ঢাকাই সিনেমা সমৃদ্ধ করা শ্রাবণ মেঘের দিনের ২০ বছর আজ

বিনোদন প্রতিবেদক
বিনোদন প্রতিবেদক বিনোদন প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৫৭ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২০

গ্রামের দরিদ্র গায়ক মতি মিয়া। সবাই তাকে গাতক মতি নামে চেনে। দেশে দেশে গান গেয়ে জীবন চলে তার। বাস করেন এক ভাঙ্গা ঘরে। পাশেই থাকে কুসুম নামে পরীর মতো এক মেয়ে। তার মাথা খানিকটা এলোমেলো। সাজতে ভালোবাসে সে। মন খারাপ হলেই সাজে।

কুসুম মতি মিয়াকে ভালোবেসে। সেটা প্রকাশ্য নয়। ইশারা ইঙ্গিতে বোঝায় সে। মতি মিয়া যেন বুঝেও না বোঝার ভান করে। হঠাৎ একদিন কুসুমের নিরুদ্দেশ বাবা বাড়ি ফিরে। আনন্দের বান ঢেকে যায় কুসুম ও তার ছোট বোন পুষ্পের মনে। কুসুমের মাও শান্তি খুঁজে পায় স্বামী বেঁচে আছে দেখে।

কুসুমের বাবা সাথে করে নিয়ে আসে সুরুজ নামে এক যুবককে। যার সঙ্গে বিয়ে হবে কুসুমের। এই খবর পেয়েও মতি মিয়া কুসুমের ভালোবাসা এড়িয় চলে। আর সুরুজ মুগ্ধ হয় কুসুমের রূপে, রহস্যে। তাকে সে সোনার কন্যা রুপে আবিস্কার করে।

তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে জমিদার বাড়ির নাতনি ডাক্তার শাহানার। এই ঘনিষ্ঠতা যেমন পছন্দ করেন না জমিদার তেমনি পছন্দ করে না কুসুমও।

ঘনিয়ে আসে সুরুজের সঙ্গে কুসুমের বিয়ের দিন। জমিদারের নাতনি শাহানা শহরে চলে যাচ্ছে। সবাই যখন তাকে বিদায়ে ব্যস্ত তখন কুসুম বিষ খায়। তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে মতি মিয়া। কিন্তু পথেই নৌকাতে মৃত্যু হয় কুসুমের। ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বলতে না পারা কুসুমকে শেষ বিদায়ে গান শোনায় মতি মিয়া। তার কান্না ভরা গলায় ভেসে আসে- 'শোয়াচান পাখি... আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছো নাকি....!'

এ গানেই শেষ হয় সিনেমাটি। দর্শক তখন বউয়ের সাজে মৃত কুসুমের শোকে কাতর। মতি মিয়ার বিচ্ছেদের কান্নায় দর্শকের চোখ ছলছল করছে। আজ থেকে বিশ বছর আগে আজকের দিনের সন্ধ্যাটি এভাবেই শেষ হয়েছিলো বিটিভির দর্শকের।

ঠিক তাই। ২০০০ সালের ৩১ মার্চ ছিলো শুক্রবার। সেদিন বিকেলে বিটিভিতে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছিলো এ সিনেমার। যার নাম 'শ্রাবণ মেঘের দিন'। একইদিনে ছবিটি প্রেক্ষাগৃহেও মুক্তি পেয়েছিলো।

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত এই ছবি গল্প, সংলাপ, গান, অভিনয় আর নির্মাণের মুন্সিয়ানায় জয় করে নিয়েছিলো সিনেমাপ্রেমীদের মন। দেখতে দেখতে ২০ বছর পার হয়ে গেল এ ছবির। এটি কালজয়ী সিনেমা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে দর্শকের অন্তরে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমা দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন ভাবনা, নতুন মাত্রার যোগ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।

নিজের লেখা 'শ্রাবণ মেঘের দিন' উপন্যাস অবলম্বনে নুহাশ চলচ্চিত্রের ব্যানারে নির্মিত এ সিনেমার বেশ কিছু বিষয় মাইলফলক হয়ে আছে। এ ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে যাত্রা করেন অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন।
এ ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে করেন হুমায়ুন-শাওন দম্পতি।

এই ছবিতে ময়মনসিংহের লোককবি ও গায়ক উকিল মুন্সীর গান ব্যবহার করেন হুমায়ূন আহমেদ। ‘সোয়াচান পাখি’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’, ‘পূবালী বাতাস’, 'মানুষ ধরো মানুষ ভজো', 'ওগো ভাবীজান' গানগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল গানগুলো। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়ে রাতারাতি তারকা খ্যাতি পান প্রয়াত গায়ক ও বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী।

এ ছবি উপহার দিয়েছিলো আরও একটি তুমুল জনপ্রিয় গান। সুবীর নন্দীর কণ্ঠে 'একটা ছিলো সোনার কন্যা' শিরোনামের গানটি নিমিষেই পৌঁছে যায় সারাদেশের আনাচে কানাচে। সব শ্রেণি ও বয়সের শ্রোতাদের মন জয় করা এ গানের গীতকার হুমায়ুন আহমেদ। মাহফুজ আহমেদের ঠোঁটে এ গানের অসাধারণ দৃশ্যায়ন আজও শ্রোতা-দর্শকের মন ছুঁয়ে যায়।

ছবিটির প্রতিটা অভিনয়শিল্পী অসাধারণ অভিনয় করেন। তবে গাতক মতি মিয়া চরিত্রে জাহিদ হাসান ছিলেন এ ছবির প্রাণ ভ্রোমরা। কুসুম চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন মেহের আফরোজ শাওন। এই ছবির মাধ্যমেই অভিনেত্রী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তিনি। সুরুজ চরিত্রে মাহফুজ আহমেদের অভিনয়ও ছিল চমৎকার।

কুসুমের মা চরিত্রে আনোয়ারা, বাবা চরিত্রে প্রয়াত অভিনেতা সালেহ আহমেদ মন ভরিয়েছেন। চমক দেখান ঢুলী চরিত্রে ডা এজাজ ও তার স্ত্রীর চরিত্রে শামীমা নাজনীন।

এছাড়া রাজাকার, অহংকারী জমিদার চরিত্রে প্রয়াত অভিনেতা গোলাম মুস্তাফা, তার বড় নাতনি চরিত্রে অভিনেত্রী মুক্তির অভিনয় ছিলো দুর্দান্ত।

ছবিটি একদিকে যেমন দারুণ প্রশংসিত হয় তেমনি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের দৃষ্টিতে শিল্পসম্মত হিসেবে বিবেচিত হয়।

সিনেমাটির চিত্রনাট্য রচনা ও পরিচালনায় হুমায়ূন আহমেদের সৃজনশীলতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। নৌকা বাইচ, গাতকদের গানের আসর, গায়ে হলুদের গান ইত্যাদির মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরেন এ ছবিতে। উকিল মুন্সীর মতো একজন লোককবিকে জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরার বিষয়টিও ছিল প্রশংসনীয়।

অশ্লীলতা যখন বাংলা সিনেমাকে জেঁকে ধরছিলো বাংলাদেশে তখন সুস্থ রুচির বিনোদনের ধারা প্রাণ ফিরে পায় এ সিনেমাটির মাধ্যমে। মধ্যবিত্ত দর্শককে হলে ফিরিয়ে আনে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’।

এ ছবির ২০ বছর পূর্তিতে নস্টালজিক হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন মেহের আফরোজ শাওন।।তিনি লিখেছেন, 'আমার নাম কুসুম। বাপজান আপনারে আনসে আমার সাথে বিবাহ দেয়নের জন্য। আমারে কি আপনের পছন্দ হইসে?'

বিশ বছর আগের এই দিনে (শুক্রবার, মার্চ ৩১, ২০০০) বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল ‘শ্রাবণ মেঘের দিন'।

এলএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।