরী (আয়না সুন্দরী ও হৃদয় দোলানো প্রেম), সবুজ খান (পাগলা দিওয়ানা), সাব্বির আহমেদ (হরযুপিয়া), তানিয়া (আয়না সুন্দরী), প্রিয়ন্তী পরী (চুপিচুপি প্রেম), রাভিনা (মনের অজান্তে), অনন্যা ( ভালো আমাকে বাসতেই হবে), সীমান্ত (ভালো আমাকে বাসতেই হবে), শিবা (দ্যা স্টোরি অব সামারা), ইমু (দ্যা স্টোরি অব সামারা), হৃদয় চৌধুরী ( ভালোবাসতে মন লাগে), নির্জনা ( ভালোবাসতে মন লাগে), চমক তারা (মা বাবা সন্তান), অপূর্ব (গ্যাংস্টার রিটার্নস), সজল (রানআউট), মিনহাজ কিবরিয়া ((সুরিনগর), নায়লা (সুরিনগর), নীপা (সুরিনগর), মোহনা মীম (লালচর), সানজিদা তন্ময় (বাপজানের বায়োস্কোপ), মুনিয়া আফরিন (ভালোবাসার গল্প), আরেফ সৈয়দ (অনিল বাগচীর একদিন) প্রমুখ।
এ বছর সর্বাধিক সংখ্যক ৬টি ছবি মুক্তি পেয়েছে চিত্রনায়িকা পরীমনির। এই ৬টি ছবির একটিও ব্যবসায়িক সফলতার মুখ না দেখলেও ‘মহুয়া সুন্দরী’ ও ‘আরো ভালোবাসব তোমায়’ ছবিতে পরীমনির অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে। আর চিত্রনায়কদের মধ্যে সর্বাধিক ছবি মুক্তি পেয়েছে যথারীতি চিত্রনায়ক শাকিব খানের। ২০১৫ সালে তার ৫টি ছবি মুক্তি পেয়েছে। এগুলো হচ্ছে ‘এই তো প্রেম’, ‘দুই পৃথিবী’, ‘লাভ ম্যারেজ’, ‘আরো ভালোবাসব তোমায়’ এবং ‘রাজাবাবু’। এরমধ্যে দুটি ছবি ব্যবসায়িকভাবে সফলতার মুখ দেখেছে। ছবি দুটি হলো ‘লাভ ম্যারেজ’ ও ‘রাজাবাবু’।
অন্যদিকে নায়কদের মধ্যে বাপ্পী চৌধুরী ও সাইমনের ৩টি করে ছবি মুক্তি পেয়েছে। বাপ্পী অভিনীত ছবিগুলো হচ্ছে ‘গুন্ডা- দ্য টেরোরিস্ট’, ‘লাভার নাম্বার ওয়ান’ ও ‘আজব প্রেম’। বাপ্পী অভিনীত ৩টি ছবিই ব্যবসায়িকভাবে সফলতার মুখ দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। আর সাইমন অভিনীত ৩টি ছবি হচ্ছে ‘অ্যাকশন জেসমিন’, ‘ব্ল্যাকমানি’ ও ‘চুপি চুপি প্রেম’। এর মধ্যে ‘ব্ল্যাকমানি’ ব্যাসায়িকভাবে সফলতার মুখ দেখেছে আর ‘চুপি চুপি প্রেম’ ছবিটি ব্যবসাসফল না হলেও ছবিটি ছিল আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
তাছাড়া নায়িকাদের মধ্যে অপু বিশ্বাস ও মাহিয়া মাহির ৩টি করে ছবি মুক্তি পেয়েছে। অপু বিশ্বাস অভিনীত ছবিগুলো হচ্ছে ‘দুই পৃথিবী’, ‘লাভ ম্যারেজ’, ‘রাজাবাবু’। এর মধ্যে অপু অভিনীত ‘লাভ ম্যারেজ’ ও ‘রাজাবাবু’ ব্যবসায়িকভাবে সফলতার মুখ দেখেছে। মাহিয়া মাহি অভিনীত ছবিগুলো হচ্ছে ‘বিগ ব্রাদার’, ‘ওয়ার্নিং’ এবং ‘অগ্নি-২’। এরমধ্যে একমাত্র ‘অগ্নি-২’ ছবিটি কিছুটা ব্যবসায়িক সফলতার মুখ দেখেছে।
এছাড়াও আরেক জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা কেয়া অভিনীত ১ টি ছবি মুক্তি পেয়েছিলো। আর সেই ছবিটি হলো ‘ব্ল্যাকমানি’। এই ছবিটিও ব্যবসায়িক সফলতার মুখ দেখেছে।
আলোচিত ছবি ছিল গেল বছরে বেশ কয়েকটি। ছবিগুলো হলো ‘রোমিও বনাম জুলিয়েট’, ‘গুন্ডা-দ্য টেরোরিস্ট’, ‘ছুঁয়ে দিলে মন’, ‘ইউটার্ন’, ‘পদ্মপাতার জল’, ‘আরো ভালোবাসব তোমায়’, ‘ব্ল্যাকমেইল’, ‘লাভার নাম্বার ওয়ান’, ‘জালালের গল্প’, ‘ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল’, ‘রানআউট’, ‘ভালোবাসার গল্প’, ‘মহুয়া সুন্দরী’, ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’, ‘ব্ল্যাক’, ‘অনিল বাগচীর একদিন’ ও ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’। এই ছবিগুলোর মধ্যে নির্মাণশৈলী, গল্প এবং কলাকুশলীদের অভিনয়গুণে যে ছবিগুলো আলোচিত ছিল সেগুলো হলো ‘রোমিও বনাম জুলিয়েট’, ‘ছুঁয়ে দিলে মন’, ‘পদ্মপাতার জল’, ‘মহুয়া সুন্দরী’, ‘অনিল বাগচীর একদিন’, ‘বাপজানের বায়োস্কোপ’।
সজল ও মৌসুমী নাগ অভিনীত ‘রানআউট’ ছবিটিও আলোচিত ছিল সেন্সর বোর্ডের বিনা অনুমতিতে ছবিটিকে প্রাপ্তবয়স্কদের ছবি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে। আর বাকী ছবিগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ছবিই আলোচিত ছিল বিগ বাজেটের ছবি হয়েও ব্যবসায়িকভাবে চরমভাবে ব্যর্থ হওয়ার কারণে। তবে বছরের সব ছবিকে ছাপিয়ে মুক্তি না পেয়েও আলোচনার শীর্ষে ছিল নজরুল ইসলাম পরিচালিত ও সাইমন-পরীমনি অভিনীত ‘রানা প্লাজা’ ছবিটি! মামলা সংক্রান্ত ঝামেলায় এই ছবিটির মুক্তি এখনও অনিশ্চিত।
এছাড়া সাড়া বছর জুড়েই যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে অনিয়মের প্রশ্ন উঠেছে অনেকবার। তবে রহস্যময় কারণে এ ব্যাপারে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও সংগঠনগুলো ভুমিকা ছিল একেবারেই মৌনী ঋষিদের মতো। এ ব্যাপারে যেমন সঠিক কোন জবাব কারও কাছ থেকে পাওয়া যায়নি ঠিক তেমনি সামনে এসব অনিয়মের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না- সেই আশ্বাসও মেলেনি। কাজেই তাদের এই নিরবতা আমাদের চলচ্চিত্রকে আরও কতটুকু ক্ষতির সম্মুখীন করে সেটাই এখন সবচেয়ে আশংকার বিষয়।
সবমিলিয়ে সার্বিকভাবে দেখতে গেলে গেল বছরটি দেশীয় চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য ভালো ছিল না কোনভাবেই। তবুও সেই হতাশাকে পেছনে ফেলে ২০১৬ হবে নতুন প্রত্যাশার, ঘুরে দাঁড়ানোর মঞ্চ এটাই প্রত্যাশা সবার। এরইমধ্যে বেশ ক’জন নতুন নির্মাতা মৌলিক গল্প ও নির্মাণের মুন্সিয়ানা দিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ঢালিউডকে। তাদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন মোহাম্মাদ মোস্তফা কামল রাজ, বুলবুল বিশ্বাস, সৈকত নাসির, হাসিবুর রেজা কল্লোল, রফিক শিকদার। পাশাপাশি প্রিয়দর্শিনী মৌসুমীকে নিয়ে ‘রাত্রির যাত্রী’ ছবি নির্মাণ করে আলোচনায় রয়েছে হাবিবুল ইসলাম হাবিব। আশা করা হচ্ছে এই ছবিটি দর্শক হলে টানবে। একইভাবে দীপঙ্কর সেনগুপ্ত দীপন বছরের শুরুতেই ঢাকাই ছবিকে নতুন আশায় বুক বাঁধিয়েছেন ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবির মহরত ঘোষণা করে। বাংলাদেশ পুলিশের সহযোগীতায় এই ছবিটিতে তিনি ছবির জন্য কাস্ট করেছেন ঢালিউডের শীর্ষ নায়িকা মাহিকে। তার সাথে আরো রয়েছেন আরিফিন শুভ, নওশাবা প্রমুখ।
তবে আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য নতুন বছরের সেরা উপহার হতে যাচ্ছে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ছবিটি। মেহের আফরোজ শাওনের পরিচালনায় ইমপ্রেসের এই প্রেমের ছবিতে অভিনয় করছেন রিয়াজ, মাহি, ফেরদৌস, তানিয়া প্রমুখ। এই ছবি দিয়েই প্রথমবারের মতো জুটি বাঁধলেন ঢাকাই ছবির দুই প্রজন্মের দুই তারকা রিয়াজ ও মাহি।
লেখক : সম্পাদক
Binodon24.com
এলএ