শিশু সাঈদ হত্যা : ৩ জনের ফাঁসি


প্রকাশিত: ১০:১০ এএম, ৩০ নভেম্বর ২০১৫

সিলেটে চতুর্থ শ্রেণির স্কুলছাত্র, শিশু আবু সাঈদকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় ও হত্যার দায়ে জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক, পুলিশের এক কনস্টেবলসহ তিনজনকে পৃথক দুটি ধারায় ডাবল ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে ওই তিনজনকে এক লাখ করে পৃথক ধারায় প্রত্যেককে মোট দুই লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এছাড়া অভিযোগ সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় জেলা ওলামা লীগের প্রচার সম্পাদক মাহিব হোসেন মাসুমকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।

সোমবার বিকেল ৩টা ৩৫ মিনিটে চাঞ্চল্যকর এই মামলার অভিযুক্ত আসামিদের উপস্থিতিতে সিলেট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আব্দুর রশিদ এই রায় দেন। রায়ে বলা হয়েছে দণ্ডপ্রাপ্তরা এই রায়ের বিরুদ্ধে চাইলে উচ্চ আদালতে সাতদিনের মধ্যে আপিল করতে পারবেন।

মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, এসএমপির এয়ারপোর্ট থানার কনস্টেবল (বরখাস্তকৃত) এবাদুর রহমান পুতুল, সিলেট জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম রাকিব ও পুলিশের কতিথ সোর্স আতাউর রহমান গেদা।

রায় ঘোষণা উপলক্ষ্যে বেলা ৩টা ৩৫ মিনিটে এজলাসে উঠেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক আব্দুর রশিদ। এজলাসে বসেই আদালত মামলাটি দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার কারণ ও মামলার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে পাঁচ মিনিট বক্তব্য দেন। এরপর ৩টা ৪০মিনিটে মোট ৪৯ পৃষ্ঠার এই লিখিত রায়ের মধ্যে শুধু মাত্র ৪৯ নম্বর পৃষ্ঠার মূল আদেশ কপিটি পড়ে শোনান। ৩টা ৪৫ মিনিটে অর্থাৎ পাঁচ মিনিটে মূল আদেশপড়া শেষ করেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক।

রায়ে আদালত বলেন, ‘আসামি পুতুল, রাকিব ও গেদার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের প্রত্যেককে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৭ অপহরণের জন্য এবং মুক্তিপণ আদায়ের জন্য উক্ত আইনের ৮ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হলো। তবে দণ্ডপ্রাপ্ত সকল আসামিদের বিরুদ্ধে ভিকটিম আবু সাঈদকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করায় আট ধারায় দোষী সাব্যস্ত করিয়া মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। সেই সঙ্গে প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হইলো। জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হইলো।’

লিখিত রায়ে বিচারক আরও উল্লেখ করেন, এছাড়া আসামিগণ একই ধরনের উদ্দেশ্যে ভিকটিম আবু সাঈদকে হত্যা করায় দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারায় দোষি সাব্যস্ত করিয়া প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হইলো। জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ড দেয়া হইলো।’

আসামিদের প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড ফাঁসিতে ঝুলাইয়া কার্যকর করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হইল। আসামিগণ ইচ্ছা করিলে সাত দিনের মধ্যে অত্র রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন।

রায়ে আরও বলা হয়, মামলার অপর আসামি মাহিব হোসেন মাসুমের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সাক্ষ্য প্রমাণে সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে নিদোর্ষ সাব্যস্ত করে খালাস দেয়া হইলো। সে অন্য কোনো মামলায় জড়িত না থাকিলে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক।

মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য এই মামলার সমস্ত কার্যক্রম মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে প্রেরণ করার আদেশ দেন বিচারক। এ রায়ের এক কপি বিজ্ঞ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও এক কপি বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সিলেট বরাবর পাঠানোরও নির্দেশ দেন আদালত।

দেশের বিচারিক ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে মাত্র আট কার্যদিবসে মোট ৩৭ জনের মধ্যে ২৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে বহুল কাঙ্খিত এই রায় এলো। এই যুগান্তকারী রায় ঘোষণার মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের বিচারক আব্দুর রশিদও তার বিচারিক জীবনের শেষ রায় দিলেন। ১ ডিসেম্বর থেকে তিনি অবসরে যাচ্ছেন।

অভিযোগ গঠনের পর মাত্র আট কার্যদিবসে চাঞ্চল্যকর মামলার বিচার কাজ শেষে কাঙ্খিত এই রায় এলো। রায়ে সন্তোষ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পিপি আবদুল মালেক ও শিশু সাঈদের বাবা-মা।

তবে আসামি পক্ষের আইনজীবী শাহ মো. আশরাফুল ইসলাম আশরাফ বলেন, আমরা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। মামলার এজাহার, চার্জশিট ও সাক্ষ্যে যথেষ্ট ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিলো। রায়ে এসব বিবেচনায় নেয়া হয়নি। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর অবশ্যই আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবো।

দ্রুত ছেলে হত্যার বিচার শেষ হওয়ায় আদালতের বিচারকসহ বিচার সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নিহত আবু সাঈদের বাবা মতিন মিয়া বলেন, আমার ছেলেটাকে ওরা যেভাবে কষ্ট দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করেছে। এই রায়ের আপিলেও দ্রুত শুনানি শেষ করে খুনিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

রায় শোনার জন্য সোমবার সকাল থেকে আদালত এলাকায় শিশু আবু সাঈদের শিক্ষক-সহপাঠি ছাত্র ও সাধারণ মানুষ ভিড় করেন। বিকেল পৌনে তিনটার দিকে কারাগার থেকে আসামিদের আদালতে নেয়ার সময় আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষুব্ধ জনতা আসামিদের ফাঁসি দাবি করে মিছিল করেন। এছাড়া তারা অভিযুক্তদের ওপর জুতা ছুড়ে মারার চেষ্টা করেন। পরে পুলিশ বিক্ষুব্ধদের সরিয়ে দেয়।

রায় শুনতে আদালতে আসা রায়নগর শাহমীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কাবেরী রানী দে জাগো নিউজকে বলেন, আমার এই শান্ত শিষ্ট ছাত্রটিকে ওরা যে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। সেই হত্যার বিচার দেখতে আজ আদালতে এই প্রথম আসলাম।

তিনি বলেন, শিশু হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করে দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য তিনি সরকারসহ বিচার সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।

এর আগে গত রোববার চাঞ্চল্যকর এই মামলার যুক্তি তর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করেছিলেন বিচারক। গত ২৬ নভেম্বর এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ওইদিন সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৪২ ধারা মতে আসামি পরীক্ষাও সম্পন্ন করা হয়।

গত ১৭ নভেম্বর সাঈদ অপহরণ ও হত্যা মামলায় সিলেট মহানগর পুলিশের এয়ারপোর্ট থানার কনস্টেবল (বরখাস্তকৃত) এবাদুর রহমান পুতুল, সিলেট জেলা ওলামা লীগের সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম রাকিব ও প্রচার সম্পাদক মুহিবুর রহমান ওরফে মহি হোসেন মাছুম এবং র্যাব ও পুলিশের কথিত সোর্স আতাউর রহমান গেদার বিরুদ্ধে আদালত অভিযোগ গঠন করেন।

এরপর গত ১৯ নভেম্বর থেকে টানা সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ওইদিন সাক্ষ্য দেন পাঁচজন। ২২ নভেম্বর দ্বিতীয় দিনে সাক্ষ্য দেন ছয়জন, তৃতীয় দিনে ২৩ নভেম্বর সাঈদের সাত প্রতিবেশী সাক্ষ্য দেন। গত ২৪ নভেম্বর দুই ম্যাজিস্ট্রেটসহ সাক্ষ্য দেন পাঁচজন। ২৫ নভেম্বর সাক্ষ্য দেন সাঈদের পোস্টমর্ডেমকারী চিকিৎসকসহ তিনজন ও সর্বশেষ ২৬ নভেম্বর সাক্ষ্য দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ তিনজন।

এর আগে গত ২৯ অক্টোবর সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক সাহেদুল করিম চার্জশিট আমলে নিয়ে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে নথিপত্র স্থানান্তর করেন।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর সিলেট মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) আবদুল আহাদ চৌধুরী। এর আগেরদিন ২২ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার ভাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি-তদন্ত) মোশাররফ হোসাইন এসি প্রসিকিউশনের কাছে মামলার চার্জশিট (অভিযোগপত্র) হস্তান্তর করেন।
 
গত ১১ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টায় নগরীর রায়নগর থেকে স্কুলছাত্র আবু সাঈদকে (৯) অপহরণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৩ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় পুলিশ কনস্টেবল এবাদুর রহমান পুতুলের কুমারপাড়াস্থ ঝরনারপাড় সবুজ-৩৭ বাসার ছাদের চিলেকোঠা একটি ঘর থেকে আবু সাঈদের অর্ধগলিত মরদেহ সাতটি পলিথিনের বস্তার মধ্যে মোড়ানো অবস্থায়  উদ্ধার করে পুলিশ।

 এ ঘটনায় এয়ারপোর্ট থানার কনস্টেবল এবাদুর, পুলিশের সোর্স গেদা ও ওলামা লীগ নেতা রাকিবকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর এই তিনজনই ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

 নিহত আবু সাঈদ নগরের রায়নগর শাহমীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ও রায়নগর দর্জিবন্দ বসুন্ধরা ৭৪ নম্বর বাসার আব্দুল মতিনের ছেলে। মতিনের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার খাশিলা গ্রামে।
    
সামির মাহমুদ/এমজেড/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।