নাটোরে বাড়তি ফি নেয়ায় ফরম পূরণ করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা


প্রকাশিত: ০১:১১ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০১৫

নাটোরে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফরম পূরণের জন্য অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে স্কুল এবং মাদ্রাসাগুলো।

শিক্ষা বোর্ড ফরম পূরণ ফি এক হাজার ২শ এবং সেন্টার ফি বাবদ আরো ৩শ টাকা ধার্য করলেও বিদ্যালয়গুলো প্রভাবশালী ম্যানেজিং কমিটির যোগসাজোসে নানা খাত দেখিয়ে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। অতিরিক্ত ফি দিতে ব্যর্থ হয়ে অনেক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে তার অভিভাবকরা। তবে দেখভালের দায়িত্ব যাদের সেসব শিক্ষা অফিস কিংবা জেলা প্রশাসন রয়েছে নির্বিকার।

নাটোরের চন্দ্রকলা এসআই উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র রাকিব হোসেন বলেন, ২০১৬ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী সে। কিন্তু ফরম-পূরণের অতিরিক্ত ফি`র কারণে পরীক্ষা দেয়া হচ্ছে না তার।
 
রাকিব বলেন, ফরম পূরণ ফি`র জন্য দুই হাজার ৫০০ টাকা ধার্য করেছে তার বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রাকিবের দিনমজুর বাবা এক হাজার ৫শ টাকা যোগাড় করে দিলেও তা নিয়ে ফরম পূরণ করতে রাজি হয়নি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ কারণে উপায়ান্তর না দেখে ছেলের লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাকিবের বাবা আব্দুস সালাম।
 
রাকিবের বাবা আব্দুস সালাম বলেন, পার্শ্ববতী চাঁদপুর বিদ্যালয়ে ফরম পূরণ ফি এক হাজার ৫শ টাকা নির্ধারণ করলেও চন্দ্রকলা স্কুল দুই হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে।

সালাম আরো বলেন, এক হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে ছেলের ফরম পূরণের জন্য প্রধান শিক্ষককে অনেক অনুরোধ করেও কোনো সুফল হয়নি। তাহলে আমাদের মতো গরীব মানুষের সন্তানদের লেখাপড়া কি টাকার অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে এমন প্রশ্ন করে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাকিবের দিনমজুর বাবা।
 
একই বিদ্যালয়ের অপর শিক্ষার্থী মুরশিদা খাতুন বলেন, তার কাছ থেকে ফরম পূরণ বাবদ তিন হাজার ৫০০ টাকা আদায় করা হয়েছে। বাবাকে না জানিয়ে গোপনে বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে ফরম পূরণের জন্য জমা দিয়ে বিপাকে পড়েছেন মুরশিদা খাতুন।

মুরশিদার বাবা মিজানুর রহমান বলেন, তার মেয়ে নির্বাচনী পরীক্ষায় দুই বিষয়ে অকৃতকার্য হয়েছে।  এ কারণে ফরম পূরণের দুই হাজার ৫০০ টাকার সঙ্গে বিষয় প্রতি ৫০০ টাকা হারে তাকে বাড়তি এক হাজার টাকা জরিমানাসহ মোট তিন হাজার ৫০০ টাকা জমা দিতে হয়েছে।

মিজানুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার কারণে আমার মেয়েকে যদি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দিত তাতে আমার কিছু বলার ছিল না। কিন্তু বাড়তি এক হাজার টাকা নেয়া আমাদের মতো গরীব মানুষের উপর জুলুম করার সামিল।

তিনি বলেন, তিন হাজার ৫০০ টাকা জমা দিয়ে মেয়েকে পরীক্ষা দেয়াতে চান না তিনি। শিক্ষকদের কাছে টাকা ফেরত চেয়েছেন মিজানুর রহমান।

Natore

শুধু রাকিব আর মুরশিদা নয়, তাদের মতো একই অবস্থা জেলার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শত-শত শিক্ষার্থীর। শিক্ষা বোর্ড ফরম পূরণের জন্য মোট এক হাজার ৫০০ টাকা ফি নির্ধারণ করলেও স্কুলগুলো নানান খাত তৈরি করে দুই থেকে চার হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। কোনো কোনো বিদ্যালয়ে দুই হাজার ৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা ফি আদায় করা হলেও শিক্ষার্থীদের ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা জমা দেয়ার কথা বলতে বাধ্য করছে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
 
নাটোরের বাকসোর দাখিল মাদ্রাসা, আগদীঘা উচ্চ বিদ্যালয়, ওসমান গনি বালিকা বিদ্যালয়, লালোর উচ্চ বিদ্যালয়, গাংগইল উচ্চ বিদ্যালয়, হাতিয়ানদহ উচ্চ বিদ্যালয়, ডাঙ্গাপাড়া দাখিল মাদ্রাসা, ভবানিপুর দাখিল মাদ্রাসা এবং ওয়ালিয়া হাফিজুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত ফি আদায়ের এমন চিত্র দেখা যায়।

সরেজমিনে সদর উপজেলার কাফুরিয়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে দেখা যায় ফরম পূরণের জন্য দুই হাজার ৪শ থেকে এক হাজার ৬শ টাকা আদায় করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইলে তারা এক হাজার ৬শ টাকাজমা দেয়ার কথা বলেন। কিন্তু, অভিভাবকদের সামনে নিয়ে আসতেই খুলে যায় শিক্ষকদের মুখোশ। অভিভাবকদের সামনে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা এই প্রতিবেদকের কাছে দুই হাজার ৬শ টাকা আদায় করার কথা স্বীকার করেন।

এ ব্যাপারে অতিরিক্ত টাকা আদায় করার কথা স্বীকার করে কাফুরিয়া হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুনর রশীদ বলেন, শিক্ষা অফিস এবং বোর্ডের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ঘুষ না দিলে কাজ হয় না। সেকারণে তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

অপরদিকে বাগাতিপাড়া উপজেলার কালিকাপুর বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দাবি করেন, বোর্ড নির্ধারিত ১৫শ টাকা নিয়েই তারা ফরম পূরণ করছেন। তবে স্কুলের রেজিস্ট্রারে ২৩শ থেকে ২৬শ টাকা আদায়ের প্রমাণ পাওয়া যায়।

অপরদিকে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা বলছেন, সামর্থ্য না থাকলেও বাধ্য হয়েই ঋণ-কর্জ করে অতিরিক্ত টাকাতেই ফরম পূরণ করতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না প্রশাসন। শিক্ষা অফিস বা জেলা প্রশাসনকে জানিয়েও সুফল পাচ্ছে না তারা। আর বিদ্যালয়ের প্রভাবশালী ম্যানেজিং কমিটির ভয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা কিছুই বলতে পারছেন না।

এদিকে জেলা প্রশাসন পরিচালিত নাটোর কালেক্টরেট পাবলিক স্কুলে ফরম পূরণ বাবদ ৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর বাড়তি ফি প্রত্যাহারের দাবিতে ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। কিন্তু তাতেও কোনো সুফল পায়নি শিক্ষার্থীরা।
 
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাদের বলেন, শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ফরম পূরণ বাবদ ১৫শ টাকা সঙ্গে এক হাজার টাকা সেশন ফি এবং এক হাজার টাকা বেতন আদায় করা হয়েছে।
 
তবে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মকসেদুল হোসন বলেন, ফরম পূরণের সঙ্গে বেতন বা অন্য কোনো ফি আদায় করা যাবে না।

অপরদিকে জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান বলেন, অতিরিক্ত ফি আদায়ের কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। তবে কোনো বিদ্যালয় অতিরিক্ত ফি আদায় করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার হুশিয়ারি দেন তিনি।

এ বছর নাটোর জেলার ৩২৪টি বিদ্যালয় এবং ১২১টি মাদ্রাসা মিলিয়ে মোট ৪৪৫টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২১ হাজার শিক্ষার্থী এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষায় অংশ নেবে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রায় ৩৫০টি প্রতিষ্ঠানেই অতিরিক্ত ফি আদায় করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। তারা এই অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

রেজাউল করিম রেজা/এমএএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।