আলাদিনের দৈত্য না কি বাস্তবতা?
বাংলাদেশের টিভি নাটক বেশিরভাগই কমেডিনির্ভর। হাস্যরসই যেন তার প্রধান উপাদান। তবে এর মধ্যেও কিছু নাটক মৌলিক গল্প বা বাস্তবতার আলোকে নির্মিত হয়। সম্প্রতি এমনই একটি নাটক দেখার সৌভাগ্য হলো। রূপকথার আদলে লেখা নাটকটি যেন রাজনীতির বাস্তবিক বয়ান। সমসাময়িক বাস্তবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নাটকের শুরুটা চমৎকার। কাহিনি, চরিত্র, নির্মাণ অসাধারণ। হাস্যরসের মধ্যদিয়ে গভীর বার্তা দেওয়া হয়েছে। নাটকে বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সচরাচর রাজনৈতিক বার্তা নিয়ে করা এমন নাটক আমার চোখে পড়েনি। নাটকে স্কুলশিক্ষক, দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, সংস্কারপন্থি, রাজনীতি বিশ্লেষক ও সাংবাদিক চরিত্র খুবই প্রাসঙ্গিক। গ্রামের ভণ্ড কবিরাজ, রূপকথার আলাদিনের দৈত্য ও গ্রামবাসী মূল চরিত্রগুলোকে সবল করেছে।
নাটকের দৃশ্যপট মনোরম। গ্রামীণ পরিবেশে কাহিনি নির্মিত হলেও আমাদের জাতীয় জীবনে কাহিনিটি খুবই প্রাসঙ্গিক। এ নাটকে মোশাররফ করিম আলাদিন চাচা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি একজন স্কুলশিক্ষক। তার ছেলে-মেয়ে নেই। দিনের অধিকাংশ সময় রূপকথার গল্পের বই পড়েন। রূপকথা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য খুঁজে বেড়ান। এক সময় বুঝতে পারেন তিনি নিজেও কোনো এক রূপকথার অংশ।
যে রূপকথার মধ্যে আছে মানুষরূপী ভূত-প্রেত, রাক্ষস-খোক্ষস। তাদের বহুরূপী পরিচয়ের আড়ালে আসল যে পরিচয় আছে; সেই পরিচয় খুঁজতে গিয়ে আলাদিন চাচা জড়িয়ে পড়েন নানা ধরনের রহস্যের জালে। যে রহস্যের জট খুলতে গিয়ে অনেক কিছুই তিনি নতুন করে উপলব্ধি করেন। যে উপলব্ধির কারণে কারও কারও কাছে তিনি হয়ে ওঠেন মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি সবশেষে বুঝতে পারেন, পুরো সমাজ অসুস্থ, অসুস্থ সমাজের কাছে তাই সুস্থ তাকেই অসুস্থ মনে হচ্ছে।
এ নাটকে শবনম ফারিয়া সাংবাদিক চরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি রূপকথা নিয়ে আলাদিন চাচার লেখা একটি প্রবন্ধ পড়ে ভূতনগর গ্রামে চলে আসেন। সেখানে এসে নিজেই রূপকথার অংশ হয়ে যান। সবশেষে দৈত্যের রহস্য উদঘাটন করেন। স্কুলশিক্ষক আলাদিন চাচা দৈত্যের মাধ্যমে মানুষকে বিকারগ্রস্ত অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দেন।
যদিও আমরা ভূত বা দৈত্য বিশ্বাস করি না। তবে রূপকথায় পড়ে তৃপ্তি পাই। যুগ যুগ ধরে রূপকথায় পরি, ভূত বা দৈত্যকে মূল চরিত্রে নিয়ে আসা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবার এই টিভি নাটকেও আমরা দৈত্যের দেখা পাই। আশরাফুজ্জামানের কাহিনি ও পরিচালনায় নাটকটিতে অভিনয় করেছেন সময়ের আলোচিত অভিনেতা মোশাররফ করিম, শবনম ফারিয়া, আমিন আজাদ, হাসিমুন, শেখ মাহবুব, বরুন, আলামিন সবুজ, সেকেন্দার প্রমুখ।
নাটকের গল্পটি ব্যতিক্রম। যদিও নাটকে গ্রাম্য রাজনীতি নতুন কোনো বিষয় নয়। তারপরও সাবেক ইউপি সদস্য ও বর্তমান ইউপি সদস্যের অন্তর্দ্বন্দ্ব ব্যতিক্রমভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। নাটকের আলাদিনের দৈত্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন রজনী গান্ধা রফিক। তার মেকআপ, গেটাপ চমৎকার ছিল। তার অভিনয়ও দর্শককে আনন্দ দিতে পেরেছে বলে মনে হয়।
এ গল্পে আমরা মানুষের নানামুখী পরিচয় খুঁজে পাই। যেহেতু মানুষ জন্মগতভাবেই অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত; সেহেতু হঠাৎ করে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাছাড়া মানুষের মনের একটা অংশজুড়ে আছে লোভ-লালসা। আলাদিন চাচার রাজনৈতিক দৈত্য নাটকে কমেডির মাধ্যমে সেই বিষয়ই তুলে ধরা হয়েছে। ফলে রহস্যের জট খুলতে গিয়ে অনেক কিছুই নতুন করে উপলব্ধি করি।
আমি বিশ্বাস করি, এ সময়ের নাটক হিসেবে ‘আলাদিন চাচার রাজনৈতিক দৈত্য’ নাটকটি দর্শকের মনকে তৃপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে। কেননা নাটকের সবগুলো চরিত্রই সাবলীল এবং বাস্তবিক মনে হয়েছে। লাইট, সেট, পোশাক নিয়েও কোনো বিরূপ মন্তব্য নেই। সব মিলিয়ে নাটকটি সময়কে অতিক্রম করতে সক্ষম হবে বলে মনে করি। আমি নাটক সংশ্লিষ্ট সবার মঙ্গল কামনা করছি। কমেডি ঘরানার পাশাপাশি শিক্ষামূলক নাটকেরও জয় হোক।
এসইউ/এলএ/এমকেএইচ