টাঙ্গাইলের ৫১ সিনেমা হলের মধ্যে টিকে আছে মাত্র পাঁচটি
পঞ্চাশের দশকে টাঙ্গাইলে প্রথম সিনেমা হলের যাত্রা শুরু করে রওশন টকিজ। শহরের নিরালা মোড়ের করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাবের জমি লিজ নিয়ে সিনেমা হলটি নির্মাণ করেন মরহুম লেবু চৌধুরী। এরই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকে এ জেলায় সিনেমা হলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫১টি। তবে মাত্র দশ থেকে পনের বছরের মধ্যে দর্শক সঙ্কট, মানহীন ছবি আর সীমাহীন লোকসানের মতো নানা সমস্যায় ৪৬টি সিনেমা হলই বন্ধ হয়েছে।
এরপরও সীমাহীন লোকসান আর নানা শঙ্কা উপেক্ষা করে এ শিল্পকে আজও ধরে রেখেছেন জেলার পাঁচটি সিনেমা হল মালিক। চলমান পরিস্থিতিতে কতদিন এ ব্যবসা চালিয়ে নেয়া সম্ভব তা নিয়েও নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন তারা। দর্শক নন্দিত সিনেমা নির্মাণ আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পকে এখনও বাঁচানো সম্ভব বলে মনে করেছেন সিনেমা হল ব্যবসায়ীরা।
জানা যায়, পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বই দশকের মধ্যে টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলায় গড়ে ওঠে ৫১টি সিনেমা হল। এর মধ্যে পঞ্চাশের দশকে টাঙ্গাইল পৌর শহরের নিরালা মোড়ের করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাবের জমি লিজ নিয়ে রওশন টকিজ সিনেমা হল নির্মাণ করেন মরহুম লেবু মিয়া।
১৯৭৩ সালে শহরের বটতলায় নিজ জমিতে লেবু চৌধুরী নির্মাণ করেন রূপসী নামে দ্বিতীয় সিনেমা হল। ধারাবাহিকভাবে তার নিজ নামেই জেলার ধনবাড়ী, মির্জাপুর, দেলদুয়ারের পাথরাইল গ্রামে নির্মাণ করেন আরও তিনটি সিনেমা হল।
এর আগে ১৯৬৪ সালে টাঙ্গাইলের সিনেমা হল নির্মাণের প্রতিষ্ঠাতা ও হল মালিক সমিতির আজীবন সভাপতি লেবু চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় শহরের দিঘুলিয়া এলাকার মটু মিয়া নিজ মালিকানায় মেইন রোডে নির্মাণ করেন রূপবাণী নামের শহরের তৃতীয় সিনেমা হলটি।
১৯৭৫ সালে ছানা মিয়া শহরের আদালত পাড়ার মিঞাবাড়ী রোডে নির্মাণ করেন চতুর্থ সিনেমা হল মালঞ্চ। সর্বশেষ ১৯৭৬ সালে আদালত পাড়ার আরেক বাসিন্দা আফজাল চৌধুরী ওই এলাকার টিনপট্টি রোডে নির্মাণ করেন কেয়া সিনেমা হল। যেটি ছিল শহরের পঞ্চম সিনেমা হল।
এরই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকের মধ্যেই টাঙ্গাইল পৌর শহরের ৫টিসহ জেলায় গড়ে ওঠে ৫১টি সিনেমা হল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্মাণের পর থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিনেমা হলগুলো ছিল ব্যবসা সফল। এ সময় প্রতিদিন হলগুলোতে শো চলতো ৫ সিফটে। সকাল ১০টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত চলত হলগুলোর সিনেমা। বসার জন্য ছিল ফ্রন্ট স্টল, স্টল, আর স্টল, ডিসি আর বক্স নামের ৫টি স্থান। যার টিকিটের দামও ছিল ভিন্ন ভিন্ন।
সিনেমা হলের রমরমা ব্যবসার সুবাধে এ জেলায় গড়ে ওঠে সিনেমা হল শ্রমিক ইউনিয়ন। যার সদস্য সংখ্যা ৫৬৫ জন।
বর্তমানে এ জেলায় চলমান ৫টি সিনেমা হলের মধ্যে টাঙ্গাইল শহরে রয়েছে মালঞ্চ সিনেমা হল নামের একটি প্রেক্ষাগৃহ। প্রায় দর্শক ছাড়াই এ হলে প্রতিদিন চলছে ৪টি শো। এর শো চলার সময় সকাল সাড়ে ১০টা, দুপুর দেড়টা, বিকেল সাড়ে ৪টা আর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। বসার জন্য রয়েছে আর স্টল, ডিসি ও আর বক্স নামের ৩টি স্থান। যার টিকিটের দাম আর স্টল ৫০, ডিসি ৬০ ও আর বক্স ৭০ টাকা।
এছাড়া চলছে নাগরপুরে ২টি, মধুপুরে ১টি ও কালিহাতীর বল্লায় ১টি সিনেমা হল। মানহীন সিনেমা নির্মাণসহ নানা জটিলতায় ২০০১ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যেই এ জেলার ৫১টি সিনেমা হলের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় ৪৬টি।
সরেজমিনে শহরের চলমান একমাত্র সিনেমা হল মালঞ্চে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে চলছে টাঙ্গাইলের ছেলে নায়ক মান্না আর অমিত হাসান অভিনিত সিনেমা ‘রংবাজ বাদশা’। ছবিটি সাত দিনের জন্য ৬ হাজার টাকা চুক্তিতে ভাড়া আনা হয়েছে। তবে নেই নামমাত্র দর্শকও।
সিনেমা হলের দর্শক ও শহরের চা বিক্রেতা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আগে প্রতি সপ্তাহে হলে সিনেমা দেখতেন তিনি। তখনকার সিনেমার কাহিনী আর নায়ক-নায়িকারা ভালো ছিল। এক সিনেমা বারবার দেখতে ইচ্ছে করত। এখন সিনেমায় নোংরা দৃশ্য আসাসহ কোনো কাহিনী না থাকায় প্রায় ১০ থেকে পনের বছর যাবৎ হলে সিনেমা দেখা বাদ দিয়েছেন তিনি। তবে ভালো কাহিনীর সিনেমা হলে আবার হলে গিয়ে সিনেমা দেখবেন।
দর্শক জাহিদ বলেন, প্রায়ই সিনেমা দেখতেন তিনি। এখন শহরের সিনেমা হলগুলো ভেঙে ফেলাসহ নায়ক মান্না মারা যাওয়ায় সিনেমা দেখা বাদ দিয়েছেন তিনি।
কেয়া সিনেমা হল পরিচালনাকারী ও জেলা সিনেমা হল শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গণেষ চন্দ্র সরকার বলেন, লোকসানের কারণে এ জেলার ৪৬টি হল বন্ধ করেছে হল কর্তৃপক্ষ। বন্ধ হওয়ায় হলগুলোতে কর্মরত কর্মচারীরা বেকার হয়ে গেছেন। পেটের দায়ে ওই কর্মচারীরা এখন বিভিন্ন পেশায় লিপ্ত।
সিনেমা হলগুলোর লোকসান হওয়া নিয়ে তিনি বলেন, মোবাইলে সিনেমা দেখার দিন আসায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে ভালো মানের ছবি অভাব। সরকারিভাবে হল মালিকদের ডিজিটাল প্রযুক্তির সিনেমা হল নির্মাণে সহায়তা করাসহ ভালো ছবি নির্মাণে সহায়তা করলে সিনেমা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
রওশন টকিজ ও রূপসী সিনেমা হল মালিক মরহুম লেবু চৌধুরীর ছেলে ও হল ব্যবসায়ী দুলাল চৌধুরী বলেন, জেলার প্রথম সিনেমা হল ব্যবসায়ী ছিলেন আমার বাবা লেবু চৌধুরী। জেলায় তার ছিল মোট ৫টি হল। বাবাই ছিলেন জেলা সিনেমা হল মালিক সমিতির আজীবন সভাপতি। ২০০২ সালে বাবার মৃত্যুর পর এবং সীমাহীন লোকসানের কারণে তাদের ওই সিনেমা হলের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয়েছে।
এর মধ্যে শহরের নিরালা মোড়ের করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাবের জমি লিজ বাতিল করায় ২০০৬ সালে রওশন টকিজ সিনেমাটি বন্ধ করতে হয়। এছাড়াও সীমাহীন লোকসানের ফলে ২০১১ সালে বন্ধ করতে হয় রূপসী সিনেমা হলটি।
মালঞ্চ হলের মালিক জাহিদুর রহমান বলেন, জিগাংসা সিনেমার মাধ্যমে শুরু হয় এ হলের যাত্রা। এরপর ধারাবাহিকভাবে ভালো ব্যবসা হয়েছে হলটির। এ সময় সিনেমা হলের কর্মচারীই ছিল ২৯ জন। তবে এখন হলের ব্যবসা খুব খারাপ। এ কারণে হলে কাজ করছে মাত্র ৬ জন কর্মচারী।
তিনি বলেন, হল খুললেই কমপক্ষে দুই হাজার টাকা খরচ হয়। এরপর রয়েছে কর্মচারীর বেতন আর নিজের ব্যবসায়িক হিসাব। এরপরও হলটি চালু রাখা হয়েছে। তবে এভাবে কতদিন ব্যবসা করা যাবে সেটি জানেন না তিনি।
এরপরও হল চালু রাখতে সাতদিনের জন্য ৬ হাজার টাকা ভাড়ায় আনা হয়েছে পুরানো সিনেমা নায়ক মান্না আর অমিত হাসান অভিনিত রংবাজ বাদশা। তবে কোনো শোতেই দর্শক পাওয়া যাচ্ছে না। এ সিনেমায়ও তাদের লোকসান হবে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমরা এখনও হলের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল আর কর্মচারী বেতন দিতে পারছি না। প্রতিষ্ঠান ভালো করাসহ দর্শকনন্দিত সিনেমা নির্মাণ আর সরকারি সহযোগিতা পেলে এ ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে এমনটাই মনে করছেন তিনি।
এফএ/এএসএম