আমাদেরও ২ হাজার কোটি টাকা থাকতে পারতো : অরণ্য আনোয়ার
একসময় সাংবাদিক হিসেবে কলম চালিয়েছেন নানা অসঙ্গতি নিয়ে। এরপর নাটক লেখা ও নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। সেখানেও পান জনপ্রিয়তা। বলছি অরণ্য আনোয়ারের কথা।
সম্প্রতি করোনাভাইরাসে কাঁপছে সারা দুনিয়া। এর প্রভাবে দেশে দেশে বেড়েছে বেকারত্ব। বাংলাদেশেও নানা অঙ্গনে এসেছে অস্থিরতা। টেলিভিশন নাটকেও মন্দ প্রভাব পড়েছে।
করোনা আতঙ্কে থেমে গেছে সব রকম শুটিং। বেকার হয়ে পড়েছেন এর সঙ্গে জড়িত সকল শিল্পীরা। এর ফলে অসহায় দিনযাপন করছেন এই আঙ্গিনায় দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষেরা।
শুধু তাই নয়, করোনার প্রভাবে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দায় যে ভয়ানক দিন হাতছানি দিচ্ছে সেখানে হুমকির মুখে আছেন হাজার হাজার শিল্পী ও কলাকুশলী। তাদের জন্য দুশ্চিন্তায় অনেকেই নানা কথা ভাবছেন, লিখছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
অরণ্য আনোয়ার তাদের অন্যতম একজন। সম্প্রতি ফেসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাসে তিনি টিভি নাটকের শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়ে লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেন, 'যদিও সম্ভাবনা একদমই কম, তারপরও ধরে নিলাম ঈদের পর করোনা সঙ্কট কেটে যাবে। করোনা সঙ্কট কাটলেও চলমান দারিদ্রতার সংকট কিন্তু কাটবে না।
নিজেদের কর্মক্ষেত্রকে আমরা অনেক বড় একটা ইন্ডাস্ট্রি বলে ভেবে থাকি। নিজেদের অনেক বড় বলে জাহির করে তৃপ্ত হই। কিন্তু সেটা বাস্তবে প্রতিষ্ঠার জন্য নুন্যতম চেষ্টা আমরা করি না। আমরা আত্ম সমালোচনা করি না।
দর্শক আমাদের নাটক দেখে না। এজন্য আমরা হিন্দি সিরিয়ালকে অনবরত দুষতে থাকি। টিভি স্টেশনকে গালি দিয়ে তৃপ্ত হই। তারকা শিল্পীরা বেশি টাকা নেয় বলে ওদের গালাগাল করি। নিজেদের ব্যর্থতা এতো এতো মোটা কাপড়ে ঢেকে দেই যে অন্য কেউ দেখাতো দুরের কথা নিজেরাই আর দেখার সুযোগ রাখি না।
বলবেন, এই খারাপ সময়ে এসব নিয়ে আবার প্যাঁচাল শুরু করেছি কেন?? কারণ আছে। এই যে ভয়ংকর এক ভাইরাস ভয়াবহ এক দারিদ্রতা নিয়ে আসছে আমাদের জন্য এই দারিদ্রতা মোকাবিলা করার কোনো ক্ষমতাই আমাদের নেই। আমাদের কোনো কল্যাণ তহবিল নেই। আমাদের সমন্বিত কোন সঞ্চয় নেই।
আমাদের এক এফটিপিও আছে। তার কোনো ফান্ড নেই ডিরেক্টরস গিল্ড, প্রোডিউসার্স এসোসিয়েশন বা অভিনয় শিল্পী সংঘের সব ফান্ড মিলিয়ে লাখ বিশেক টাকাও হয়তো হবে না।
অথচ আমরা চাইলে আজ এটা বিশ কোটি থেকে দুইশ কোটি টাকার একটা ফান্ড হতেই পারতো। দুই হাজার কোটি টাকাও অসম্ভব কিছু ছিলো না।
টেলিভিশন নাটকের নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, 'প্লিজ নেতৃবর্গ আমাকে বাজে গালি দেবার আগে ভাবুন, আমরা প্যাকেজ ফোরাম করেছি কতো সালে ?
তারপর করেছি ডিরেক্টরস গিল্ড। তারপর প্রোডিওসার্স এসোসিয়েশন, টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ, অভিনয় শিল্পী সংঘ; সবকিছুই কিন্তু গত শতাব্দীর কথা। সংগঠন করেছি আর ধারাবাহিকভাবে পরচর্চা করেছি। নিজেদের সমৃদ্ধ করার জন্য, নিজেদের শক্তিশালী করার জন্য কিচ্ছু করি নাই আমরা।
বাদ দিলাম সবকিছু। ভাবুন, প্যাকেজ ফোরামের সময় থেকে একটা ফান্ড গঠনের দিকে যদি আমরা মনোযোগ দিতাম। এই পঁচিশ বছরে সেটা অনায়াশে দুই হাজর কোটি টাকার একটা ফান্ড হতেই পারতো। কে ছিলনা তখন, এক ছাতার নিচে পুরো ইন্ডাস্ট্রি। এই যে না, একদম কোনো বাজে গালি দেবেন না। আমাকে গালি দেবার আগে ভাবুন এক ছাতার নিচে একজন ফরিদুর রেজা সাগর, একজন নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, একজন আলি যাকের, একজন রামেন্দু মজুমদার।ভালমতো ভেবে উপলব্ধি করে এবার গালি দেবার চেষ্টা করুন।
কি! গালি আসছে না তাইতো। সেদিন আমরা একসাথে ছিলাম মামুনুর রশিদ, আফজাল হোসেন, হুমায়ুন ফরীদি, হানিফ সংকেত, সুবর্ণা মুস্তাফা, আনোয়ার হোসেন বুলু, সাইদুল আনাম টুটুল, ইমদাদুল হক মিলন, মোহন খান, অরুণ চৌধুরী, মাসুম রেজা, শমী, মিমি, বিপাশা, হাকিম, জাহিদ, তৌকির, সেলিম, লাভলু, তানিয়া, সুইটি (কাকে রেখে কার নাম বলবো) গোটা ইন্ডাস্ট্রি তখন একসাথে। এক ছাতার নিচে। কিন্তু এই সামষ্টিক শক্তি কাজে লাগাবার কথা কেউ ভাবলো না।
ভাবুন, তখন যদি আমরা একটা তহবিল গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে পারতাম আজ পঁচিশ বছরে কি সেটা দুই হাজার কোটি টাকা হতে পারতো না? আমরা নিজেরাই কি নিজেদের ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে পারতাম না? নিজেদের দুর্যোগে নিজেরা কি সবাইকে যথেষ্ট অর্থ সহায়তা দিতে পারতামনা?
আমরা সেরকম করে কিচ্ছু ভাবিনি। সঙ্গত কারণে যা হবার তাই হলো। আবার সবাই আলাদা হযে গেলো বা ঝিমিয়ে পড়লো।
এরপর মুস্তফা মনোয়ার স্যারের নেতৃত্বে গঠন করা হলো ডিরেক্টরস গিল্ড। ফেরদৌসী আপাকে নিয়ে অভিনয় শিল্পীরা করলেন অভিনয় শিল্পী সংঘ। আমরা কয়েকজন মিলে নাট্যকার সংঘ, প্রযোজকরা একত্রিত হয়ে প্রডিওসার্স এসোসিয়েশন যার নেতৃত্বে মামুনুর রশীদ ভাই। বুলু ভাই, লাভলু ভাইরা করলেন ক্যামেরাম্যান এসোসিয়েশন।
হলো। শুধু সংগঠনই হলো। শক্তি কিন্তু কিচ্ছু হলো না।এরপর এইসব শক্তিহীন সংগঠন মিলে অতি সম্প্রতি অতি দুর্বল এফটিপিও নামের একটি ফেডারেল বডি গঠন করলাম আমরা। এই না, মুখে বাজে গালি উচ্চারণ করবেন না বলে দিলাম। কি করেছেন এতো এতো বছরে? কেন আপনাদের কোনো দূরদৃষ্টি নাই?
আপনারা যদি একজন শিল্পীর দৈনিক সম্মানির এক পার্সেন্ট অর্থ কল্যাণ তহবিলের জন্য রাখতেন কোন শিল্পী কি সেটা দিতে অস্বীকার করতো?
একটা লাইটম্যান থেকে শুরু করে প্রডাকশন বয় মেকাপম্যান, সহকারি পরিচালক, শিল্প নির্দেশক, পরিচালক প্রত্যেকেই খুশি মনে সেই কল্যাণ তহবিলে নিয়ম মাফিক টাকা রাখতেন। এটা নিশ্চয়ই আপনি স্বীকার করবেন। তাহলে করেন নি কেন?
এই ক্রাইসিস মোমেন্টে এতো এতো কথা বলার জন্য ক্ষমা চাইবো ভাববেন না। বরং বলবো করেন নি বলে এখনও করবেন না, দয়া করে এমনটা ভাববেন না। আজই শুরু করুন। এখনই শুরু করুন। একটা বড় তহবিল গঠন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে কাজ শুরু করুন প্লিজ।
আগামীতে শিল্পী ও কলাকুশলীদের জন্য খারাপ দিন অপেক্ষা করছে ইঙ্গিত দিয়ে এই নির্মাতা বলেন, 'সামনের ভয়ঙ্কর খারাপ সময় মোকাবেলা করতে হবে আমাদের। এই দিন এনে দিন খাওয়া আপনজনদের সামনে অন্তত দুটো ঈদ। একটু বড় করে বৃহত্তরভাবে আমাদের ভাবতে হবে। হবেই। এর কোনো বিকল্প নেই।'
এলএ/পিআর