সিনেমার জন্য সবচেয়ে জরুরি দর্শকের সাপোর্ট: রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত
নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি টিস স্কুল অব দ্য আর্টস থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। স্নাতক সম্পন্ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে।
আইবিএ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ব্যবধান মাত্র একটি দেয়াল। ক্লাশ শেষ হলেই সেই দেয়াল টপকে তিনি চারুকলায় এসে সময় কাটাতেন। মনে হতো অন্য একটা জগত। যেখানে সবাই সৃষ্টিকর্মে মত্ত। সেখানেই দেখলেন একটা ‘ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স’- এর পোস্টার।
ভর্তি হয়ে গেলেন। কোর্সের পরই মাথায় ঢুকে গেল সিনেমার পোকা।’ আইবিএতে পড়ার সময় নির্মাণ করেছিলেন ‘সিটি লাইফ’ নামে একটি ডকু-ফিকশন। যার বদৌলতে ডাক পান বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বার্লিনেল ট্যালেন্ট ক্যাম্পাসে। এবার রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত নির্মাণ করেছেন তার প্রথম সিনেমা ‘নোনা জলের কাব্য’। ছবিটি ইতোমধ্যেই লন্ডন, বুসান ও কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। এ ছাড়াও, চলচ্চিত্র উৎসবের গণ্ডি পেরিয়ে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬ চলাকালে ৮ নভেম্বর স্কটল্যান্ডে আইম্যাক্স থিয়েটারে দেখানো হয় বাংলাদেশের এই চলচ্চিত্র।
২৬ নভেম্বর বাংলাদেশের ১০টি হলে মুক্তি পেয়েছে সিনেমাটি। সেই সিনেমার আদ্যোপান্ত নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হলেন পরিচালক। লিখেছেন লিমন আহমেদ
জাগো নিউজ : আপনার প্রথম সিনেমা ‘নোনা জলের কাব্য’ নিয়ে কেমন সাড়া পাচ্ছেন বা আপনার সন্তুষ্টি কতটুকু?
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত : ছবিটি ২৬ তারিখ মুক্তি পেয়েছে ১০টি হলে। আরও অনেক বেশি হলে ছবিটি দেখাতে পারলে আনন্দ পেতাম। কিন্তু সিনেমার সাম্প্রতিক চালচিত্র অনেকটাই নেতিবাচক। তার ভিড়েও একজন নতুন পরিচালক হিসেবে আমি আশাবাদী। ছবিটি অনেকে দেখছেন। তারা একে অন্যকে বলছেন। সিনেমার মার্কেটিং বা সাফল্যের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা খুব ইতিবাচক। ভালো বানিয়েছি কিনা সেটা জানিনা, অনেকে সিনেমাটি দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন, অন্যদেরকে উৎসাহিত করছেন।
জাগো নিউজ : সমাজের একটি দরিদ্র সম্প্রদায়কে ঘিরে ছবির গল্প। এর ভাবনাটা কি করে এলো?
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত : ইলিশ ধরা জেলেদের জীবনের গল্প নিয়ে ছবিটি তৈরি করেছি আমি। ২০০৮ সালে প্রথম আমি পটুয়াখালীর কুয়াকাটার জেলে পল্লীতে যাই। তখন আমার ২২ বছর বয়স। সিডরের পর জেলেদের জীবনের কত ক্ষতি হয়েছিলো সেগুলো দেখেছিলাম। তাদের সংগ্রাম দেখেছিলাম। সিডরের ধ্বংসযজ্ঞ কাটিয়ে নতুন নৌকা বানাচ্ছে তারা। নতুন করে ইলিশ ধরতে যাচ্ছে। মানে জীবনে ফেরার প্রাণান্ত চেষ্টা। সেই বিষয়গুলো আমার মনকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিলো। পরে যখন ফিকশন বানাবো বলে স্ক্রিপ্ট লিখতে শুরু করলাম জেলেদের জীবনযাপনটা আমাকে প্রভাবিত করে ফেললো। মনে হলো এখানে জীবন আছে, চরিত্র আছে। যা অনেক পরিসরে ভাবনার জায়গা তৈরি করে। সিনেমায় আসার মতো রসদ আছে। তাই এই গল্পটা বেছে নেয়া।
পরে আবার ২০১৫ সালে আমি জেলেদের কাছে গিয়েছে। আরও অনেক নতুন কিছু দেখেছি, মনে মনে সংগ্রহ করেছি। সেগুলো নিয়েই গড়ে ওঠেছে ‘নোনা জলের কাব্য’। আরও একটা ব্যাপার হলো আমি সিনেমা বানাবো বলে যখন জেলেপল্লীতে গেলাম, তাদের সঙ্গে কথা বললাম তারা খুব চমৎকারভাবে আমাকে গ্রহণ করলেন। নানাভাবে সহযোগিতা করতে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাই আমি প্রথমে সিনেমাটি তাদেরকেই দেখিয়েছি।
জাগো নিউজ : ছবির যে প্রধান চরিত্র রুদ্র, তার সঙ্গে ছবির পরিচালক, চিত্রনাট্যকার সুমিতের ব্যক্তিগত কোনো সংযোগ রয়েছে? বা কোনো ছায়া?
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত : ভালো প্রশ্ন করেছেন। এটা বলাই যায়। আমি যেভাবে জেলেদের জীবন দেখেছি, তাদের সংগ্রাম দেখেছি, আনন্দ-বেদনাগুলো দেখেছি, তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো দেখেছি তাই তুলে আনতে চেষ্টা করেছি সিনেমা। আর এই চেষ্টায় রুদ্র আমারই মতো কেউ। তবে শুধু রুদ্র নয়, ছবির টুনি চরিত্রটিতেও আমার কিছু ছায়া আছে হয়তো। বাশার চরিত্রে।
জাগো নিউজ : এই ছবিটার মধ্য দিয়ে আপনি কাদের উদ্দেশ্যে কী বার্তা দিতে চেয়েছেন?
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত : আমরা আড়াই বছর আগে পটুয়াখালীর কুয়াকাটার জেলে পল্লীতে গিয়েছিলাম সিনেমাটির প্রস্তুতি হিসেবে। তখন সেখানে ২০ ঘর জেলে ছিলো। তারা খুব খুশি হয়েছিলো আমাদের দেখে। নিজেরা এগিয়ে এসে আমাদের সেট তৈরি করে দিয়েছে। ঘর বানিয়েছে, জেলেদের ঘরের ভেতরে যা থাকে সেভাবে সব করে দিয়েছে। মানে খুবই সহযোগিতা করেছিলো তারা। দুঃখের ব্যাপার হলো ওই জেলে পল্লীটা আর এখন নেই। সমুদ্রে মিশে গেছে।
আমাদের সিনেমায় আমরা যে করুণ বাস্তবতা দেখিয়েছি জেলেদের জীবনের বাস্তবতা আসলে তারচেয়েও কঠিন। সেই কঠিন বাস্তবতার বার্তা আমরা শহরের মানুষের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছি।
আমরা সবাই জানি নদী-সমুদ্রের কাছে জেলে পল্লী হারিয়ে যায়। এটা বেদনার। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করি ক’জন। এই হারিয়ে যাওয়াটা জেলেদের সন্তান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কতটা বেদনার, হতাশার। এমনিতেই ওরা স্কুল-কলেজের শিক্ষা পায় না। একটু বড় হলেই কাজে নেমে পড়তে হয় পরিবারকে দাদনের দেনার দায় থেকে বাঁচিয়ে রাখতে। তার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়ে প্রতিনিয়ত ক্ষতির মুখে পড়তে হয়।
‘নোনা জলের কাব্য’ আপনারা জানেন যে দেশে বিদেশে অনেক উৎসবে সমাদৃত হয়েছে। সবাই প্রান্তিক মানুষগুলোর কঠিন বাস্তবতার গল্পটা জানতে পারছে, তাদের নিয়ে ভাবনা তৈরি হচ্ছে। তাদের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসার জায়গা থেকে নানা রকম পলিসি তৈরি হচ্ছে। আমি এটাই চেয়েছি। সবাইকে জেলেদের সম্পর্কে জানাতে চেয়েছি।
জাগো নিউজ : যে ধরনের সিনেমা নোনা জলের কাব্য, সে ধরনের দর্শক বা চাহিদা এদেশে কম। সেদিক থেকে ছবিটি আরও বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছাতে কি পরিকল্পনা করছেন?
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত : দেখুন, এখানে আমার আক্ষেপ আছে। সারা বছর আমরা বলি যে সিনেমা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ভালো সিনেমা নেই। কিন্তু যখন একটা ভালো চেষ্টা নিয়ে সিনেমা আসে তখন দর্শক আসে না। হলের সাড়া মেলে না। আমি বলছি না যে আমার ছবি ভালো বা বেস্ট। কিন্তু এখানে জীবন আছে, গল্প আছে, চরিত্র আছে। যা দেখলে দর্শকের মন পুলকিত হতে পারে। দর্শকের হলে আসা প্রয়োজন। সিনেমার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি দর্শকের সাপোর্ট।
‘নোনা জলের কাব্য’ উপভোগ করার মতো একটি সিনেমা। কোনো ডকুমেন্টারি নয়। অনেকেই ভেবেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের গল্পের ছবি তাহলে বোধকরি এটা ডকুমেন্টারি। মোটেও তা না। আমি যখন সিনেমাটির পরিকল্পনা করি তখন আমার কাছে মুখ্য ছিলো জেলে পল্লীর গল্প ও চরিত্রগুলো। জলবায়ুর থিম তখন ছিলো না।
হয়তো আমার সিনেমার মার্কেটিং বা প্রমোশনে ত্রুটি ছিলো। সবাইকে এই বিষয়টা পরিস্কার করে বোঝানো যায়নি। আসলে যে ধাঁচের সিনেমা আমার বাজেট ছিলো কম। ব্যালেন্স করে ছবিটি বানাতে হয়েছে। আরও প্রচার প্রমোশন হলে হয়তো ভালো হতো। এখন সবই দর্শকের উপর। যদি তারা একে অন্যকে জানান ছবিটির ব্যাপারে তাহলেই ‘নোনা জলের কাব্য’ অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাবে।
জাগো নিউজ : আগামী সপ্তাহেও কি ছবিটি চলবে?
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত : হ্যা। এই সপ্তাহে ১০টি হল পেয়েছি। আগামী সপ্তাহেও কিছু হলে ছবিটি দেখা যাবে।
জাগো নিউজ : নতুন কোনো চলচ্চিত্রের পরিকল্পনা করছেন কি?
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত : সেভাবে বিস্তারিত উল্লেখ করার মতো সময় এখনো আসেনি। তবে এটুকু বলা যায় একটা সাইন্স ফিকশন নিয়ে ভাবছি। ভার্চুয়াল কিছু বিষয়াদি থাকবে এ সিনেমায়।
জাগো নিউজ : একটা ভিন্ন রকম প্রশ্ন করতে চাই। আপনার বাবা মন্ত্রী। আপনি চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে মন্ত্রীর পুত্র হিসেবে অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিলো? বাড়তি কোনো সুবিধা বা বিড়ম্বনা?
রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত : আমি আসলে এই বিষয়টাই এড়িয়ে যেতে চাই। আমার একটা পরিবার আছে, সেখানে আমার পরিচয় আছে। কিন্তু সেটাই আমি নই। আমি মানে আমি। ব্যক্তি রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত। আমি সবসময় পারিবারিক পরিচয়টা এড়িয়ে চলি। যারা আমাকে চেনেন তারা সেটা খুব ভালো জানেন। এই পরিচয়টার চেয়ে আপনি বলুন যে আমি নটরডেমে পড়েছি, আইবিএর ছাত্র ছিলাম এখন সিনেমা বানাচ্ছি; এটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তবুও পারিবারিক পরিচয় তো প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটা নতুন পরিচালক হিসেবে অনেক সম্ভাবনার তৈরি করে। আবার বিড়ম্বনাও অনেক।
তাই এসব বাদ দিয়ে ফিল্ম মেকার হিসেবে আমি বেশি মনযোগী। দেখুন, আইবিএ শেষ করে খুব ভালো একটি চাকরি করছিলাম। কিন্তু ফিল্মমেকার হওয়ার ইচ্ছেটা এতো প্রবল যে চাকরিটা ছেড়ে এদিকে ফোকাস দেয়ার চেষ্টা করছি। সবসময় চেষ্টা করেছি সিনেমার আশেপাশে থাকার। সিনেমার পরিচালক কতোটা হয়ে ওঠতে পারবো জানি না। তবে সিনেমা নিয়েই আছি।
এলএ/এএসএম