নাটক সিনেমায় আইন আদালতের অবাস্তব উপস্থাপনা
নাটক সিনেমায় যে আদালত ব্যবস্থা বা বিচারক অথবা উকিলদের চরিত্র দেখানো হয় তার সাথে বাস্তবের মিল কদাচিৎ। এসব চরিত্র লেখন ও অভিনয়ে কখনও কখনও রচয়িতা বা পরিচালকের গুরুতর অজ্ঞতা প্রকাশ পায়, অন্তত চরিত্রগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অথবা কাজের ধরন বা ব্যবস্থাটা এবং যে আইনটির প্রকাশ করা হচ্ছে তা সুক্ষ্মভাবে জেনে নেওয়া উচিত বলে মনে করি।
কদিন আগে এক লোক রাগতস্বরে অভিযোগ করলো, ‘স্যার টিভিত সিনেমাত দেখি মামলা একদিনেই শেষ হয়ে যায় আর আমার মামলা ২ বছর হয়ে গেছে কিছুই হয় না! বললাম, মামলাটা টিভির নাটক সিনেমার পরিচালককে দিয়ে করান তাহলেই হবে। বাস্তব আর টিভি এক না।’
অনেক বন্ধু বা পরিচিতজন আদালতে আসেন কীভাবে বিচার কাজ হয় আমরা কীভাবে কি করি তা দেখার জন্য। দেখার পর হতাশ হয়ে বলেন, টিভির সাথে তো কিছুই মিলে নাই জজ আর উকিল ছাড়া!
আদালত নামে একটা সিরিয়াল হয় সনি ৮ চ্যানেলে, অনেকে ওইটা দেখার পরামর্শ দেন। তাহলে নাকি অনেক কিছু শেখা যাবে। মাথা গরম হয়ে যায় এটি শোনার পর। তারপরও একদিন চোখের সামনে সিরিয়ালের কিছু অংশ দেখলাম, উকিল কে ডি পাঠক চাঁদের দেশের খুন নিয়ে জেরা করছেন আর সত্য বের করছেন। মনটাই খারাপ হয়ে গেল অসদৃশ্য আদালতের বিচার সিস্টেম আর সাক্ষী জেরার কল্পনা বিলাসিতা দেখে।
সাক্ষীর কোনটা জবানবন্দি কোনটা জেরা আর কোনটা যুক্তিতর্ক কিছুই বুঝলাম না। টিভির পর্দায় সাসপেন্স বাড়ানোর জন্য এটি করা হয়েছে। দর্শক যারা তাদের ধারণা আদালত সম্পর্কে খুবই কম। যে কারণে কাল্পনিক ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ মানুষ এত আগ্রহ ও নেশাসক্ত হয়ে দেখছে।
এক মক্কেল একদিন জিজ্ঞেস করছে, ‘স্যার কে ডি পাঠক কি বাইচ্চা আছে না মরে গেছে?’ ওই কে ডি পাঠকের জনপ্রিয়তা আমি তখন আন্দাজ করলাম। লোকে তার মৃত্যু নিয়েও চিন্তিত খুব।
আলাউদ্দিনের ফাঁসি নাটক দেখছিলাম। বিচারককে যে পোশাকে বিচারকের আসনে বসানো হয়েছে তা ভুল। সাক্ষীর জেরাকে বারবার নাটকে আরগুমেন্ট বা যুক্তিতর্ক হিসেবে বলা হচ্ছিল। আরও অনেকগুলো অসামঞ্জস্যতা চোখে পরার মতো। বৈসাদৃশ্য লেগেছে আমি জানি বলে, কিন্তু যারা জানে না তারা ওইসব ভুল বার্তাই আগ্রহ নিয়ে গিলছেন।
কলকাতার চলচ্চিত্র ‘মুক্তধারায়’ আসামির অপরাধ বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তার সব চেয়ে বড় অপরাধ সে অপহরণকারী। এছাড়াও সে খুনসহ আরও অনেক অপরাধের সাথে জড়িত। আরে ভাই খুনের চাইতে অপহরণ বড় অপরাধ কেমন করে হয়? অপহরণের মাধ্যমে খুন করলেও বিচারে খুনের সাজা হবে।
আরেক চলচ্চিত্রে দেখাচ্ছে, নায়ক চলচ্চিত্রে উকিলের পোশাক পরে শুটিং করে মনের দুঃখে বাবার চেম্বারে বসে আছে, কোনো একটা মামলায় সে ন্যায়বিচার এনে দিলো অভিনয় দক্ষতায়। তার বিনিময়ে সে পরবর্তীতে নিয়মিত উকিল হয়ে অভিনয় করছে দিনের পর দিন। এটা হাস্যকর! তার ওপর যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তার কিছুই আদালতের বা আইনের ভাষা নয়।
‘আয়নাবাজি’ ছবিতে দেখতে পাই, আসামিকে জামিন দেওয়ায় সে কাঠগড়ায়ই নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। আরে ভাই এমন বাস্তবে করলে আদালত অবমাননা হয়ে যাবে। তারপরও আমরা সিনেমা বলে ধরে নিচ্ছি ওকে।
বাংলা ছবিতে খুবই কমন একটা আদালত দৃশ্য হচ্ছে বিচার চলা অবস্থায় হঠাৎ করে রক্তাক্ত কেউ হাজির হয়ে যায় এবং আদালত তার সাক্ষী গ্রহণ করে সাথে সাথে বিচার কাজ শেষ করে ফেলে। যাই হোক সিনেমার প্রয়োজনে আমরা এসব বুঝে নিচ্ছি।
নারী নির্যাতন আইনে ধর্ষণের মামলায় ১৪ বছরের জেলের কোনো বিধান নেই কিন্তু এটি অনেক বাংলা সিনেমায় মুখে মুখে বলে ফেলেন।
সিনেমায় দেখা যায়, সাক্ষী জেরা, প্রমাণ উপস্থাপনসহ আরগুমেন্ট সব বিষয় একই স্টেপে দেখানো হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিটি আলাদা আলাদা স্টেপ। ক্লাইমেক্সের জন্য প্রতিটি কথায় আরগুমেন্ট উপস্থাপন করলে তো হলো না।
এমন আরও অনেক অসামঞ্জস্য ঘটনা দেখা যায়, যা লিখে শেষ করা যাবে না। আমি আইনজীবী এই কারণে হয়তো এসব আমার কাছে হাস্যকর লাগে, যারা জানে না তাদের কাছে এসব অনেক ক্লাইমেক্স, সাসপেন্স ও অসাধারণ লাগতে পারে।
মিডিয়ায় এ ব্যবস্থাগুলো উপস্থাপন করার আগে তা সম্পর্কে ভালো করে জেনে নেয়া, বুঝে প্রকাশ করা উচিত। হ্যাঁ, কিছু বিষয় অবাস্তব, কাল্পনিক উপস্থাপন অবশ্যই করা যাবে প্রয়োজনে, তবে আদালতের বিচারব্যবস্থা আইনজীবীর কাজের পদ্ধতি, আইনের সঠিক ব্যাখা প্রদান করা উচিত।
মানুষকে এ বিষয়গুলো নিয়ে ভুল উপস্থাপন বা ব্যাখা করলে অবশ্যই তা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে সমাজে। প্রয়োজনে টিভি সিনেমায় আদালত ব্যবস্থা উপস্থাপনের একটি গাইডলাইন করে দেয়া যেতে পারে। অশোভন, কাল্পনিক, আকাশ কুসুম ও অসামঞ্জস্যতার মাধ্যমে আইনের ভুল ব্যাখা কাম্য নয় কোনোভাবেই।
লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, ময়মনসিংহ।
এলএ/এমকেএইচ