সিনেমার ‘ম্যাজিশিয়ান’ হুমায়ূন আহমেদ
সাহিত্য, সিনেমা, নাটক কিংবা গান লেখা- যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। ঢাকাই সিনেমার আকাশে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র হয়ে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। আজ তাকে হারিয়ে ফেলার অষ্টম বছর।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদ আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। প্রত্যেকটা চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য তিনি নিজেই লিখেছেন। ছবির জন্য বেশ কিছু গানও লিখেছেন। এমন কী সিনেমাগুলোর প্রযোজকও ছিলেন তিনি। সবগুলো ছবি দিয়েই দর্শক মুগ্ধ করেছেন, পেয়েছেন সমালোচকদের সমীহ। বিশেষ করে সহজবোধ্য সংলাপ প্রয়োগ ও চরিত্রের নান্দনিক বিকাশে চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদ সিনেমায় একজন ‘ম্যাজিশিয়ান’ হয়ে আছেন।
হুমায়ূন আহমেদ প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ১৯৯৪ সালে। চলচ্চিত্রটির নাম ‘আগুনের পরশমণি’। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত ও বিপাশা হায়াত। প্রথম ছবিতেই বাজিমাত করে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালনাসহ আটটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে ছবিটি। এর মধ্যে কাহিনীকার, সংলাপ রচয়িতা এবং প্রযোজক হিসেবে তিন বিভাগে হুমায়ূন আহমেদ নিজেই জাতীয় পুরস্কার পান।
এ ছবি মুক্তির ৬ বছর বিরতি দেন হুমায়ূন আহমেদ। ১৯৯৯ সালে তিনি নির্মাণ করেন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’। এ ছবিটিও ৭টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। এখানে দুর্দান্ত অভিনয় করে সবার মন জয় করে নেন জাহিদ হাসান, মেহের আফরোজ শাওন, মুক্তি, মাহফুজ আহমেদ, গোলাম মুস্তাফা, আনোয়ারা, সালেহ আহমেদরা। ছবিতে উকিল মুন্সির কথা ও সুরে বারী সিদ্দিকীর গাওয়া গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। সেইসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের কথায় মাকসুদ জামিল মিন্টুর সুর ও সংগীতে সুবীর নন্দীর গাওয়া ‘একটা ছিলো সোনার কন্যা’ গানটি সারাদেশের শ্রোতাদের মাতিয়ে দেয়।
২০০০ সালে মুক্তি পায় ‘দুই দুয়ারী’। রিয়াজ, মাহফুজ আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওন অভিনীত এ ছবিটিও দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। এ চলচ্চিত্রের জন্য রিয়াজ ২০০০ সালের সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এবং এ ছবির ‘বর্ষার প্রথম দিনে’ গানটির জন্য সাবিনা ইয়াসমিন সেরা নারী কণ্ঠশিল্পীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
২০০৩ সালে হুমায়ূন আহমেদের ‘চন্দ্রকথা’ ছবিটি মুক্তি পায়। আসাদুজ্জামান নূর, আহমেদ রুবেল ও শাওন অভিনীত সিনেমাটিও সমালোচকদের প্রশংসা পায়। ২০০৪ সালে মুক্তি পায় ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্রটি। এটি ছিলো তার পরিচালিত দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ছবি। এখানে রিয়াজ, হুমায়ূন ফরিদীর মতো তারকারা আলো ছড়িয়েছেন।
২০০৭ সালে ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ ও ২০০৮ সালে ‘আমার আছে জল’ ছবি নির্মাণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। ফেরদৌস, মিম, জাহিদ হাসান ও মেহের আফরোজ শাওন অভিনীত এ ছবিটিও দর্শকপ্রিয় হয়। দুটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়।
২০১২ সালে মুক্তি পায় হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় নির্মিত সর্বশেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’। হুমায়ূন আহমেদ এ ছবির বিশেষ প্রদর্শনী উপলক্ষে শেষবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় ফেরেন। ছবিটির জন্য সেরা পরিচালকসহ ২০১২ সালের বেশ কয়েকটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
চলচ্চিত্রের হুমায়ূনের গল্প এখানেই শেষ নয়। ১৯৯৪ সালে প্রযোজনা সংস্থা নুহাশ চলচ্চিত্র গড়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এই প্রতিষ্ঠান থেকে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করতেন তিনি। তার বিখ্যাত কয়েকটি উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেখানেও সফল হুমায়ূন।
হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’ নিয়ে মুস্তাফিজুর রহমান নির্মাণ করেন ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ছবিটি। ১৯৯২ সালে এই ছবিটি মুক্তি পায়। এই ছবির জন্য হুমায়ূন আহমেদ শ্রেষ্ঠ কাহিনীকারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। শঙ্খনীল কারাগার ওই বছর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী ডলি জহুর এবং শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক এমএ মজিদ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
এরপর হুমায়ূন আহমেদের কাহিনী নিয়ে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন ‘আবদার’। তার গল্প নিয়ে মোরশেদুল ইসলাম পরিচালিত ‘দূরত্ব’ ও ‘প্রিয়তমেষু’, শাহ আলম কিরণ পরিচালিত ‘সাজঘর’, আবু সাইয়ীদ পরিচালিত ‘নিরন্তর’, বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘নন্দিত নরকে’, তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ‘দারুচিনি দ্বীপ’ও মেহের আফরোজ শাওন পরিচালিত ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ছবিগুলোও দারুণ প্রশংসিত।
সর্বশেষ অনম বিশ্বাস নির্মাণ করেছেন মিসির আলী সিরিজের ‘দেবী’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘দেবী’ সিনেমা। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতে নেন ছবিটির প্রযোজক জয়া আহসান। এখানে মিসির আলী চরিত্রে অভিনয় করেছেন নন্দিত অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী।
অনেকগুলো জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে হুমায়ূন আহমেদের সিনেমা। শুধু দেশেই নয় বিশ্ব চলচ্চিত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার অস্কারের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছেছে তার ছবি। অস্কারে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগের প্রতিযোগিতায় হুমায়ূন আহমেদের দুটি ছবি অংশগ্রহণ করে। ছবি দুটি হচ্ছে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘শ্যামল ছায়া’ এবং আবু সাইয়ীদ পরিচালিত ‘নিরন্তর’।
এলএ/পিআর