সালমান শাহের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিলো দেবর ভাবির : শাবনাজ

লিমন আহমেদ
লিমন আহমেদ লিমন আহমেদ , বিনোদন প্রধান
প্রকাশিত: ১২:১৮ পিএম, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

শাবনাজ! ঢাকাই সিনেমায় নব্বই দশকের অনন্য এক নায়িকার নাম। রূপ, সৌন্দর্য, অভিনয় দিয়ে সাফল্যের শিখড়ে পৌঁছেছিলেন। ১৯৯১ সালে ‘চাঁদনী’ সিনেমা দিয়ে তার অভিষেক। টানা কাজ করেছেন ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। ২০টির মতো ছবিতে তিনি হাজির হয়েছেন বৈচিত্র্যময় চরিত্রে৷ তারমধ্যে তিনটি ছবিতে অমর নায়ক সালমান শাহের নায়িকা হয়েছেন। সালমানকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে সালমান শাহকে নিয়ে তার ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মৃতিচারণ করলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। জানিয়েছেন সালমানের অনেক অজানা কথা। তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতার চুম্বকাংশ তুলে ধরেছেন লিমন আহমেদ

জাগো নিউজ : ক্যারিয়ারের শেষদিকে সালমান শাহের সঙ্গে আপনি তিনটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। নায়ক হিসেবে সালমানকে আপনি কেমন দেখেছেন?
শাবনাজ : এক কথায় অসাধারণ। স্টারডম ছিলো আকাশ ছোঁয়া। অহংকার ছিলো না। সবাইকে সম্মান করে কথা বলতো। সিনিয়রদের প্রতি তার ব্যবহার ছিলো দারুণ। আমরা সমবয়সী ছিলাম। কিন্তু সিনেমায় ওর আগে এসছি সেটা সে মূল্যায়ণ করতো। ও যখন শুনতো আমি সেটে এসে গেছি দেরি করতো না৷ সদালাপী, আড্ডাবাজ ছিলো। ভিষণ ডানপিটে। শুটিং সেটে সালমান থাকা মানেই হাসি আনন্দ লেগে থাকা।

আর নায়ক হিসেবে ও ছিলো সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে, আধুনিক মানসিকতার একটা ছেলে। ওর স্টাইল, ফ্যাশন সবকিছুই আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জন্য নতুন আর ইউনিক ছিলো। চলাফেরা, কথাবার্তা, তাকানো, হাসা- সবকিছুতেই একটা উন্নত রুচির ছাপ সে মেইনটেইন করতো। এ কারণেই ও অন্য নায়কদের থেকে নিজেকে আলাদা করতে পেরেছিলো৷

তবে এটা ঠিক, সিনেমায় সালমানের স্টাইল-আধুনিকতার মূলে ছিলো ওর স্ত্রী সামিরা। ও অনেক বনেদি পরিবারের মেয়ে। ফ্যাশন সচেতন। দেশ বিদেশ ঘুরেছে, অনেক কিছু দেখেছে, শিখেছে। নিজে ফিটফাট থাকতো। নিজের মতো করে সে তার স্বামীকেও প্রেজেন্ট করতে চাইতো। সিনেমায় সালমানের ফ্যাশন ডিজাইনার ওই ছিলো। সালমান কোন দৃশ্যে কী পড়বে, মেকাপ কেমন হবে ঠিক করে দিতো। শুধু সালমান নয়, সালমানের অনেক নায়িকার স্টাইল, পোশাক-মেকাপ সামিরা করতো। শাবনূরকেও আমূল বদলে দিয়েছিলো সামিরা। সালমানের সঙ্গে ম্যাচ করে করে কাপড়ের ডিজাইন সামিরাই করে দিতো শাবনূরকে।

জাগো নিউজ : সালমান শাহের সঙ্গে আপনি মায়ের অধিকার, আঞ্জুমান ও আশা ভালোবাসা এ তিনটি ছবি করেছেন। এগুলো কী ব্যবসায়িকভাবে সফল ছিলো?
শাবনাজ : হ্যাঁ। প্রথমে আমাদের আঞ্জুমান ছবিটি মুক্তি পায়। এ ছবিটি আমার খুব প্রিয়। বেশ দারুণ একটা গল্প এখানে। এরপর আসে আশা ভালোবাসা। সবশেষে মায়ের অধিকার। এই ছবিটি তো ব্লকবাস্টার হিট হয়।

জাগো নিউজ : আপনাদের মধ্যে সম্পর্কটা কেমন ছিলো?
শাবনাজ : আমাদের সম্পর্কটা বেশ মজার ছিলো। দেবর ভাবির। নাঈমের স্ত্রী হিসেবে সালমান আমাকে ভাবি বলেই ডাকতো। সেই সম্মানটাও করতো সে। আবার আমরা ভালো বন্ধুও ছিলাম। অনেক মজা করতাম কাজ করতে গিয়ে।

জাগো নিউজ : সালমানের সঙ্গে আপনার প্রথম দেখা ও পরিচয় কোথায় কীভাবে?
শাবনাজ : এটা বেশ মজার একটা গল্প৷ প্রথমে কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমাটি করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো আমাকে আর নাঈমকে। তখন আমাদের জুটি টিনএজদের কাছে খুব পপুলার৷ কিন্তু সেই সময় আমরা দুজনে লাভ নামের ছবিটা করছিলাম। একে তো শিডিউল দেয়া ছিলো তারউপর লাভ ও কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবি দুটোর গল্প কাছাকাছি। তাই করা হয়নি। পরে সালমান আর মৌসুমী করলো। আরও মজার একটা ব্যাপার হলো যে চাঁদনী ছদি দিয়ে আমার অভিষেক হলো সেটা মৌসুমীর করার কথা ছিলো। কোনো কারণে ও করেনি, ভাগ্যচক্রে সেটা দিয়ে আমি শুরু করি।

সালমানের সাথে দেখাটা ছিলো কেয়ামত থেকে কেয়ামতের সেটে। যেদিন ছবিটার শুটিং শুরু হবে সেদিন সোহানুর রহমান সোহান ভাই ডাকলেন, ‘বললেন আসো। আমি ছবিটা শুরু করছি নতুন একটা জুটি নিয়ে৷’ উনার আমন্ত্রণে আমি আর নাঈম ফুল নিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়েছিলাম। সেখানেই প্রথম আমি সালমানকে দেখি। এরপর অনেকবার দেখা হয়েছে। তেমনভাবে কথা হতো না৷ পরে যখন আমরা জুটি হলাম তখন একটা আন্তরিকতা তৈরি হলো৷

জাগো নিউজ : নায়ক সালমান শাহ ও মানুষ সালমান শাহ'র মধ্যে কাকে বেশি এগিয়ে রাখবেন?
শাবনাজ : দুই সত্তাতেই সালমান শাহ অপূর্ব একজন। নাচে, অভিনয়ে সালমান চমৎকার ছিলো। লক্ষ করে দেখবেন আমাদের সিনেমাগুলো ছিলো অনেকটা যাত্রার মতো। লাউডলি সংলাপ বলতাম সবাই। কিন্তু সালমানের সংলাপ দেয়ার স্টাইলটা ভিন্ন ছিলো। এটা সে ছোটপর্দা থেকে শিখে এসেছিলো। হুমায়ুন ফরীদি ভাইও সংলাপ বলতেন একটু অন্যরকম। এটা নাটকের স্টাইল। সালমান এখানেও অন্য নায়কদের চেয়ে আলাদা ছিলো। নায়ক হিসেবে সে যেমন ছিলো প্রিয়, মানুষ সালমানকেও পছন্দ করতাম। সবাই করতো। ওর মধ্যে মুগ্ধ করার একটা ব্যাপার ছিলো৷

জাগো নিউজ : সালমান শাহের তিনটি গুণ ও তিনটি দোষ?
শাবনাজ : ওর অনেক গুণের কথাই বলা যায়। স্মার্ট, আধুনিক, ফ্যাশন সচেতন অনেক গুণ সালমানের। বিশেষভাবে বলবো ও অনেক ভালো কলিগ ছিলো। অন্যদের বেলায় কেমন জানিনা, আমার বেলায় আমি ফিল করেছি খুব ভালো ও মিশুক সে। সেকেন্ড সালমানের মানবিকতা। ইন্ডাস্ট্রির অনেক লোককে ও সাহায্য করেছে। অর্থ দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে, নানাভাবে। মনটা বড় ছিলো। কেউ বিপদে পড়েছে শুনলেই এগিয়ে যেতো৷ ডনকে ওই লাইমলাইটে নিয়ে এলো। ওকে নায়ক বানানোর পরিকল্পনাও ছিলো সালমানের। সুযোগ পেলো না অকাল মৃত্যুতে। আর সবশেষে বলবো সালমান পরিচালকদের সম্মানের জায়গায় সচেতন ছিলো। পরিচালকদের নানা কিছু উপহার দেয়ার ছলটা সেই শুরু করেছিলো। বিদেশে গেলে এটা সেটা নিয়ে আসতো। কলমে নিজের নাম লিখিয়ে নিয়ে আসতো পরিচালকদের উপহার দেয়ার জন্য। পরিচালক বা টেকনিশিয়ানদের সাথে সুসম্পর্ক ছিলো তার।

আর দোষের কথা বললে বলবো- ওর ইমোশনটা ছিলো অনেক বেশি। ইমোশন মানুষ মাত্রই থাকে। কিন্তু কেউ কেউ সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। সালমান পারতো না। ও ইমোশন নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ওকে হয়তো আমরা আরও অনেকদিন পেতাম। ওর একটা ভালো ফ্যামিলি আমরা পেতাম। তারপর বলবো ওর লাইফটা রেগুলার ছিলো না৷ অগোছালো ছিলো ভীষণ৷ আমার কাছে সালমানের দোষ এই দুটোই।

জাগো নিউজ : অনেকেই বলে থাকেন মৃত্যুর পর সালমান শাহের নাম বেশি ছড়িয়েছে। বা তারকাখ্যাতি এসেছে। আপনিও কী তা মনে করেন?
শাবনাজ : একদমই না। ও বেঁচে থাকতেই অনেক জনপ্রিয় ছিলো। ওর শুরুটাই তো হলো ব্লকবাস্টার হিট সিনেমা দিয়ে৷ তারপর সে অনেক হিট সিনেমা দিয়েছে৷ শাবনূরের সাথে ওর জুটি তুমুল জনপ্রিয় ছিলো এটা কে না জানে। আমার ছবিগুলোও ব্যবসা করেছে, অন্য নায়িকাদের সাথেও সে হিট সিনেমা করেছে। অল্পদিনে সে নিজেকে প্রমাণ করেছিলো। টিনএজদের কাছে সালমান ক্রেজ ছিলো। তখন তো আর এতো টিভি, পত্রিকা, ফেসবুক ছিলো না। জনপ্রিয়তা বা ক্রেজটা বোঝা যেত সিনেমা হলে৷ যারা বলে মৃত্যুর পর সালমানের খ্যাতি এসেছে তারা ভুল বলে। হ্যাঁ, যেটা হয়েছে তা হলো অকাল মৃত্যু সালমানকে চিরসবুজ করে রেখেছে। ওর বয়স বাড়বে না কোনোদিন দর্শকের কাছে।

জাগো নিউজ : সালমানের স্ত্রী বা মায়ের সঙ্গে কী পরিচয় ছিলো?
শাবনাজ : সালমানের মায়ের সঙ্গে আমার তেমন করে আলাপ ছিলো না। দেখা হয়েছে। সালমানের বাবাকেও দেখেছি। এফডিসিতে আসতেন মাঝেমাঝে। সামিরাকে খুব ভাল চিনতাম। সালমানের সাথেই থাকতো প্রায় সময়। শুটিংয়ে দেখা হতো, আলাপ হতো। একবার বান্দরবানে শুটিং করতে গেলাম আমি আর সালমান। সামিরা সঙ্গে ছিলো। আমরা বেশ আড্ডা দিতাম৷ সালমানের মৃত্যুর পর অনেককিছু শুনেছি। কিন্তু সামিরাকে আমি সালমানের খুব ভালো স্ত্রী বা বন্ধু হিসেবেই দেখেছি। সিনেমায় সালমানের কীভাবে ভাল হবে, কীভাবে ভালো দেখাবে সেগুলো সামিরা দেখাশোনা করতো।

জাগো নিউজ : শাবনূরের সঙ্গে সালমানের প্রেম নিয়ে অনেক মুখরোচক গল্প শোনা যায়। তাদের সম্পর্ক নিয়ে আপনি কিছু বলবেন?
শাবনাজ : একসঙ্গে কাজ করতে গেলে নায়ক নায়িকার সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথাই হয়। তারা একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করেছে৷ একটা ভাল বন্ধুত্ব নিশ্চয় ছিলো৷ এটা তো আমার সাথেও ছিলো৷ কিন্তু এর বেশি কোনোকিছু আমি দেখিনি। যা দেখিনি সেটা আমি বলতে পারবো না। বলা ঠিক হবে না।

জাগো নিউজ : একজন নায়ক মারা গেছেন ২৩ বছর পার হয়ে গেল। এখনো তার জন্য কাঁদেন ভক্তরা। কেক কেটে, মিলাদ দিয়ে তার জন্ম-মৃত্যুদিন পালন করে হাজার হাজার ভক্ত। এখনো কোনো হলে সালমানের সিনেমা প্রদর্শিত হলে দর্শকের ভিড় নামে। সালমান শাহ নিয়ে এই যে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষের এই ভালোবাসা এটাকে কীভাবে দেখেন আপনি?
শাবনাজ : এটা যে কোনো নায়ক বা নায়িকার জন্য স্বপ্নের মতো প্রাপ্তি। কাউকে জোর করে মনে রাখানো যায় না। আজকাল কে কাকে মনে রাখে বলুন। আমরা অনেক বড় বড় মানুষের অবদান ভুলে গেছি, ভুলে যাচ্ছি। অনেক কীর্তিমানকে স্মরণ করছি না৷ সেখানে সালমানের ভক্তরা তাকে মনে রেখেছে যুগের পর যুগ, এইটা চারটিখানি কথা নয়। আমার দারুণ লাগে৷ সালমানের নায়িকা হিসেবে আমার প্রতি আলাদা একটা আগ্রহ লক্ষ করি মানুষের। এটাও ভাল লাগে। ইন্ডাস্ট্রি বা রাষ্ট্র সালমানের মতো চার বছরের একটা ধুমকেতুর জন্য কী করলো না করলো তারচেয়েও বড় বিষয় হলো, মানুষ সালমানকে মনে রেখে দিয়েছে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে গেছে সালমানের আবেদন। এইটা সাংঘাতিক ব্যাপার। এমন মনে রাখার ইতিহাস বা উদাহরণ বিশ্ব চলচ্চিত্রের আঙ্গিনায় খুব বেশি নেই।

আমি সালমানের সকল ভক্তদের ধন্যবাদ জানাই। তাদের বলবো সালমানের আত্মার জন্য দোয়া করবেন। সে যেন ভাল থাকে।

এলএ/এমএবি/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।