বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পিএসসির আদলে নিয়োগ
দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)’র আদলে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়োগের সুপারিশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। একই সঙ্গে তারা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার নম্বর ৪০ এর পরিবর্তে ৬০ নম্বর করা ও দেশে শূন্যপদের তালিকা প্রতিমাসে বুলেটিন আকারে প্রকাশের প্রস্তাব করেছেন।
বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ ও প্রত্যয়ন বিধিমালা-২০০৬ এর সাম্প্রতিক সংশোধনের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে মতবিনিময় সভায় শিক্ষাবিদ, প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ এমন মত দেন।
সভায় শিক্ষাসংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এবং সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমিন বলেন, শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে বার বার ওঠে আসে দুর্নীতি। পরিচালনা পরিষদের নির্বাচন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো হয়ে যায়। যারা সদস্য নির্বাচিত হন তারা যদি একজন অষ্টম শ্রেণি বা এসএসসি পাস করা ব্যক্তি থাকেন তাহলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চলবে কী করে।
তিনি আরো বলেন, ম্যানিজিং কমিটির পরিচালায় পরিবর্তন করা উচিত। আমাদের মূল বক্তব্য মেধাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। ছাত্র ৩৩ পেলে পাস করবে আর শিক্ষক হওয়ার জন্য ৪০ নম্বর পাবেন তা না করে শিক্ষকের পাস নম্বর দ্বিগুন করুন।
এছাড়া ইউনিয়ন ভিত্তিক মেধা অনুযায়ী শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পিএসসির অনুরূপ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে। আমাদের শিক্ষানীতিরই বাস্তবায়ন এটি। এতে সকল শিক্ষাবিদরা খুশি হয়েছেন।
তিনি বলেন, আমরা এ জন্য একটি নীতিমালা করেছি তাতে কোনো ভুল ত্রুটি আছে কি না তা দেখার জন্য শিক্ষাবিদ, প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও পরিচালনা কমিটির সদস্যদের নিয়ে এ সভা ডাকা হয়েছে। আপনারা লিখিতভাবে মতামত দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করবেন।
অধ্যাপক এনামুল হক বলেন, নিবন্ধন পরীক্ষায় ৪০ নম্বর থেকে বাড়িয়ে ৬০/৭০ করতে হবে। কোন জেলায় কতগুলো পদ খালি আছে তা মাসিক বুলেটিন আকারে প্রকাশ করতে হবে।
নিবন্ধিত ব্যক্তি নিয়োগ পাওয়ার পরে অন্তত ১৫ বছর প্রতি তিন বছর পর পর যোগ্যতা অর্জনের পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তাবও করেন তিনি।
অধ্যাপক অ্যামিরাটস আনিসুজ্জামান প্রশ্ন রেখে বলেন, আগে যারা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তাদের কী হবে?
শিক্ষানীতি বাস্তাবায়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক কাজী ফারুক আহমেদ বলেন, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধে প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি সংস্কার দরকার। রাজনৈতিক ও জন প্রতিনিধিরা হস্তক্ষেপ করেন। ম্যানেজিং কমিটিতে যারা থাকেন তাদের যোগ্যতা নির্ধারণ করাও দরকার। জন প্রতিনিধিদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের দিতে পারলে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ সম্ভব।
নীতিমালা চূড়ান্ত করার আগে সকলের মতামত নেয়া দরকার বলেও তিনি মত দেন তিনি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. হারুন অর রশিদ বলেন, শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য হচ্ছে নির্দিষ্ট সত্য। যারা সংসদ সদস্য আছেন তারা শিক্ষা নিয়ে আইন প্রণয়ন করবেন- এটাই জাতির প্রত্যাশা। কিন্তু সকল সংসদরা ৪টি প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্বে থাকেন। নিয়োগ বাণিজ্যের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে তারা দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।
তিনি আরো বলেন, নিবন্ধন পরীক্ষার পাস নম্বর ৫০ করার প্রস্তাব ও শিক্ষা জীবনে যাদের তৃতীয় শ্রেণি রয়েছে তারা যাতে নিবন্ধন পরীক্ষায় আবেদন করতে না পারে এটা যুক্ত করা উচিত। শিক্ষকের উচ্চ শিক্ষার যোগ্যতার ভিত্তিতে পদন্নোতি চালুর প্রস্তাব করেন তিনি।
অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, ছেলে-মেয়েদের ভালো শিক্ষার জন্য ভালো শিক্ষক দরকার। এই আইন সংশোধনের মাধ্যমে ভালো শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি বন্ধের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতি হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খন্দকার সিদ্দিকী বলেন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি ভালো পরীক্ষা নেয়ার জন্য পাস নম্বর বাড়ানো দরকার। ভালো ভাবে লিখিত পরীক্ষা নিতে পারলে মৌখিক পরীক্ষার দরকার নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে একই মানের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। শুধু বিষয়গত পরীক্ষা না নিয়ে পেশার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আছে কী না তা যাছাই করা উচিত।
সালমা নাসির উদ্দিন মেমোরিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গর্ভিনিং বডির সভাতি মো. অলিউল্লাহ মন্ডল বলেন, ৪০ শতাংশ নিয়োগে দুর্নীতি হয়। আর এ দুর্নীতি হয় শিক্ষা বিভাগের সদস্যদের মাধ্যমে। কোনো অবস্থাতেই এ নিয়মের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীত বন্ধ করা যাবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ বলেন, সারাদেশে ৭৪৫টি সরকারি ও ২৮ হাজার ৩৮৩টি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিবছর ৮ হাজার ২৫০ কোটি টাকার খরচ করতে হয় এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পেছনে।
প্রস্তাবিত নিবন্ধন নীতমালা উপস্থাপনায় বলেন, এনটিআরসি একটি বিষয় ভিত্তিক পরীক্ষা নেয়। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি নিয়োগ দেয়। এনটিআরসি দুই বিষয়ে পরীক্ষা নেয় আবশ্যিক ও বিষয় ভিত্তিক। এ পর্যন্ত ৪০ নম্বর পেয়েই প্রায় পৌনে ৬ লাখ পাস করেছেন। এর মধ্যে ৬৪ হাজার ৬২২ জন চাকরি চেয়েছেন। এখানে মেধা তালিকা করা হয়নি।
তিনি আরো বলেন, প্রতি বছর মেধা ভিত্তিক শূন্যপদের ভিত্তিতে নিয়োগ হবে। প্রতিবছর ৩১ অক্টোবরের মধ্যে জেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে শুন্য পদের বিবরণ এনটিআরসিতে পাঠাবে। এখন থেকে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেয় হবে।
সনদের মেয়াদ থাকবে তিন বছর। সে আলোকে এনটিআরসি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধা তালিকা অনুযায়ী তালিকা প্রকাশ করে উপজেলা মেধা তালিকা নিয়োগের অগ্রাধিকার পাবে। এরপর জেলা বিভাগ ও জাতীয় মেধা তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ পাবেন বলেও জানান তিনি।
সভায় অন্যান্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন- শিক্ষাসচিব মো. সোহরাব হোসেন, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যামিরেটাস অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ, অধ্যাপক একরামুল কবির, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন, দক্ষিণখান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সভাপতি তোফাজ্জেল হোসেন, প্রধান শিক্ষক মো. ইদ্রিস আলী প্রমুখ।
এনএম/আরএস