পলিথিনের ঘরে মুক্তিযোদ্ধা
যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে কি পেলাম। পেয়েছি শুধু অবহেলা আর লাঞ্চনা। দেশকে ভালোবেসে দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে স্বাধীন করে আজ অসহায়ের মধ্যে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে কোনো সরকারের কাছে সহযোগিতা পেলাম না। এখন স্ত্রী, সন্তান নিয়ে গাছ তলায় পলিথিন দিয়ে ঘর নির্মাণ করে কোনো রকম জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধা হিসাবে সরকারের কাছে কোনো ধরনের সাহায্য পাচ্ছি না। আমার মতো একজন দুঃখি মানুষের কথা শোনার মতো স্বাধীন দেশের কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। তার জন্য কি বন্দুক হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের ৬৯ বছরের বীর মুক্তিযোদ্ধা ভূমিহীন মো. গোলাম মোস্তফা মিয়া আকুতির সহিত এমন কথাগুলো জাগো নিউজের কাছে ব্যক্ত করেন।
৭১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. গোলাম মোস্তফা মিয়া ২নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। তার গেজেট নং ৫৮৫। তিনি একটি ভ্যানে করে মলম, চকলেট ও আচার বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি দিনের অর্ধেক বেলা মূলত চালান রিকশা চালান তিনি। এখন শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় রিকশা চালাতে পারছেন না তিনি। ২০ বছর ধরে একটি রিকশার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেও পায়নি একটি রিকশা। যে রিকশার জন্য ১৯৯৬ সালে সোনারগাঁও তাজমহলের মালিক মনিরের দ্বারে ঘুরেছেন বছর খানেক। আর বিএনপির জোট সরকার আমলে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিমের কাছে একাধিকবার একটি রিকশার জন্য আবেদন করা হলেও ভাগ্যে জুটেনি একটি রিকশা।
কষ্টের মধ্যে থাকলেও অনেক ক্ষোভ আর দুঃখের মাঝেই মোস্তফা মিয়া বলে ওঠলেন, আমি আর কারো কাছে যেতে চাই না। অনেক ঘুরেছি। এখন আল্লাহই আমার শেষ ভরসা। ছোট ছেলেটা রিকশা চালিয়েই সংসার চালাচ্ছেন। আমি এখন অসুস্থ তাই বাসায়ই থাকতে হচ্ছে। যতদিন শরীরে শক্তি থাকবে ততদিন কাজ করেই বেঁচে থাকবো।
মোস্তফা মিয়া সোনারগাঁ পৌর এলাকার পানাম নগরের পুরাতন ভবনের পাশে একটি তেঁতুল গাছের নিচে একটি পলিথিন কাগজ দিয়ে নির্মিত ঘরে বসবাস করছেন। তার সঙ্গে রয়েছে স্ত্রী ও এক কন্যা, ছেলে। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া অর্জন্দী এলাকায় আদা শতাংশ বসত ভিটা অসুস্থ থাকায় বিক্রি করতে হয়েছে তাকে। তারপর থেকে তিনি পানাম পুরাতন একটি ভবনের একটি নোংরা ঘরে জায়গা নেন।
বর্তমানে যেটি প্রত্নতত্ব অধিদফতরের অধীনে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখানে উচ্ছেদ অভিযান চলানো হয়। এরপর সেখান থেকে ঘরটি ছেড়ে দিতে হয় মোস্তফা মিয়াকে। তারপর থেকে ঐ ভবনের পাশে একটি তেঁতুল গাছের নিচে তিনি পলিথিন দিয়ে ঘর নির্মাণ করে বসবাস করছেন।
পলিথিনের ছাউনী রয়েছে যেখানে দেয়ালগুলোও পলিথিনের। ২০১১ সালে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহারা বান তাহুরার নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত উচ্ছেদ অভিযান চালান। তখন পলিথিনের ঘরটিও উচ্ছেদ করতে বলেন। কয়েকটি আবেদনের কাগজ দেখিয়ে তিনি কয়েকদিন সময় পান পলিথিন ঘরটি অন্যত্র সরিয়ে নিতে। তার আরো পাঁচ ছেলে সন্তান ও দুই কন্যা থাকলেও তারা বিয়ের পর সবাই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এদিকে তিনি ১৯৭১ সালের মতই যুদ্ধ করে যাচ্ছেন।
সোনারগাঁও পানাম নগরীর পুরাতন ভবনের তেঁতুল গাছের নিচেই মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মিয়ার ঘরটি। ওখানে গিয়ে খোঁজ করে পাওয়া যায় তার ঘর। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, অনেক সাংবাদিকই লিখে কিন্তু আপনাদের এ লেখাতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যায় না। শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তিনি অনেকটা কষ্ট করেই বসলেন। জানালেন তার কষ্টের কথাগুলো।
পানাম নগরীর পুরাতন ভবনের পাশের এ পলিথিনটি ঘরটি টিকিয়ে রাখতে তিনি তৎকালীন মন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) তাজুল ইসলাম, নারায়নগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত, সোনারগাঁ উপজেলা সাবেক চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন, সাবেক সোনারগাঁ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর্সিয়া কমল, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সভাপতি কমান্ডা সামিউল্লাহ মিলন, কমান্ডা সোহেল রানা, ডেপটি কমান্ডার ওসমান গনি, সাবেক পৌর মেয়র সাদেকুর রহমানের সুপারিশ নিয়েছিলেন। ওই সুপারিশ নিয়ে তিনি জেলা প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন।
কিন্তু গত ২০১১ সালের ১৭ নভেম্বর জেলা প্রশাসন হতে তৎকালীন রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়েছে যে, এখানে কোনো বিবেচনার আইনগত সুযোগ নেই।
পরবর্তীতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর মানবিক কারণে তাকে উচ্ছেদ করেনি। আর সকল সুপারিশ নিতে তাকে প্রত্যেকের পিছনে ঘুরতে হয়েছে দীর্ঘদিন। কয়েকমাস পর পর পলিথিন ছিঁড়ে গেলে পরিবর্তন করতে হয়। তাই তার দাবি শুধু বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেন তার এ অসহায়ত্বের কথাটি পৌঁছায়।
মোস্তফা মিয়া জানান, তিনি প্রতিদিন আচার কলম বিক্রি করে ৫০/৬০ টাকা আয় করে সংসার চালান। তবে রিকশাটা চালাতে পারলে একটু আয় বেশি হয়। কিন্তু যখন অসুস্থ থাকেন তখন ভ্যান নিয়ে স্থানীয় পানাম বাজারের এক কোনে বসে মলম আচার ও চকলেট বিক্রি করেন।
ভ্যানে মাইক চালিয়ে ক্রেতাদের মলম বিক্রিতে আকৃষ্ট করেন। সারাক্ষণ মাইকে বাজান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের গান। এদিকে সরকারি ভাতা হিসেবে আট হাজার টাকা সংসারে একটু সহায়ক হয়। এভাবেই চলছে তার পরিবার পরিজন।
১৯৯৬ সালে একটি রিকশার জন্য তাজমহলের মালিক শিল্পপতি মনিরের পিছনে ঘুরেছিলেন। তিনি কথা দিয়েও দেননি। পরবর্তীতে বিএনপির আমলে তৎকালীন মন্ত্রী রেজাউল করিমের কাছেও একাধিকবার গিয়েছিলেন তিনিও দেননি একটি রিকশা ব্যবস্থা করে। একজন মন্ত্রী হয়েও মুক্তিযোদ্ধার পাশে দাঁড়ালেন না। ১৯৭১ সালে মোস্তফা আনসার ছিলেন। ওই সময়ও তিনি রিকশা চালাতেন। সে সময় ১২৫ টাকা নিজের রিকশা বিক্রি করে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তখন তিনি ২৫ বছরের অবিবাহিত একজন পুরুষ।
ভারতের লায়লাপুুর আসামে তিনি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে ছিলেন। এক সঙ্গে তারা ৮৮ জন প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলেন। পরে ৮৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ৯টি গ্রুপে ভাগ করে দেয়া হয়। তার যুদ্ধাকালীন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন সোনারগাঁও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান কমান্ডার সোহেল রানা। তিনি কষ্টে থাকলেও তার কোনো আক্ষেপ নেই।
চাওয়া পাওয়ার কিছু নেই। এভাবেই বেঁচে থাকতে চান তিনি। তবে একটাই দাবি তার জীবনের দিনাতিপাতের কথাগুলো যদি প্রধানমন্ত্রীর কানে যেতো তাহলে তার বিশ্বাস অন্তত এক টুকরো ভিটে মাটি পেতো। যেখানে তিনি তার সংসারের সদস্যদের নিয়ে থাকতে পারতেন।
এআরএ/এমএস