এখন তারাও মুক্তিযোদ্ধা

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঠাকুরগাঁও
প্রকাশিত: ১০:৩৯ এএম, ১৪ অক্টোবর ২০১৫

ঠাকুরগাঁও শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার পশ্চিমে রাণীশংকৈল উপজেলার রাউতনগর গ্রাম। একাত্তরের সেই দিনগুলোতে রাউতনগর গ্রামে কত বাঙালি নারী যে পাকসেনাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছিলেন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে জেলা থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ওই গ্রামে সরেজমিনে বীরাঙ্গনাদের দেখতে যান। এসময় তারা প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে সঠিক তথ্য প্রদানে তাদের উদ্বুদ্ধ করেন।

এর মাধ্যমে ৩৫ জন নারীকে সনাক্ত করেন তারা। যারা একাত্তরে পাকসেনাদের হাতে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন। লোক লজ্জার কারণে তাদের মধ্যে ২৪ জন নারী নাম পরিচয় দিতে রাজি হন। তবে তাদের মধ্যে একজন মারা গেছেন গত ৪ বছর আগে। বেঁচে থাকা বীরাঙ্গনারা দীর্ঘদিন থেকেই দাবি করে আসছিলেন তাদেরকেও যেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি নিয়মিত ভাতার ব্যবস্থা করাও দাবি ছিল তাদের।

অবশেষে মিলেছে স্বীকৃতি। ১৯৭১ সালে যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজেদের সম্ভ্রম হারিয়ে ও নির্যাতনের বিনিময়ে পেয়েছিলেন কেবল বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি। এখন থেকে তারাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৪ বছর পরে ১২ অক্টোবর সোমবার মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে সারাদেশের ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও রাণীশংকৈল উপজেলার ৬ জন বীরাঙ্গনা স্বীকৃতি পেয়েছে।

Birangona
সরকারের এমন ঘোষণায় খুশি ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার রাউতনগর গ্রামের মুগল বাসুগীর কন্যা সুমি বাসুগী, একই উপজেলার নিয়ানপুর গ্রামের জমরত আলীর কন্যা মালেকা, রাউতনগর গ্রামের মঙ্গল কিসকুর (শহীদ) কন্যা মনি কিসকু, শিদলী গ্রামের বনহরি সরকারের কন্যা নিহারানী দাস, পকন্বা গ্রামের মনির উদ্দিনের কন্যা নুরজাহান বেগম ও রাউতনগর গ্রামের হাফিজ উদ্দিনের কন্যা হাফেজা বেগম। তবে বাকিদের স্বীকৃতি না হওয়ায় তারা হতাশা প্রকাশ করেছেন।

এ ব্যাপারে বীরাঙ্গনা হাফেজা বেগম বলেন, সরকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধা করেছে এমন খবর শুনেছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের যেন সরকারি সুযোগ সুবিধা দেয়। আর ছেলে-মেয়ের একটা সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করলে আরও ভালো হইতো।

বীরঙ্গনা সুমি বাসুগীর ছেলে জনি জানান, তার মা অসুস্থ। টাকার অভাবে তার চিকিৎসা করাতে পারছেন না। সরকার যদি দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের ভাতার ব্যবস্থা করে, তাহলে জীবনের শেষ প্রান্তে তিনবেলা পেট ভরে খেতে পারবেন তার মা।

পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিতা নারীদের সন্তানরা এখন তাদের মাকে নিয়ে গর্ভবোধ করেন। স্বাধীনতায় তাদের মায়ের অবদানও কম নয় বলে মনে করেন তারা। আর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় তাদের সে সন্মান আরও বেড়েছে বলে মনে করেন তারা।

বীরাঙ্গনা মালেকা জানান, আমরা ৩ বোন পাকিস্তানি হানাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছি। এর মধ্যে গত কয়েক বছর আগে একজন মারা গেছেন। যুদ্ধের পর থেকেই আমরা অবহেলিত। যুদ্ধে পরিবারের লোকজন শহীদ হওয়ার পর আমাদের ৩ বোনের আর বিয়ে হয়নি। এই সমাজের মানুষ নানা রকম কথা বলতো। জীবন নির্বাহের জন্য একটুও কাজ পায়নি। অবশেষে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করতে হত। ৪৪ বছর পর সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে আমরা এখন মুক্তিযোদ্ধা। বাকি জীবন চালাতে আমার আর ভিক্ষা করতে হবে না মনে হয়।

বীরঙ্গনা নুরজাহান বেগম বলেন, ৪৪ বছরের আগেই যদি এই স্বীকৃতি পেতাম তাহলে এই সমাজে আর অবহেলিত থাকতাম না। তবুও এই সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি যে আমি এখন মুক্তিযোদ্ধা। আমার মতো যুদ্ধের সময় আরও অনেকে নির্যাতিত হয়েছে তাদেরকেও এই স্বীকৃতি প্রদান করুক সরকার বলে দাবি জানান।

রাউতনগর গ্রামের বীরাঙ্গনা মনি কিসকু বলেন, যুদ্ধের পর থেকে অনেক কষ্ট করে জীবিকা নির্বাহ করছি। অর্থের অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারি না। সরকার আমাকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা করায় আরও বেঁচে থাকার আশার আলো দেখছি। মরার আগে যেন মেয়ের বিয়ে দিতে পারি সেজন্য যত দ্রুত পারে যেন ভাতা প্রদান করে আমাকে।

বীরাঙ্গনা নিহারানী দাসের ছেলে বিজয় দাস বলেন, আমরা আমাদের মাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে তাদের অবদানও কম নয়। তবে বর্তমানে রাণীশংকৈল উপজেলার কয়েকটি এলাকার বেঁচে থাকা বীরাঙ্গনাদের অনেকেই অনাহারে অর্ধাহারে অসুস্থ অবস্থায় দিনযাপন করছেন বলেও জানান তিনি। শুধু বীরাঙ্গনা শব্দটির মধ্যেই দীর্ঘ ৪৪ বছর আটকে রয়েছেন লাল-সবুজের পতাকার জন্য সব হারানো এই নারীরা। দীর্ঘ ৪৪ বছর হলেও তাদের স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে।

এমএএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।