সুনীলের পৈতৃক ভিটার স্মৃতি রক্ষিত হয়নি

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সালাহ উদ্দিন মাহমুদ , লেখক ও সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১২:৪৩ পিএম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫

এপার বাংলা-ওপার বাংলার জনপ্রিয় কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মদিন ৭ সেপ্টেম্বর। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশে, বিখ্যাত হয়েছেন কলকাতায়। অবশ্য কবি দুই বাংলাকেই এক করে দেখেছেন- এক বাংলা হিসেবে কামনাও করেছেন আমৃত্যুূ।

সুনীলকে নিয়ে কলকাতার যতটা গর্ব, আমাদেরও তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমরাও দাবি নিয়ে বলতে পারি, সুনীল আমাদের। আমরা তাকে ভালোবেসেছি, তিনি আমাদেরও মনের মানুষ।

সে দাবির সাথে আরো যোগ হয়েছে তার জন্মভিটার স্মৃতি রক্ষার। কেননা কবি ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার আমগ্রামের মামাবাড়িতে। তাঁর পৈতৃক নিবাস কালকিনি উপজেলার কাজী বাকাই ইউনিয়নের মাইজপাড়া গ্রামে। দেশ বিভাগের আগেই ১০-১১ বছর বয়সে কষ্ট আর অভিমান নিয়ে পরিবারের সঙ্গে চলে যান ভারতের কলকাতায়।

দেশান্তরী হওয়ার অনেক বছর পর প্রথম এসেছিলেন ২০০৩ সালে। যখন সুনীলের সুখ্যাতি দিকে দিকে। মাদারিপুরের ইতিহাস গবেষক ডা. এমএ বারী নিজ উদ্যোগে খুঁজে বের করলেন তার জন্মস্থান। সুনীলের পৈতৃক ভিটাও তখন মানুষের দখলে। ডা. বারীর চেষ্টা আর প্রবাসী লেখক আ. রাজ্জাক হাওলাদারের সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয় কবির জন্মভিটা। তারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাকে জন্মভিটায় নিয়ে আসতে। কলকাতায় যোগাযোগের পর তিনি নিজের জন্মস্থানে আসতে সম্মতি প্রকাশ করেন। তার পদধূলিতে ধন্য হয় মাদারিপুরের মাটি। এ অঞ্চলের ভক্ত-অনুরাগীরা পেয়েছেন তার দর্শন ও সান্নিধ্য।

এরপর সর্বশেষ ৭৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ২০০৮ সালের ২১ নভেম্বর এসেছিলেন নিজ গ্রামে। তার জন্মবার্ষিকী ও আগমন উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। কবি সে আয়োজনে সীমাহীন খুশিও হয়েছিলেন। তখন তিনদিনব্যাপি ‘সুনীল মেলা’ বসেছিল। চারদিকে অফুরন্ত উচ্ছ্বাস। কবিভক্তদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল সেই গ্রাম। নাচ, গান, আবৃত্তি ও নাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন কবি।

তখন তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলাদেশের কবি বেলাল চৌধুরী ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনসহ বাংলাদেশ ও কলকাতার অনেক গুণীজন। কবি তিন দিন অবস্থান করেছিলেন কালকিনির মাইজপাড়ায়। ঘুরে ঘুরে দেখেছেন আর বাল্যকালের স্মৃতি হাতড়ে বেড়িয়েছেন। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন-‘কালকিনির মানুষের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি শুধু ওপার বাংলার কবি নই। আমি বাংলা ভাষার কবি।’

২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিনি আর আসবেন না মাদারীপুরের কালকিনি তথা বাংলাদেশে। তার স্মৃতিগুলোই শুধু রয়ে গেল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, তাঁর জন্মভিটার স্মৃতি সংরক্ষণে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যতটুকুই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল তাঁর জীবদ্দশায়, তাও এখন কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে।

এখনো তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে দাবিকৃত ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বালিগ্রাম ইউনিয়নের পাথুরিয়া পাড় থেকে মাইজপাড়া পর্যন্ত সড়কটি ‘সুনীল সড়ক’ নামে নামকরণ করা হয়নি! সুনীলের জন্মদিবসে আয়োজিত ‘সুনীল মেলা’ ২০১২ সালের পর আর চোখে পড়েনি! তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠিত সুনীল আকাশ গবেষণা কেন্দ্রের সংস্কার করা হয়নি!

সুনীল মেলা যাতে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন অনেকেই। স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা তার স্মরণসভায় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন।

মাদারীপুরে প্রবর্তিত একমাত্র সুনীল সাহিত্য পুরস্কারটাও গত তিন বছর ধরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক শাজাহান খান একা হাতে আগলে রাখতে পারেননি। পৃষ্ঠপোষক হেমায়েত হোসেন হাওলাদারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই।

সর্বশেষ ২০১১ সালে পুরস্কার বিতরণ করে সুনীল সাহিত্য ট্রাস্ট। তারপর লেখকদের কাছ থেকে লেখাও জমা নিয়েছে। কিন্তু আজও আলোর মুখ দেখেনি ‘সুনীল সাহিত্য পুরস্কার-২০১২’ ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা।

৭ সেপ্টেম্বর কবির জন্মদিন। অথচ গত দুই বছরে মাদারীপুরে তেমন কোনো আয়োজন ছিল না। আজও কোনো আয়োজন নেই। গত দুই বছরে ২৩ অক্টোবর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষেও কোনো আয়োজন লক্ষ্য করা যায়নি। তবে ২০১৩ সালের ২৩ অক্টোবর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল সুনীল সাহিত্য পুরস্কার ট্রাস্ট ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মাদারীপুর শাখা।

আমরা কথা রাখতে পারিনি। কবির কথাই সত্য হলো- ‘কেউ কথা রাখে না’। তাহলে এভাবেই কী আমাদের মাঝ থেকে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে সুনীল। সুনীল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তদের আশীর্বাদ বাক্যে কবি লিখেছিলেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে রই, চিরদিন, চিরকাল।’

তিনি তো আমাদের মাঝেই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন। অথচ আমরা ভুলে যাচ্ছি তাকে। তাহলে কী নাজিম হিকমতের মতোই বলতে হবে- ‘বিংশ শতাব্দীতে মানুষের শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।’

সুনীলের জন্মভিটার স্মৃতি রক্ষিত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সাহিত্যপ্রেমীরা। স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী এইচ এম মিলন বলেন, ‘আজ কবির জন্মদিন। তবে মাদারীপুরের কোথাও কোনো আয়োজন নেই। এমনকি তার জন্মভিটাতেও নেই। আমরা তাকে ভুলতে বসেছি।’

কবি দুলাল সরকার আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘কবির আগমনের সময় সামনে এসে যারা অতি আপন সেজেছিলেন, আজ তারা কোথায়? এই কি ভালোবাসার নমুনা। যতই দিন যায়; ততই যেন ম্লান হয়ে আসছে সুনীলের স্মৃতি।’

এসইউ/এলএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।