শিল্পী সমিতিতে ভোটার যোগ-বিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ

বিনোদন প্রতিবেদক
বিনোদন প্রতিবেদক বিনোদন প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:২৪ পিএম, ০৫ অক্টোবর ২০১৯

২০১৭ সালের ৫ মে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন মিশা সওদাগর ও জায়েদ খান। গেল দুই বছর ভালো-মন্দেই কেটেছে তাদের। বেশ কিছু ইতিবাচক কাজ দিয়ে যেমন প্রশংসিত হয়েছেন তেমনি কিছু কার্যক্রম তাদের তুলেছে অভিযোগের কাঠগড়ায়।

তার মধ্যে অন্যতম একটি সমিতির ভোটার নিয়ে অনিয়ম। গেল কয়েক সপ্তাহ ধরেই বিষয়টি আলোচ্য চলচ্চিত্রপাড়ায়। শিল্পী নয় দাবি তুলে বেশ ক’জন পুরনো শিল্পীর সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে যারা রাজ্জাক-শাবানার সঙ্গেও বহু চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন।

আবার অনেক শিল্পীকে ভোটার বানানো হয়েছে সমিতির গঠনতন্ত্রকে অবমাননা করেই। যে নিয়ম ভেঙ্গে তারা ভোটার হয়েছেন সেই নিয়ম মেনেই আবার অনেককে ভোটার করা হয়নি। কেউ কেউ চাঁদা দিয়েও নিজেরে ভোটাধিকার বুঝে পাননি। ফেরত পাননি টাকাও। সে নিয়ে উত্তাল রয়েছে চলচ্চিত্র শিল্পীদের সমিতি।

জানা গেছে, গত নির্বাচনে শিল্পী সমিতির মোট ভোটার সংখ্যা ছিলো ৬২৪ জন। মিশা সওদাগর-জায়েদ খান প্যানেল ক্ষমতা নেয়ার পর এ তালিকা থেকে ১৮১ জন ভোটারের ভোটাধিকার খর্ব করে কেবল সহযোগী সদস্য করা হয়েছে। যারা এবার ভোট দেয়ার অধিকার পাবেন না। অন্যদিকে সংগঠনের নিয়ম না মেনে নতুন করে ২০ জন শিল্পীকে করা হয়েছে ভোটার।

যোগ বিয়োগ শেষে শিল্পী সমিতির ২০১৯-২০২১ মেয়াদের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা হচ্ছে ৪৪৯ জন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর শিল্পী সমিতির কার্যালয়ের বোর্ডে ভোটারদের এই চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেছে এবারের নির্বাচন কমিশন।

বাদ পড়া অধিকাংশ ভোটারই অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন মিশা-জায়েদের নামে। তারা বলছেন, সততার অভাবেই সংগঠনের সভাপতি ও সেক্রেটারি এই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। তারা স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে অযোগ্যদের ভোটার করেছেন। কিন্তু যারা যোগ্য তাদের ছাটাই করে দিয়েছেন।

তাদের দাবি, গঠনতন্ত্রের যে ধারার উপর ভিত্তি করে তাদের বাদ দেয়া হয়েছে আবার একই ধারাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অনেককে সদস্য করেছে মিশা-জায়েদের কমিটি।

গঠনতন্ত্রের যে ধারা নিয়ে কথা উঠেছে সেটি শিল্পী সমিতির গঠনতন্ত্রের ৫(ক) ধারা। যেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে, বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া ন্যুনতম পাঁচটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে অবিতর্কিত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করতে হবে।

কার্যকরী পরিষদের আবেদন গৃহিত হলে তবেই তিনি পূর্ণ সদস্যপদ পাবেন। ভোটের অধিকার এবং কার্যকরী পরিষদের যে কোনো পদের জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। আর আবেদনকারীকে অবশ্যই পেশাগতভাবে চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী হতে হবে।

এ ধারাকে সামনে এনেই ১৮১ জন পূর্ণ সদস্যের ভোটাধিকার বাদ করে তাদের সহযোগী সদস্য করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে আবার গঠনতন্ত্রের এ ধারার বাইরে গিয়ে বেশ কিছু শিল্পীকে সদস্য করা হয়েছে। যাদের অধিকাংশেরই পাঁচটি ছবি মুক্তি পায়নি। এর মধ্যে রয়েছেন ডি এ তায়েব, যার মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ২, মিষ্টি জান্নাতের ছবির সংখ্যা ৪, আসিফ নূরের ছবির সংখ্যা ৩, বেগম প্রেমার ছবির সংখ্যা ৩, বিন্দিয়া কবিরের ছবির সংখ্যা ৩, আরিয়ান শাহ ছবির সংখ্যা ২, শ্রাবণ খানের ছবির সংখ্যা ২, জেবা চৌধুরীর ছবির সংখ্যা ১।

এছাড়াও নতুন সদস্য ও ভোটাধিকার দেয়া শিরিন শিলার মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা ৪, এইচ আর অন্তরের ১, সানজু জনের ৪, অনন্ত জলিলের ৩, তানহা তাসনিয়ার ৩ এবং চিত্রনায়িকা জলিরও ৩টি ছবি মুক্তি পেয়েছে।

এ তালিকায় আরও অনেক শিল্পীই রয়েছেন যাদের গঠনতন্ত্র মোতাবেক ৫ পাঁচটি ছবি মুক্তি না পেয়েও ভোটাধিকার দেয়া হয়েছে। আসছে নির্বাচনে তারা ভোটও দেবেন।

আবার একই নিয়মে চিত্রনায়িকা অধরা খানকে দুটি ছবির প্রধান নায়িকা হওয়া সত্বেও বাদ দেয়া হয়েছে। একই ধারায় নায়ক শান, ফিরোজ শাহকেও বাদ দেয়া হয়েছে। বেদনার বিষয় হলো শাকিব খান ও অমিত হাসানের আমলে ৫০ হাজার টাকা ফি দিয়ে ভোটার হয়েছিলেন শান। মিশা-জায়েদ ক্ষমতায় এসে তাকে বাদ দিয়েছে। কিন্তু তার ৫০ হাজার টাকার কোন রফা করেনি এ কমিটি।

শান বলেন, ‘ভোটারও হতে পারলাম না, ৫০ হাজার টাকারও কোনো হিসাব পেলাম না। চলচ্চিত্রের একজন নিবেদিত মানুষ আমি। এখানে সবাইকে ভালোবাসি, সম্মান করি। আমার সঙ্গে এ ধরনের বিমাতাসুলভ আচরণ আমি মিশা-জায়েদ কমিটির কাছে আশাও করিনি।’

এদিকে সমিতির সদস্য পারভীন ও মিজানুর রহমান যথাক্রমে ২০০ এবং দুই হাজারেরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। সমিতির প্রায় শুরু থেকেই ভোট দিয়ে আসছেন তারা। তাদেরও বাদ দেয়া হয়েছে ভোটার তালিকা থেকে। সম্প্রতি সাংবাদিকদের কাছে ভিডিও সাক্ষাতকারে পারভিন বলেন, ‘আমি যতগুলো ছবিতে অভিনয় করেছি জায়েদ খান ততগুলো ছবি সাইনও করতে পারেনি।

সেই জায়েদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আমাদের লাথি দিয়ে বের করে দিয়েছে শিল্পী সমিতি থেকে। বলে, আমরা নাকী শিল্পী না। নায়ক-নায়িকার সঙ্গে সহযোগি চরিত্রে কাজ করলে সে শিল্পী হয় না এটা কোন ধারায় লেখা আছে? আমরা রাজ্জাক-আলমগীর সাহেবদের সঙ্গে কাজ করেছি। তারাও আমাদের আদর করতেন, পছন্দ করতেন। আর এখন সমিতিতে ঢুকলে মনে হয় কারো অফিসে ঢুকেছি। ভাবসাবই আলাদা। তাদের নাকি স্যার বলতে হবে। এগুলো শিল্পীদের মধ্যে ছিলো না আগে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মিজু ভাই ও আহমেদ শরীফ ভাই একপদে নির্বাচন করেছেন। আমরা অনেকেই আহমেদ শরীফ ভাইকে ভোট দিইনি। তাই বলে আহমেদ শরীফ ভাই পাশ করে কী আমাদের বের করে দিয়েছিলো? না খারাপ আচরণ করেছিলো? আর এখন শুধু রাজনীতি আর রাজনীতি। গলা ভরা সব হিংসা। কেউ কোনো কথা বলে না। এই যে সবার চোখের সামনে আমাদের অনেকের ভোটাধিকার বাতিল করা হলো এটাও নিয়েও কেউ কথা বলছে না। এজন্যই অন্যায় বেশি হচ্ছে।’

এতসব অভিযোগের বিষয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন সমিতির গত মেয়াদের সভাপতি মিশা সওদাগর। আজ শনিবার কিছু গণমাধ্যমে মিশা সওদাগর বলেন, ‘ভোটার নিয়ে যা কিছু হয়েছে তা আমাদের একক সিদ্ধান্ত নয়। কার্যকরী পরিষদের সদস্য ও উপদেষ্টা পরিষদ মিলেই ভোটার তালিকা সংশোধন করা হয়েছে। তবে সংশোধনের এ তালিকায় কিছু আসল সদস্যও বাদ পড়েছে হয়তো। মানুষ তো ভুলের উর্ধ্বে নয়। চাল বাচতে গেলে তো কিছু ভালো চালও পড়ে যায়। আমাদের বেলায়ও হয়তো এমন কিছু হয়েছে। এজন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। পরেরবার ক্ষমতায় এলে এগুলোর সংশোধন আনার চেষ্টা অবশ্যই করবো।’

তবে মিশার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন কমিটির সহসভাপতি চিত্রনায়ক রিয়াজ। তিনি বলেন, ‘এটা কখনো হতে পারে না একেকজনের জন্য একেক নিয়ম। যাদের বাদ দেয়া হয়েছে তারা কী শিল্পী না? তারা কেনো ভোট দিতে পারবে না?’

চিত্রনায়ক ফেরদৌস বলেন, ‘ভোটের বাণিজ্য চলছে আসলে। একটি অলাভজনক সংগঠনে এমন অনিয়ম কেউ মেনে নেবে না। সেজন্যই কথাগুলো উঠছে। অনেক কিছুতেই ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোই এখন দেখা যাচ্ছে। শিল্পীদের সঙ্গে অন্যায় হলে শিল্পীরা তার জবাব দেবে।’

চলতি নির্বাচনের প্রধান কমিশনার ইলিয়াস কাঞ্চন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণই কমিটির বিষয়। যদি অনিয়ম বা নীতির পতন ঘটেও থাকে আমার কিছু বলার নেই। কারণ আমার কাজ নির্বাচনটা শেষ করা। শিল্পীদের সাথে অন্যায় হয়েছে কেবলমাত্র তারাই এর প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করতে পারে। এটা কমিটি ও শিল্পীদের বিষয়।’

তবে মিশা-জায়েদের কমিটি ছাড়াও গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে একাধিক শিল্পীকে পূর্ণ সদস্যপদ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে ২০১৬-১৭ মেয়াদের শাকিব-অমিত কমিটির নামেও। অনেকে দাবি করেন, মূলত সেই আমলেই এই অনিয়মের শুরু। যার বলি হয়েছেন অনেকেই মিশা-জায়েদের আমলে এসে।

২০১৭ সালের ৫ মে নির্বাচনের ঠিক আগে ৮২ জনকে নতুন পূর্ণ সদস্যপদ দিয়ে ভোটাধিকার দেয় শাকিব-অমিত কমিটি। এ অভিযোগ শিল্পী সমিতির বর্তমান কমিটিরও। অনেক সদস্যরাও ভোটাধিকারের দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন শাকিব-অমিত কমিটির দিকে।

তবে চলচ্চিত্রের অন্যান্য সংগঠন ও ব্যক্তিরা এইসব সমালোচনার অবসান চান। তাদের মতে, সবরকম নোংরামি ও সমালোচনা থেকে শিল্পীদের বাইরে থাকা উচিত।

এলএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।