ব্যাংকার থেকে মহানায়ক হওয়া কিংবদন্তি তিনি
বাংলা চলচ্চিত্রের সাদাকালো যুগে তিনি অভিনয় করতেন। সাদাকালো পর্দার অভিনেতা হয়েও তিনি কালের সীমানা পেরিয়ে রঙিন হয়ে আছেন। সুদর্শন নায়ক বলতে যে’কজন সত্তর-আশির দশকে বাঙালি দর্শকের মন জয় করেছেন, তরুণী-যুবতীদের স্বপ্নের পুরুষ হয়েছেন, তাদের অন্যতম বুলবুল আহমেদ।
ঢাকাই চলচ্চিত্রের ‘মহানায়ক’ তিনি। ঢাকাই সিনেমার প্রথম ও সফল দেবদাসও তিনি। আজ তার ৭৮তম জন্মদিন। ১৯৪১ সালের আজকের এই দিনে তিনি জন্মেছিলেন পুরান ঢাকার আগামসি লেনে। তার আসল নাম তাবারক আহমেদ। বাবা-মা আদর করে বুলবুল বলে ডাকতেন।
বুলবুল আহমেদ পড়াশোনা করেছেন ঢাকার কলেজিয়েট স্কুল, নটরডেম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে কিছুদিন সিলেট এমসি কলেজেও পড়াশোনা করেছেন।
বুলবুল আহমেদ বিয়ে করেছিলেন অভিনেত্রী ডেইজি আহমেদকে। এই দম্পতির তিন সন্তান। তারা হলেন, মেয়ে ঐন্দ্রিলা ও তিলোত্তমা এবং ছেলে শুভ।
পড়াশোনা শেষে তৎকালীন ইউবিএল ব্যাংক টিএসসি শাখার ম্যানেজার হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। তবে শেষপর্যন্ত নিজেকে অভিনয়েই জড়িয়ে নেন। জানা যায়, সিলেট এমসি কলেজে থাকাকালে মঞ্চনাটক চিরকুমার সভায় কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অভিনয় করে উপস্থিত সবার নজর কাড়তে সক্ষম হন তিনি।
এরপর টেলিভিশন নাটকে যুক্ত হন ব্যাংকে চাকরি করাকালীন। আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় ‘বরফ গলা নদী’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন বুলবুল। এটি ১৯৬৪ সালে প্রচারিত হয়। এরপর একে একে তিনি প্রায় চার শতাধিক নাটকে অভিনয় করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- মালঞ্চ, ইডিয়েট, মাল্যদান, বড়দিদি, আরেক ফাল্গুন, শেষ বিকেলের মেয়ে।
বুলবুল আহমেদের চলচ্চিত্র জীবন শুরু হয় ১৯৭৩ সালে আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমামের (ইউসুফ জহির) ‘ইয়ে করে বিয়ে’ ছবির মাধ্যমে। এই ছবিতে তার অভিনয় আলোচিত হয়। যার ফলে পরের বছর আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘অঙ্গীকার’ ছবিতে অভিনয় করেন। এটিও দারুণ সাফল্য পায়। আর পেছনে ফিরে তাকাননি এই অভিনেতা। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে জয় করে নিয়েছেন কোটি মানুষের মন আর নাানা সাফল্য।
বুলবুল আহমেদ ‘মহানায়ক’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘সূর্য্য কন্যা’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘জীবন নিয়ে জুয়া’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘বধূ বিদায়’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘দি ফাদার’ নামে অসংখ্য চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। তবে বুলবুল আহমেদ বাংলা চলচ্চিত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘দেবদাস’ ও ‘মহানায়ক’ ছবি দিয়ে। এই ছবিগুলো তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।
বুলবুল আহমেদ তথাকথিত কপিরাইট বা অনুকরণ করা গল্পের স্রোতে গা ভাসাননি। তিনি সবসময়ই মৌলিক ছবিকে প্রাধান্য দিতেন। তার চলচ্চিত্রগুলো তার সমসাময়িক অন্য নায়কদের থেকে অনেকটাই আলাদা। তার চলচ্চিত্রগুলোতে দর্শক শুদ্ধ রুচির পরিচয় পেতেন, সমৃদ্ধ হতো বিনোদনের মানসিকতা।
সেই ব্যতিক্রমী ভাবনার তৃষ্ণা নিয়েই নিজে চিত্রনাট্যও করতেন প্রায় সময়, নেমেছিলেন পরিচালনাতেও। আর পরিচালক বুলবুল আহমেদ সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী কয়টি চলচ্চিত্র। তার পরিচালিত ‘ওয়াদা’, ‘মহানায়ক’, ‘ভালো মানুষ’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘আকর্ষণ’, ‘গরম হাওয়া’, ‘কত যে আপন’ ছবিগুলো আলোচিত।
অভিনয়ের জন্য বুলবুল আহমেদ চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৭৭ সালে ‘সীমানা পেরিয়ে’, ১৯৭৮ সালে ‘বধু বিদায়’, ১৯৮০ সালে ‘শেষ উত্তর’ ও ‘১৯৮৭ সালে ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’ ছবির জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে নেন।
কে মনে রাখলো, কে রাখলো এইসব হিসেব কিংবদন্তিদের বেলায় অনেকটাই হাস্যকর। কাল জয় করা মানুষেরা থেকে যান সময়ের হিসেবে। সময় তাকে ঠিকই সম্মানিত করে চিরকাল। অদেখা ভুবনে ভালো থাকুন ঢাকাই সিনেমার ‘মহানায়ক’ ও এদেশের অভিনয়ের অহংকার বুলবুল আহমেদ।
এলএ/জেআইএম