সুদিন গেছে সিনেমার, টাঙ্গাইলের ‘মালঞ্চ’ হল এখন মালিকের প্রেম
১৯৭৫ সালে ছানা মিয়া শহরের আদালত পাড়ার মিঞাবাড়ী রোডে নির্মাণ করেন টাংগাইল শহরের চতুর্থ সিনেমা হল ‘মালঞ্চ’। সেই সময় থেকে হলে চাকরি করতেন জাহিদুর রহমান। তিনিই এই হলের মালিক বর্তমানে।
তার সঙ্গে কথা হয় সিনেমা ব্যবসা নিয়ে। কেমন চলে আজকাল সিনেমা? ব্যবসা করে কতটুকু লাভবান তিনি?
জানতে গিয়ে জানা গেল হল ব্যবসার করুণ গল্প। এক সময় যে হলটি চলতো ২৫জন কর্মচারী দিয়ে সেখানে এএখন কাজ করেন মাত্র ৫ জন। সিনেমার ব্যবসা নেই, কর্মচারীর বেতন আসবে কি করে?
জাহিদুর রহমান বলেন, ‘খুব খারাপ অবস্থা। কি যে সমস্যা কিছুই বুঝি না। কোনো সিনেমাই চলে না। যতোই প্রচার প্রচারণা করি তবুও দর্শক হলে আসে না। শুনি যে কলকাতার তারকাদের সিনেমা নাকি খুব দেখে লোকে। তাই ওপার বাংলার সিনেমা চালাই, দর্শক আসে না। হল ফাঁকা পড়ে থাকে।’
তিনি জানান, স্বাধীনতার পরপর সিনেমার একদম রমরমা অবস্থা ছিলো দেশে। ‘মালঞ্চ’ হলের সুনাম ছিলো খুব। নারী পুরুষ নানা বয়সের দর্শক ভিড় করতেন রোজ রোজ। একটা উৎসব ব্যাপার ছিলো। ঈদ-পূজা তো ছিলোই, বিয়ে বাড়ি থেকেও দলে দলে লোক আসতো। নতুন জামাই নতুন বউকে নিয়ে আসতো সিনেমা দেখাতে। সেইসব দিন আর নেই।
‘সিনেমার সোনালি দিনে জমজমাট ছিলো হলের ব্যবসা। সেসব দেখেই তো হলে চাকরি নিয়েছিলাম। দিনে দিনে হলের প্রতি একটা প্রেম জন্মে গেছে। মালিক হয়েছি। সেই হল আছে, আমিও রয়ে গেছি। হয়তো সারা দেশে আমার মতো অনেকেই আছেন নানা হলের পুরনো লোক। কিন্তু সিনেমার সেই ব্যবসার দিন হারিয়ে গেছে’- আক্ষেপের সঙ্গে বলেন জাহিদুর রহমান।
তিনি আরও বলেন, ‘হলের প্রতি ভালোবাসা আছে বলেই এখনও আমি অন্য ব্যবসার টাকা এনে হলের পেছনে ঢালি। আগে তো নিজের মতো করে ছবি চালাতাম। এখন তো ঠিক করে দেয় জাজের ম্যানেজার। তিনি যদি বলেন যে ‘এই সিনেমা চালান’, তো আমার অফিসার সেটা এনে চালায়। এক টাকাও লাভ নাই। এক টাকাও না। দিনের পর দিন ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছি শুধু পেশাটার প্রতি নেশা ধরে গেছে বলে! অনেক বছর হলো লস দিয়ে হল চালাচ্ছি।’
হল ব্যবসার এই ধ্বসের পেছনে পরিবেশ কতোটা দায়ী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই বলে হলে পরিবেশ নাই। কিন্ত কেউ তো বলে না আগের মতো কেন ছবি নাই। ছবির মান কমেছে, সংখ্যাও কমেছে। সবাই এমনভাবে বলে যে মূল সমস্যা হলো সিনেমা হল। কিন্ত আগে তো সিনেমা, তারপর হল। যেখানে সিনেমাই নাই সেখানে হলের পরিবেশ দিয়ে কি হবে?
আগে সিনেমা হোক। আগের মতো গল্প নির্ভর, দর্শক দেখবে এমন। দর্শক ফিরলেই দেখবেন হলের পরিবেশ বদলে গেছে। ভালো ছবি বানাতে পারলে দর্শক আসে তো। মনপুরা, মনের মানুষ, আয়নাবাজি সিনেমাগুলো তার প্রমাণ। এখন তো ভালো সিনেমা কেবল প্রচার আর আওয়াজে।’
দেশের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার নায়ক শাকিব খানের তো দর্শক আছে। তার সিনেমা মুক্তি পেলে উৎসব আমেজে হলগুলোতে চলে। আপনার হলে কেমন চলে, এ প্রশ্নের জবাবে জাহিদুর রহমান বলেন, ‘এক নায়ক আর কত দেখবে মানুষ। শাকিব খানের সিনেমা দেখতে চায় না দর্শক। যা বলা হয় সব বলার জন্যই বলা। একই নায়ক, একই গল্প, একই রকম সিনেমা। কি দেখতে আসবে মানুষ টাকা খরচ করে।
মানুষের রুচি বদলেছে। মানুষ এখন অন্যরকম সিনেমা দেখতে চায়। কিন্তু অন্যরকম ভালো সিনেমাগুলো হলে চালানো হয় না। তারা বিদেশে চালাতে চায় সেসব। আমি অনেক চেষ্টা করেছি যে তারা আমার হলে ছবিগুলো দেখাতে। কিন্তু তারা যেসব শর্ত দেয় সেসব শর্ত মেনে সিনেমা চালানো যায় না। সত্যি কথা কি কেউ সিনেমার ব্যবসা বোঝে সিনেমা বানায় না। দর্শকের জন্যও বানায় না। আগের সিনেমাগুলো মুক্তি পেতো এই প্রতিযোগিতা নিয়ে যে কে কার চেয়ে বেশি হলে মুক্তি দিতে পারে? কার ছবিটা কত বেশি দর্শক দেখে। আর এখন সবাই নিজে বানিয়ে একা একাই দেখতে চান।’
তবুও স্বপ্ন দেখে মন। অনেক হতাশার বুকেও জাগে আশার চর। জাহিদুর রহমানও স্বপ্নবাদীদের দলে। আশা করেন একদিন ‘সিনেমার দিন’ বদলাবে। আবারও সোনালী আলোয়ল ঝিকমিক করে উঠবে রুপালি ভুবনের আঙিনা। তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় স্বপ্ন দেখি আবার হলের ব্যবসা আগের জায়গায় ফিরে যাবে। তার জন্য শুধু ভালো সিনেমা দরকার। যা গত এক দশক ধরে কিছু ভালো সিনেমা এসেছে। কিন্তু ধারাবাহিক না। ধারাবাহিকতা দরকার। বছরে একটা দুইটা সিনেমা দিয়ে তো হল ব্যবসা চলে না।’
গতকাল শুক্রবার (৫ নভেম্বর) থেকে ডিপজলের নতুন সিনেমা ‘এ দেশ তোমার আমার’ চলছে ‘মালঞ্চ’ হলে। হল মালিক জানান, তিনি দিন আগে থেকে ছবিটির প্রচার প্রচারণা চালিয়েছেন। কিন্ত তবুও কাল সারাদিনে দর্শক হয়েছিল পাঁচজন। আর আজ শনিবার কোনো দর্শকই নাই।
জাহিদুর রহমান বলেন, ‘সবাই বলছে এটা নতুন সিনেমা। কিন্তু নতুন কিছুই নাই। যে সিনেমাটা আমি নিজেই দেখতে চাই না সেটা হলে চালাচ্ছি লোকে দেখবে বলে। এই হলো অবস্থা’।
তিনি জানান, ‘মালঞ্চ’ হলে প্রায় দর্শক ছাড়াই প্রতিদিন চলছে ৪টি শো। এর শো চলার সময় সকাল সাড়ে ১০টা, দুপুর দেড়টা, বিকেল সাড়ে ৪টা আর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। হলে বসার জন্য রয়েছে আর স্টল, ডিসি ও আর বক্স নামের ৩টি ক্যাটাগরির আসন ব্যবস্থা। যার টিকিটের দাম যথাক্রমে ৫০, ৬০ ও আর বক্সে সিনেমা দেখতে গুনতে হয় ৭০ টাকা।
এমআই/এলএ/এমএস