চলচ্চিত্রে অনেক সংকট, নির্মাণের পরাধীনতা আরও ভয়াবহ : রিজু
‘বাপজানের বায়স্কোপ’। বলা যেতে পারে গেল দশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার তালিকায় দুর্দান্ত এক সংযোজন। এই ছবিটি মুক্তি পায় ২০১৫ সালে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বাজিমাত করে ছবিটি। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট আটটি বিভাগে সেরার পুরস্কার ঘরে জেতে। এই সিনেমা দিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা বানিয়েই রিয়াজুল রিজু শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার পান। উপমহাদেশে সর্বকনিষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন তিনি। সঙ্গত কারণেই তার কাছে প্রত্যাশা ছিলো প্রচুর। কিন্তু কেটে গেছে প্রায় ৬ বছর। মেধা ও পরিচিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার নামটি ঠিক সেভাবে উচ্চারিত হয়নি সিনেমার আঙিনায়।
পরিচালকের মতে, একটি ভালো চলচ্চিত্রের জন্য সময় নিতে হয়, অনেক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সেই সংগ্রামের সময় পার করছেন রিজু। গীতিকবি, কবি, সাংবাদিক ও সমাজ সংস্কারক কাঙ্গাল হরিনাথের বায়োপিক নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। ছবির নাম ‘কাঙাল’। নন্দিত চিত্রনাট্যকার মাসুম রেজার সঙ্গে যৌথভাবে চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন রিজু। সেটি ২০১৮ সালে জমা দিয়েছিলেন সরকারি অনুদানের জন্য। এরপর টানা তিন বছর জমা দিয়েছেন। অনুদান মেলেনে ‘কাঙাল’র ভাগ্যে।
এই নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে এক আড্ডায় মুখরতি হয়েছেন রিয়াজুল রিজু। জানিয়েছেন তার চলচ্চিত্র ভাবনা, চলচ্চিত্রের নানা সংকট ও সমাধানের কথা। লিখেছেন লিমন আহমেদ
জাগো নিউজ : তিন তিনবার সরকারি অনুদানের জন্য চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য জমা দিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। এ বিষয়ে ফেসবুকে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কোনো রেসপন্স কি পেয়েছেন?
রিজু : না। আমি রেসপন্সের আশাও করিনি। কেবলমাত্র নিজের আত্মবিশ্বাসটাকে চাঙ্গা রাখতে এবং এই ব্যর্থতাকে আগামীর সাফল্যের সাক্ষী রাখতে স্ট্যাটাসটি দিয়েছি। এটি চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত অনেকের নজরে এসেছে। অনেকে আমাকে সাহস দিয়েছেন। এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। ‘কাঙাল’ সিনেমাটি নির্মিত হোক এটা তারা চাইছেন। আমার জন্য এটা শক্তির, প্রেরণার।
জাগো নিউজ : এমন গুরুত্বপূর্ণ ও তথ্যবহুল একটি সিনেমা অনুদানে কেন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করেন আপনি?
রিজু : এটা জানার সুযোগ তো আসলে নেই। ছবি অনুদানের জন্য জমা দেয়া হয়। সিলেক্ট হলেও জানা যায় না কেন সিলেক্ট হলো। রিজেক্ট হলেও সেটা জানা যায় না। ভালো হতো জানতে পারলে। এতে করে নির্মাতারা ধারণা পেতেন কি কি বিষয় থাকলে রাষ্ট্রীয় অনুদান পাওয়া যায়। কোন কোন ব্যাপারগুলো ত্যাগ করা দরকার।
জাগো নিউজ : তো এটা বলুন, সরকারি অনুদানের জন্য আপনার সিনেমাটিকে কেন যোগ্য মনে করেন?
রিজু : এমনিতে আমরা ধারণা করি, দেশ ও দেশের ইতিহাস, কৃষ্টি-কালচার, মানুষকে গর্বিত করে, ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে এমন বিষয় নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করলে অনুদান মেলে। সেইদিক থেকে কিন্তু কাঙাল হরিনাথ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। তিনি শুধু বাংলাদেশেরই নন, এই উপমহাদেশের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কোনো বিতর্ক নেই। তার জীবন পুরোটাই সবার জন্য আদর্শ। বিশেষ করে এই উপমহাদেশে সাংবাদিকতার পথিকৃত তিনি। তার জীবন একজন দার্শনিকের, একজন বিপ্লবীর, একজন সমাজ সংস্কারকের।
আমরা বই বা নানা পরীক্ষার প্রশ্নে তার নামটি শুনি। কিন্তু তার সম্পর্কে কতজন জানি। আমি একজন সংবাদকর্মী ছিলাম। তারপর নির্মাণে এসেছি। আমি কাঙাল হরিনাথকে চর্চা করেছি এবং অবাক হয়েছি তার জীবনী পড়ে। আমার মনে হয়েছে তিনি সমাজের একজন সত্যিকারের আইকন। তাকে জানা ও ধারণ করা আমাদের কর্তব্য। শুধু কাঙাল হরিনাথ নয়, আমি মনে করি যাদের হাত ধরে আমাদের সভ্যতা, ইতিহাস, অর্জন আজ এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেইসব ব্যক্তিদের বায়োপিক আজকের এই অস্থির সময়ে নিয়মিত হওয়া জরুরি। এতে করে বিনোদনের পাশাপাশি তথ্য ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে। যা প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করবে। আরও অনেক কাঙাল হারিনাথের মতো দার্শনিক, সমাজ সংস্কারক, ন্যায়ের পক্ষে সাহসী বিপ্লবী, উদ্ভাবনী ক্ষমতার মানুষের জন্ম হবে।
আমরা আমাদের সতিক্যারের ক’জন হিরোকে সবার সামনে তুলে ধরতে পেরেছি? পারিনি কিন্তু। পৃথিবীর সকল ইন্ডাস্ট্রিতেই সিনেমার মাধ্যমে কিন্তু এটা করা হয়। প্রচুর বায়োপিক দেখি আমরা। যেগুলো অনেক হতাশাকে কাটিয়ে তুলে। সেগুলো প্রেরণা ও শক্তি যুগিয়ে অনেক জাতিকেই এগিয়ে নিয়েছে। এসব ভাবনা থেকেই আমি ভেবেছিলাম ‘কাঙাল’ সিনেমার পাশে পাবো রাষ্ট্রকে।
জাগো নিউজ : এমন তো হতেই পারে আপনার গল্পের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোকে অনুদান দেয়া হয়েছে?
রিজু : হতেই পারে। যারা অনুদান পেয়েছেন গেল কয়েক বছরে তারা কোনো না কোনো যোগ্যতা নিয়েই পান। আপনি সমালোচনা করেও যদি কিছু বলেন সেটাও যোগ্যতা। ওই যোগ্যতাটুকু আমার নেই বলে আমি পাইনি বা আরও অনেকে পায়নি। তবে কথা হলো কী, যারা অনুদানের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সিনেমার গল্পগুলো কেমন সেটা কিন্তু আমরা সবাই জানতে পারছি নানা নিউজে বা আড্ডায়। সেখান থেকে আপনি খুব সহজেই তুলনা করতে পারবেন অনুদান পাওয়া আর না পাওয়ার ছবিগুলোর মধ্যে কার যোগ্যতা বেশি। বা অনুদান সঠিকভাবে সঠিকজনকে সঠিক সিনেমার জন্য দেয়া হয়েছে কিনা।
আমি জানিনা যারা অনুদানের সঙ্গে জড়িত থাাকেন তারা আসলে অনুদানের জন্য কোন বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেন। আমি দাবিদার ছিলাম অনুদানের। একজন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারজয়ী নির্মাতাকে বিবেচনা করা উচিত। রাষ্ট্র তো আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেটার উপর কি তাদের আস্থা নেই?
জাগো নিউজ : আপনি হয়তো এভাবে দেখছেন। এমন কী হতে পারে না যে রাষ্ট্র নতুন কাউকে সুযোগ দিতে চায়। আপনি মেধা ও গুণ দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। চাইলে অনুদানের বাইরেও সিনেমা বানাতে পারবেন। একজন নতুন নির্মাতা হয়তো সেটা পারবেন না?
রিজু : হতেই পারে। কিন্তু এই লজিকে গেলেও দেখবেন যারা পেয়েছেন তারা আমার চেয়েও প্রতিষ্ঠিত এবং সিনিয়র মানুষ। আর যোগ্যতা বা মেধায় নতুন পুরনো পার্থক্য করার আমি কিছু দেখি না। একজন যদি যোগ্যতা রাখেন তবে তাকে টানা দশবার অনুদান দিতে দোষ কোথায়। রাষ্ট্রের তো উচিত যে ভালো কাজ করছে তাকে প্রমোট করা। যে রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করবে, রাষ্ট্রকে মর্যাদা ও অর্জনে গর্বিত করবে তার পাশে থাকা। সেটা নতুন কেউ হতে পারে, পুরনোও হতে পারে। এখানে আসলে ভাবনার অনেক সুযোগ আছে।
যেমন ধরেন ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবিটি কানে গেল। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে কোনো সিনেমা অফিসিয়ালি আমন্ত্রণ পেল এবং অংশ নিলো। রাষ্ট্রকে তো দেখিনি এই অর্জনের জন্য ছবিটির পরিচালক বা কলাকুশলীদের অভিনন্দিত করতে। সিনেমার কোনো সংগঠনও কোনো আয়োজন করেনি। হয়তো প্রচার বা অনেক কারণেই ছবি ও তার টিম দেশকে, দেশের মানুষকে খুব একটা রিলেট করতে পারেনি, তবুও যা কিছু হয়েছে সবটুকুই তো অর্জন। সেই স্বীকৃতি দিয়ে তাদের ভুলটা ধরিয়ে দেয়া যেত। সাদ, বাঁধনরা সেদিক থেকে কি কিছু পেয়েছে। তারা তো সামগ্রিকভাবে আমাদের সিনেমার জন্য আনন্দ নিয়ে এসেছে।
জাগো নিউজ : অনুদান না পেলে কি ‘কাঙাল’ ছবিটি বানাবেন না?
রিজু : এই সিনেমাটি বলতে পারেন আমার সারা জীবনের স্বপ্ন। অনেক গবেষণা ও পড়াশোনা করতে হয়েছে আমাকে। অনেক বই যোগার করতে হয়েছে যেগুলো রেয়ার। অনেকের কাছে যেতে হয়েছে কাঙাল হরিনাথকে জানতে, তার সময়টাকে বুঝতে। এত পরিশ্রম করে আমি নিজেকে তৈরি করেছি। প্রস্তুত হয়েছি। থেমে যাবার জন্য তো নয়।
তবে সরকারি অনুদানটা পেলে অনেক বেশি এগিয়ে থাকতে পারতাম। কারণ এই ধরনের বায়োপিক নির্মাণে অনেক খরচ। প্রায় দেড়শত বছর আগের সময়টাকে ফ্রেমে তুলে আনতে হবে। সেই সময়ের পোশাক, পরিবেশ; অনেক ব্যাপার আছে আসলে। এগুলোর জন্য সেভাবে অর্থের যোগান দরকার।
চলচ্চিত্রটির গল্পে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে। যেমন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিপ্লবী ঈশান রায়, লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মীর মোশাররফ হোসেনের মতো বিখ্যাত ব্যক্তি। এসব চরিত্র অনুযায়ী অভিনয়শিল্পী বাছাই করারও একটা ব্যাপার আছে। সরকার পাশে থাকলে আমি বাকিটা চেষ্টা করতাম। এখন অনুদান ছাড়া বানাতে গেলে পুরো বিষয়টার ঝুঁকি আমাকে নিতে হবে।
ছুটতে হবে কারো কাছে। সেই সাহসও পাই না। সিনেমার বর্তমান বাজার ও ব্যবস্থাপনার নাজুক অবস্থা। জীবনের প্রথম সিনেমাটি বানিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করে। বাপের জমি বিক্রি করে স্বপ্ন পূরণ করেছি। রাষ্ট্র পুরস্কৃত করেছে, স্বীকৃতি দিয়েছে এটুকুই শান্তি। ছবিটি তো মানুষকে দেখাতে পারিনি সিস্টেমের মারপ্যাঁচে পড়ে। অর্থনৈতিকভাবে তো আমাকে চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছে। সেটা অল্প বাজেটের ছবি ছিলো। চ্যালেঞ্জ ছোট। ‘কাঙাল’র চ্যালেঞ্জটা তো বড়।
জাগো নিউজ : সিনেমার বাজার ও ব্যবস্থাপনার অবস্থা নাজুক, আপনার দাবি। নিশ্চয়ই এটি অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন। এই নাজুক অবস্থা কাটিয়ে উঠার উপায় নেই?
রিজু : কেন থাকবে না। অবশ্যই আছে। পৃথিবীতে এমন কোনো সমস্যা নেই যার সমাধান মানুষ বের করতে পারেনি। সে স্রষ্ঠার সেরা সৃষ্টি। দেখুন, করোনাভাইরাসকেও জয় করেছে মানুষ। টিকা এসেছে। আর এটা তো একটা ছোট্ট দেশের ছোট্ট সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা। সমাধানগুলোও এখানে স্পষ্ট। সবাই জানি। প্রতিদিনই কেউ না কেউ বলছি, ভাবছি। কিন্তু বাস্তবায়নটা হচ্ছে না।
বাংলাদেশে সিনেমার ষাট বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ এখানে একটা বক্স অফিস গড়ে উঠেনি। আমি মনে করি বক্স অফিসটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি। এটি তৈরি করতে পারলে সিনেমার সব সমস্যাই কেটে যাবে। কারণ যখন আপনি বক্স অফিস করতে যাবেন তখন আপনাকে সিস্টেমে আসতে হবে। সেই সিস্টেমের জন্য আপনাকে হল ঠিক করতে হবে, সবগুলো হলকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। ই-টিকিটিং হতে পারে সেই ব্যবস্থা।
যা নিয়ে গেল কয়েক বছর ধরে খুব কথা হচ্ছে। অনেক ঘোষণাও এসেছে। কিন্তু সবকিছু নির্বাচনী এজেন্ডা হিসেবেই থেকে গেল। চলচ্চিত্রের নানা সংগঠনগুলোও নির্বাচনের ইশতেহারে লিখেই খালাস। কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি, হচ্ছে না। অনেক সিনেপ্লেক্সের ঘোষণা দেখেছি আমরা। সরকার দিয়েছে, চলচ্চিত্রের কয়েকজন দিয়েছেন। খুব প্রচারণা হয়েছে সেসব নিয়ে। কিন্তু একটা সিনেপ্লেক্সের একটা ইটও গাঁথা হয়নি কোথাও। বাজার নাজুক না হয়ে উপায় কি।
আপনি সিনেমা হল বাড়ান, হলের পরিবেশ ভালো করুন। সার্ভার সেট করে ই-টিকিটিং সিস্টেম চালু করে দিন। ইন্ডাস্ট্রি অবশ্যই বড় বাজারে পরিণত হবে। শৃঙ্খলা আসবে চলচ্চিত্রের ব্যবসায়ে। লোকে এখানে টাকা এখানে লগ্নি করার সাহস পাবে। সবখোনেই লোকসান থাকে। কিন্তু একজন ব্যবসায়ীকে তো জানতে হবে যে কেন তিনি লোকসানে পড়লেন। আমাদের সিনেমায় এটাও জানা যায় না যে ঠিক কি কারণে লোকসান হলো। চোখে দেখা যাচ্ছে সব ভালো, কিন্তু রেজাল্ট আসে মন্দ। কেমন যেন একটা গোলকধাঁধা সেট করা এখানে।
দেখুন, চলচ্চিত্র একটি শিল্প। ভারত এই চলচ্চিত্র দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করছে। আমরাও তো সেই চেষ্টাটা করতে পারি। আমাদের ছোট দেশ, হাজার কোটি না হলেও মোটা অংকের টাকা আসবে। সেটা অন্য যে কোনো শিল্পের চেয়ে কম হবে না। কথা হলো সিস্টেমে আসতে হবে। দুর্নীতিবাজ লোকদের দায়িত্ব দেয়া যাবে না। ‘গপ্পোবাজ’ অহংকারী সিনিয়র চলচ্চিত্রের মানুষদের এড়িয়ে যোগ্য, সৎ, তারুণ্যে উদ্যমী লোকদের দায়িত্ব দিলে দ্রুতই সব হবে।
সিনেমার এই সিস্টেম ঠিক করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর উপর দেয়া হোক, দেখবেন কত দ্রুত হয় সবকিছু। আমাদের দেশে তারা সবকিছু খুব দ্রুত এবং কার্যকরীভাবে করতে পারে। অনেক দৃষ্টান্তই আছে। হাতিরঝিল প্রজেক্ট সাম্প্রতিককালে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই যে বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটি হচ্ছে আমি মনে করি সেটার দায়িত্বও সেনাবাহিনীর উপর থাকা উচিত। তারা চলচ্চিত্রের যোগ্য কিছু মানুষকে নিয়ে একটা টিম করে এর দায়িত্ব নিলে বঙ্গবন্ধু ফিল্ম সিটির সত্যিকারের সাফল্য পাবে। এবং দ্রুতই আসবে।
জাগো নিউজ : আপনি তো প্রথম সিনেমা দিয়েই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। অনুদান, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে প্রতিবছরই নানা রকম সমালোচনা দেখা যায়। কথা হয় লবিং, অযোগ্যদের নির্বাচন করা নিয়ে। আপনার ভাবনায় এই যে লবিং, নানা রকম প্রভাব বিস্তার করে অনুদান-পুরস্কার পাওয়ার সমালোচনা, বিষয়গুলো কেমন?
রিজু : আমি যখন পুরস্কার পাই তখন আমি ছিলাম একেবারেই নতুন। সিনেমার পথঘাট তখনও ভালো করে চিনে উঠতে পারিনি। বুক ভরা স্বপ্ন ছিলো। নিজের সবকিছু ইনভেস্ট করে সেই স্বপ্ন পূরণ করেছি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রত্যাশার দুঃসাহস তখনও করে উঠতে পারিনি। আমি আমার বেলায় দেখেছি অনেক চমৎকার আয়োজন ছিলো। সমালোচনা তো সবখানেই হয়, সবকিছুতেই হয়।
তবে আমি একটা কথা বলতে চাই। সেটা হলো চলচ্চিত্র শিল্পকে নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন সবকিছুতে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। যেমন অনুদানের জন্য বাছাই কমিটি, পুরস্কারের জুরি বোর্ড, সেন্সর বোর্ড; সবখানেই চলচ্চিত্রের তরুণ প্রজন্মের লোকদের জায়গা পাওয়া উচিত। যারা মাঠে নিয়মিত কাজ করেন, চলমান সময়, বাজার, রুচি সম্পর্কে আপডেট এমন মানুষকে প্রয়োজন দায়িত্বে। আপনি বলুন কোন বোর্ডে আমার প্রজন্মের একজন লোক আছে যিনি বা যারা আমার রুচি, টেস্ট, চিন্তাগুলোকে বুঝতে পারবেন। আমরা দেখি কয়েকজন আমলা নিয়ন্ত্রিত বোর্ডগুলোতে আমাদের চলচ্চিত্রের কয়েকজন বরেণ্য মানুষেরা থাকেন। সেখানে আমি তো আমার নিজের প্রতিনিধিকে পাই না। আমার গোত্রকে পাচ্ছি, কিন্তু আমার কথাগুলো, ভাবনাগুলো তুলে ধরবে এমন কেউ তো সেখানে নেই।
মোর্শেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, কাজী হায়াত, মতিন রহমান, আলমগীর, রোজিনা, রিয়াজ; এই যে নামগুলো এরা আমাদের সিনেমার বটবৃক্ষের মতো। তারা বোর্ডগুলোতে থাকা মানে অনেক কিছুই সুন্দর হয়ে যাওয়া। তাদের সঙ্গে যদি তরুণদের অংশগ্রহণ থাকতো আমি মনে করি বোর্ডগুলো আরও সমৃদ্ধ হতো। আমলারা থাকবেন কারণ সিস্টেম মেইনটেইন জরুরি। সিনিয়ররাও থাকবেন তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে। কিন্তু যারা সময়টাকে ধারণ করেন, যারা মাঠে নিয়মিত তাদেরও তো রাখা উচিত। চলচ্চিত্র সাংবাদিকদের মধ্যে যারা বিষয়গুলো বোঝেন, জানেন, এগুলো নিয়ে কাজ করেন, মাঠে নিয়মিত তাদের মধ্য থেকেও প্রতিনিধি আসা উতিচ। একটা বিষয় সম্মিলিতভাবে চেষ্টা না করলে তো হয় না।
জাগো নিউজ : যেহেতু বোর্ড নিয়ে কথা হচ্ছে আমরা সেন্সর বোর্ডে নজর দিতে চাই। সম্প্রতি অনেক সমালোচনায় পড়ছে চলচ্চিত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বোর্ডটি.....
রিজু : পড়ার কারণ কি নেই? সিনেমা হলো গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় শাখা। এখানে সব চিন্তাভাবনাগুলো বড় পরিসরে উঠে আসে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে একটা বিষয় আছে যা খুব জরুরি। যখন সেই স্বাধীনতায় বাঁধা আসে তখন কিন্তু গণমাধ্যম তার যোগ্যতা হারায়, শক্তি হারায়। আমাদের চলচ্চিত্রে অনেক সংকট, কিন্তু নির্মাণের পরাধীনতা আরও ভয়াবহ রুপ ধারণ করছে।
বলা হচ্ছে চলচ্চিত্র একটি শিল্প, মেধা ও মানসিকতা বিকাশের সবচেয়ে বড় জায়গা। আবার নানা রকম শর্ত, বাঁধা দিয়ে এটাকে বন্দী রাখা হয়েছে। বিকাশটা কেমন করে হবে? শর্ত দিয়ে প্রেম ও শিল্প চর্চা হয় না। সেন্সর বোর্ডে যারা বসেন তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় বরেণ্য মানুষ, গুণী ও অভিজ্ঞ। হয়তো তারাও বুঝতে পারেন যে নানাভাবে চলচ্চিত্রের উপর শেকল পরানো হচ্ছে। কিছু করতে পারেন না। সমস্যাটা আমার মনে হয় বোর্ডে না। আইনের কাছে, আদালতের কাছে, কিছু একরোখা মানুষের কাছে তারা অসহায়।
এখন চলছে ২০২১ সাল। আমরা এ সময়ের প্রতিনিধি। অথচ আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে বৃটিশদের রেখে যাওয়া শতাধিক বছরের পুরনো আইন। এই আইনগুলোর তো সংশোধন বা পরিবর্তন আনা উচিত। অবশ্য অনেক কিছুই চেঞ্জ হচ্ছে। সিনেমা ও সংস্কৃতি নিয়ে যেসব আইন আছে সেগুলোতেও নজর দেয়া হোক। এই শতাব্দীতে এসে বলা হচ্ছে সিনেমায় সিগারেট খাওয়া দেখানো যাবে না। এটা তো মানা যায় না। সিগারেটের কারখানার লাইসেন্স আছে, লোকে যত্রতত্র সিগারট খাচ্ছে। সিগারেট আমদানি রপ্তানি হচ্ছে। আর সেটা সিনেমাতে দেখালেই দোষ? এমনিতে বিশ্বজুড়ে যে নিয়মটা মানা হয় সেটা হলো ধুমপান নিয়ে চলচ্চিত্রে অনেক সচেতন বার্তা দেয়া হয়। ধুমপানকে অনুৎসাহিত করা হয়। সে ব্যাপারে জোর দেয়া যেতে পারে। কিন্তু সিগারেট খাওয়া দেখানোই যাবে না এটা আসলে শিল্পের যুক্তিতে চলে না।
এদিকে আবার পুলিশ নিয়ে কিছু বলা যাবে না, মৌলভীরা বলছেন তাদের নিয়ে কিছু বলা যাবে না, মাস্টাররা বলছেন, আমলারা বলছেন, উকিলরা বলছেন, সাংবাদিকরা বলছেন, অনেকেই বলছেন। সবাই যদি এভাবে বলতে থাকেন নাটক-সিনেমা হবে কার জন্য? চরিত্রগুলো কি ভিনগ্রহ থেকে আনা হবে? কিছু হলেই মামলা আর রিট করে দিয়ে সিনেমা আটকে দেয়া হচ্ছে। এগুলো সিনেমা শিল্পটাকে একেবারে শেষ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের মতো একটা সংস্কৃতি প্রধান দেশে এসব মানা যায় না। আর সরকার হিসেবে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার মতো আধুনিক, উদার মানসিকতার নেতা যখন আমাদের রাষ্ট্র প্রধান তখন সিনেমা নিয়ে আমরা অনেকদূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখি।
পাশাপাশি আমলা, পুলিশ, মাস্টার, মৌলভী, ছাত্র, ব্যবসায়ীসহ দেশের সবার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে সিনেমা বাং সংস্কৃতিকে স্বাধীন হতে দিন। এর পায়ে শেকল পড়াবেন না। আপনারা দর্শক হয়ে এগুলো উপভোগ করুন। বিচারক হয়ে নয়। হ্যাঁ, একজন নাগরিক হিসেবে সচেতনতাও জরুরি। যখন দেখবেন সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের স্বার্থে আঘাত আসে কোনোকিছুতে, সেটা নিয়ে প্রতিবাদ করুন। সিনেমায় একটা পুলিশ খারাপ মানে এই না যে দেশের সব পুলিশ খারাপ। সিনেমায় একজন অফিসার দুর্নীতিবাজ মানে এই না যে দেশের সব অফিসার দুর্নীতিবাজ। সিনেমা বা নাটক বা সব সংস্কৃতিই বাস্তবতাকে নিয়ে বাঁচে। সমাজটার দিকে তাকিয়ে দেখুন। যা হচ্ছে তা সিনেমায় বলতে দোষটা কোথায়? সিনেমায় একটা খারাপ বিষয় দেখানো হয় সেটাকে ভালো করার বার্তা দেয়ার জন্য। খারাপটা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নয়। সিনেমায় ভিলেনের জয় হয় না কোনোদিন।
জাগো নিউজ : ধরে নেয়া যাক, আইন সংশোধন বা সংযোজন করে নির্মাণের পূর্ণ স্বাধীনতা আনার হলো। কিন্তু এদেশে স্বাধীনতার অপব্যবহারের অনেক দৃষ্টান্তও তো রয়েছে-
রিজু : সবখানেই কিছু মন্দ মানুষ থাকে। সেগুলো নিয়েই তো এতক্ষণ বললাম। মাস্টার-মৌলভী সবখানেই আছেন। চলচ্চিত্রেও তো সবাই সাধু নন। এখানে দুর্নীতি করা লোক আছে, স্বেচ্ছাচারী আছে। তাদের নিয়ন্ত্রণের সংগঠনও আছে। যে খারাপ, শাস্তিটা তার প্রাপ্য। তার জন্য যারা ভালো তারা বঞ্চিত হতে পারে না।
জাগো নিউজ : এখন ওটিটির জোয়ার। বিশেষ করে করোনাকালীন অনলাইন প্লাটফর্মগুলো খুবই সুবিধা করে নিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির শত শত কোটি টাকা বাজেটের সিনেমা ওটিটিতে মুক্তি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে সেই অর্থে বলতে গেলে সিনেমার প্রযোজক-নির্মাতারা ওটিটিতে ভরসা করতে পারছেন না। আপনি এ বিষয়ে কী ভাবেন?
রিজু : সময়ের সঙ্গে চলতে হবে। ওটিটি প্লাটফর্ম দিনদিন জনপ্রিয় হচ্ছে। আরও হবে। এজন্য সিনেমা হল থাকবে না ব্যাপারটা তা নয়। পরিবার-বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে বিনোদন নেয়ার আবেদন থাকবে সবসময়। ঘরে যতোই থিয়েটার থাকুক, বাইরে গিয়ে হইচই করে আনন্দ নিয়ে সিনেমা দেখার মজাই আলাদা। তাছাড়া সিনেমা হল এখনো দেশের বেশিরভাগ দর্শকের বিনোদনের জায়গা। সেটাও মাথায় রাখতে হবে।
জাগো নিউজ : পরীমনিসহ সাম্প্রতিক বিষয়গুলো চলচ্চিত্রে কীভাবে প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন? এবং আজকের এই অস্থির সময়ে চলচ্চিত্রের দায় ও ভূমিকা-কর্তব্য কতটুকু?
রিজু : এসব নিয়ে বলার মতো যোগ্য লোক হয়তো আমি নই। সিনিয়র যারা অভিজ্ঞরা আছেন তারা বলবেন। তবে আমি শুধু বলবো পরীমনি একজন চমৎকার অভিনেত্রী। তার দোষ-ত্রুটি থাকতে পারে। আমরা সবাই কোথাও না কোথাও দোষী। কেউ কম, কেউ বেশি। কারোরটা দেখা যায়, কারোরটা গোপন। তাই পরীমনির সাজা যা হওয়ার হয়েছে। তাকে মুক্তি দিয়ে নতুন করে নতুন শুরুর সুযোগ দেয়া হোক।
আজকে পরীমনির এই অবস্থার জন্য আমাদেরও অনেক দায় আছে। আমরা নতুন আসা পরীমনিদের যত্ন নিতে পারছি না। তাদের কাজে ব্যস্ত রাখতে পারছি না। এজন্যই নানা অপরাধ ঢুকে যাচ্ছে শিল্পের দেয়াল টপকে। সব মন্দ কেটে যাক। ভালো দিন আসুক সিনেমায়।
এলএ/জেআইএম