মৃত্যুর পর বাবার কথাই সত্যি হলো : সুবীর নন্দীর মেয়ে
পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন নন্দিত কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী। সিঙ্গাপুরে গত ৭ মে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ বুধবার, ৮ মে সকালে দেশে পৌঁঁছেছে তার মরদেহ।
জাতির পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে বুধবার সকাল ১১টায় শহীদ মিনারে নিয়ে যাওয়া হয় সুবীর নন্দীর মরদেহ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে শেষবারের মতো শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন নানা অঙ্গনের তারকা ও আপামর সাধারণ জনতা।
এ সময় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বাবার মৃতদেহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় সুবীর নন্দীর মেয়ে ফাল্গুনী নন্দীকে। তার চোখের দৃষ্টিতে বাবার হারানোর অসহায়ত্ব। মলিন মুখ। পৃথিবীর সেরা প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে তিনি শোকে কাতর।
তবু গণমাধ্যমের অনুরোধে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে কথা বললেন। ফাল্গুনী বলেন, ‘আমাদের কেউ আর রইলো না। বিশেষ করে আমাকে সারাক্ষণ আগলে রাখতেন বাবা। কলিজার চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। আমার একটু কষ্ট হলে পাগল হয়ে যেতেন।
আমাকে পড়াশোনা করিয়েছেন। কিন্তু আমি যখন চাকরি করতে চাইলাম দিলেন না। বললেন আমার নাকি কষ্ট হবে। এই যে এখন আমাকে রেখে চলে গেলেন আমার এত খেয়াল কে করবে!’
চোখ মুছতে মুছতে ফাল্গুনী আরও বলেন, ‘অবশ্য বাবা জীবনের শেষ দিনগুলোতে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়ে গেছেন। লড়াই করা শিখিয়েছেন। শেষ ২৪টা দিন বাবা জীবনের জন্য মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করেছেন। তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে সেটা খুব কাছ থেকে দেখলাম। তার এই লড়াই যেন তিনি আমার জন্য শিক্ষা হিসেবে রেখে গেলেন। এখন মনে হয় আমি বাবাকে ছাড়াই একা চলতে পারবো। সব করতে পারবো।’
ফাল্গুনী তার বাবার দেশপ্রেমের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘বাবা এই দেশের প্রেমে অন্ধ ছিলেন। তিনি গর্ববোধ করতেন বাংলাদেশি হিসেবে। একবার তার খুব অসুখ। আমেরিকায় উন্নত চিকিৎসার সব বন্দোবস্ত হলো। তিনি গেলেন। কিন্তু চিকিৎসা শুরুর আগেই হাঁপিয়ে গেলেন। আমেরিকা ছেড়ে চলে এলেন।
আমার কানে এখনো বাজছে তিনি বলেছিলেন- সালাম আমেরিকা। আমি নিজের দেশে ফিরে গেলাম। সেখানে চিকিৎসা নেব। মরলে নিজের মায়ের কোলেই মরবো। তাকে বোঝানো যায়নি। দেশের প্রতি ভালোবাসার তার জেদ আমৃত্যু ছিল।
আমি বলতাম দেশ নিয়ে এত আবেগ কেন তোমার। তিনি বলতেন, ‘‘এই দেশের মানুষ ভালোবাসতে জানে, সম্মান করতে জানে। তিনি বলতেন কথায় কথায়, ‘দেখিস এই দেশ ও দেশের মানুষ তোর বাবাকে সম্মান করবে। এখানে গুণের কদর আছে।’’
আজ বাবার মৃত্যুর পর রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মানুষের যে ভালোবাসা আমি দেখছি তাতে বারবার ভাবছি বাবার কথাই তো সত্যি হলো। আজীবন মন থেকে ভালোবাসলে সেটা ফেরত পাওয়া যায়। বাবা পাচ্ছেন। এই দেশ ও দেশের মানুষ তার অুসস্থ হওয়া থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত হৃদয় উজার করে ভালোবাসা দিচ্ছেন। বাবা সেই ভালোবাসায় শান্তিতে ঘুমাবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ফাল্গুনী বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী। শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষদের প্রতি তার ভালোবাসার অনেক গল্পই জানি আমরা। কিন্তু আমার বাবাকে দিয়ে সৌভাগ্য হলো সেটা একান্তভাবে অনুভব করার। বাবার সুস্থতার জন্য অনেক আন্তরিকতা দেখিয়েছেন তিনি। আমি ও আমার পরিবার তার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ। একজন সুবীর নন্দীকে তিনি সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়েছেন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। তিনি সত্যিই অসাধারণ।
সেইসঙ্গে ডাক্তার সামন্ত লাল সেন কাকুর কাছেও আমি ও আমার পরিবার কৃতজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী তিনি বাবার জন্য অনেক কিছু করেছেন। কাকুর সৌজন্যবোধ, সহযোগিতা ও ভালোবাসা আমার পরিবার চিরদিন মনে রাখবে।’
প্রসঙ্গত, নন্দিত কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী ৪০ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গেয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি গান। বেতার থেকে টেলিভিশন, তারপর চলচ্চিত্রেও উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান। ১৯৮১ সালে তার প্রথম একক অ্যালবাম 'সুবীর নন্দীর গান' ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে বাজারে আসে। তবে চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম গান করেন ১৯৭৬ সালে আব্দুস সামাদ পরিচালিত 'সূর্যগ্রহণ' চলচ্চিত্রে।
চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করে চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। আর চলতি বছরে সংগীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার সুবীর নন্দীকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করেছে।
এমএবি/এলএ/জেআইএম