শ্রোতারা অস্থির বলেই গানের বাজার মন্দা


প্রকাশিত: ১১:৪৬ এএম, ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

কবির বকুল। দেশের স্বনামধন্য গীতিকবি। গান তিনি আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন। গীতিকার হিসেবে দেশে প্রচলিত প্রায় সব স্বীকৃতিই জয় করেছেন। তবে নিজে মনে করেন তার সবচাইতে বড় অর্জন শ্রোতাদের জন্য পাঁচ হাজারের মতো গান লিখতে পারা। সত্যি অসাধারণ এক মাইলফলক! ২০১৩ সালের সেরা গীতিকার হিসেবে চতুর্থবারের মতো জিতেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে মাস্টার্স করা এই গীতিকারের রয়েছে বিনোদন সাংবাদিকতারও পরিচয়।

জাগোনিউজের মুখোমুখি হয়ে কবির বকুল জানালেন এই পেশায় তার শুরু, পথচলা ও আগামীর গল্প। জানালেন বর্তমানে দেশীয় শোবিজে নানা বিষয়ের অভিজ্ঞতা। সঙ্গে ছিলেন লিমন আহমেদ

kobir bokul

জাগোনিউজ : আপনাকে আমরা একজন গীতিকবি হিসেবেই সম্মান করি। তবে আপনার সাংবাদিক পরিচয়টিও আমাদের অনুপ্রাণীত করে। শুরুতেই জানতে চাইব এ পেশায় কীভাবে আসলেন?
কবির বকুল : আমি ১৯৯২ সালে ‘মূলধারা’ নামের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা দিয়ে এ পেশায় আসি। সেখানে আমি মিউজিক নিয়ে লিখতাম। তবে সাংবাদিক হিসেবে আমার আনুষ্ঠানিক যাত্রা হয় ’৯৩ সালে ভোরের কাগজ দিয়ে। সেখানে বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। আমার করা প্রথম সাক্ষাতকারটি ছিলো প্রয়াত ব্যান্ডগুরু আজম খানকে নিয়ে। লেখার শিরোনাম ছিলো ‘কেমন আছেন আজম খান’।
kobir bokul
জাগোনিউজ : প্রথম আলোর সাথে কীভাবে জড়িত হলেন?
কবির বকুল : ভোরের কাগজ থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৯৮ সালে একটি টিম বর্তমানের সর্বাধিক জনপ্রিয় সংবাদপত্র প্রথম আলো প্রতিষ্ঠা করে। সেই টিমে আমিও ছিলাম। এখানে একটানা ২০১১ সাল পর্যন্ত কাজ করেছি। ওই বছরের ২৮ জুলাই আমি মাছরাঙায় যোগ দেই। অবশ্য এখন আমি প্রথম আলোতেই কর্মরত। পুনরায় এসেছি চলতি বছরের ১ জুন।

জাগোনিউজ : কোনো কিছু শুরু করতে গেলে কারো না কারো কাছ থেকে এ বিষয়ে দীক্ষা নিতে হয়। সেক্ষেত্রে সাংবাদিকতায় আপনার হাতেখড়ি কার কাছে?
কবির বকুল : কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। উনার কাছেই আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি।

জাগোনিউজ : আপনার প্রথম গান লেখার গল্পটা শুনতে চাই...
কবির বকুল : আমি ১৯৮৮ সালে আইয়ূব বাচ্চুর ‘ময়না’ অ্যালবামের জন্য প্রথম গান লিখেছিলাম। আর চলচ্চিত্রে ১৯৯৪ সালে ‘অগ্নি সন্তান’ ছবি দিয়ে যাত্রা শুরু। শ্রদ্ধেয় সঙ্গীত পরিচালক আবু তাহের ভাইয়ের হাত ধরে আমি এই সুযোগটা পেয়েছিলাম। তারপর থেকে...এই তো....

জাগোনিউজ : কোন গানের জন্য প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান?
কবির বকুল : নারগিস আক্তার পরিচালিত ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মেঘের কোলে রোদ’ ছবির জন্য একটি গান লিখেছিলাম। প্রয়াত সুরকার প্রণব ঘোষের সুরে ‘বলো না কেন ওই আকাশ নেমে আসে সাগরের বুকে’ শিরোনামে গানটি দিয়েই আমার প্রথম চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়। এতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন আসিফ আকবর, দিনাত জাহান মুন্নী ও রবি চৌধুরী। আর পর্দায় ঠোঁট মিলিয়েছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা রিয়াজ, টনি ডায়েস ও অভিনেত্রী পপি।

kobir bokul
জাগোনিউজ : সব মিলিয়ে চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। এখানে আপনার হ্যাট্রিক করারও সৌভাগ্য হয়েছে। কেমন লাগছে?
কবির বকুল : ২০০৮ সালের পর ২০০৯ সালে পি এ কাজল পরিচালিত স্বামী স্ত্রীর ওয়াদা চলচ্চিত্রের ‘একটা চাঁদ ছাড়া রাত আঁধার কালো’ গানের জন্য, ২০১০ সালে বদিউল আলম খোকনের নিঃশ্বাসে আমার তুমি চলচ্চিত্রের ‘রুপালি চাঁদ নেমেছে’ গানটির জন্য পুরস্কার পাই। পরপর তিনবার মিলে হ্যাট্রিক। খুব মজা পেয়েছিলাম সেবার। কাছের মানুষরাও দারুণভাবে উইশ করেছিলো। আসলে এগুলোই প্রতিদিনের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। স্বীকৃতি সবসময় আনন্দের। কার না ভালো লাগে কাজের মূল্যায়ন পেতে। হয়তো প্রথমবারের যে উচ্ছ্বসিত অনুভূতি সেটা পরে আর হয় না। কিন্তু দায়িত্ববোধটা বাড়ে। মনে হয়, যা খুশি তাই গান লিখার সময় আর নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই স্বীকৃতি আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়। বয়স কিংবা সময়কে হারিয়ে তরুণের মতোই লিখতে সাহস যোগায়। সেজন্যই ২০১৩ সালে এসেও ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী’ ছবিতে গান লিখে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেলাম।  

জাগোনিউজ : এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলবো। গানের মানুষদের দাবি সংগীতাঙ্গনে খারাপ সময় যাচ্ছে। বিশেষ করে চলচ্চিত্রে আগে অনেক জনপ্রিয় ও শ্রুতিমধুর গান হতো। সেসব গান মুখে মুখে ফিরত সবার। আজকাল তেমনটি দেখা যায় না। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
কবির বকুল : আমি এর দ্বিমত পোষণ করছি। খারাপ সময়ের কিছু নেই। আমি তো দেখছি এখনও প্রতিমাসে দুই তিনটি করে জনপ্রিয় গান প্রকাশ হচ্ছে। চলচ্চিত্রেও শ্রুতিমধুর গান হচ্ছে। যারা বলেন কিছুই হচ্ছে না তারা আসলে কোনো গানই শুনেন না। সবসময় সমালোচনার সুযোগ খুঁজে বেড়ান। হ্যাঁ, হয়তো এখনকার গানগুলো বেশিদিন বাজারে টিকছে না। এর কারণ সংগীতের মন্দা বাজার নয়, শ্রোতাদের দ্রুত পরিবর্তনশীলতা। সময় এখন আগের মতো নেই। সবাই এখন আপডেট চায় মুহূর্তে মুহূর্তে। এখন বিনোদনের অনেক মাধ্যম। তাই আমাদের স্থিরতা নেই। এ নিয়ে হতাশ হবার কিছু দেখছি না। শ্রোতারা স্থির হলে, নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি যত্নশীল হলে, গান শুনার চর্চা বাড়ালেই দৃশ্যপট বদলে যাবে। এখনো বাংলা চলচ্চিত্রে অনেক ভালো গান হচ্ছে।

জাগোনিউজ : গানের বাজারে এখন নতুনদের রাজত্ব। এটি কিভাবে দেখছেন আপনি?
কবির বকুল : অবশ্যই এটি ইতিবাচক। যে কোন ইন্ড্রািষ্ট্রি নিত্য নতুন ধারণা আর মেধা নিয়ে এগিয়ে চলে। আমাদের এখানেও তাই হচ্ছে। নতুন অনেক গীতিকার খুব ভালো গান লিখেছেন। নতুন শিল্পীরা গাইছেনও দারুণ। বেশ ক’জন তরুণ সঙ্গীত পরিচালককে চিনি আমি। তাদের সুর-সঙ্গীত অসাধারণ। আমিও একদিন নতুন ছিলাম। সুযোগ পেয়েছি বলেই এতদূর এসে আজকের কবির বকুলে পরিণত হয়েছি। তেমনি সুযোগ পেলে আজকের নবীনরা সব বদলে দিয়ে আবারও গানের ঐতিহ্যটা ফিরিয়ে আনবে। তবে পুরোনোদের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ণও করতে হবে।

জাগোনিউজ : আরেকটি প্রসঙ্গে বলুন। আজকাল মিউজিক ভিডিও’র চল শুরু হয়েছে। প্রায়ই দেখা যায় অনেকেই অ্যালবাম প্রকাশ না করেই একটি গান মিউজিক ভিডিওতে প্রকাশ করছেন। হাবীবের মতো জনপ্রিয় শিল্পীরাও সিঙ্গেল গান নিয়ে আসছেন অডিও এবং ভিডিওতে। এই যে নতুন একটা ধারা শুরু হলো সেটা কীভাবে মূল্যায়ণ করবেন আপনি?
কবির বকুল : অনেক ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত এটি। গান এখন আর শুধু কানেই সীমাবদ্ধ নয়। শ্রোতারা এখন গান শোনার পাশাপাশি দেখতেও চাইছেন। আর ব্যক্তিগতভাবে আমিও এটার পক্ষে। কেননা, বলে থাকে মানুষ- ‘আগে দর্শনধারী তারপর গুণ বিচারি।’ তাছাড়া বহির্বিশ্বেও এই ধারা বা ফর্মূলা অনুসরণ করা হয়। আপনাকে তো সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতেই হবে। তবে এসব ভিডিওর ক্ষেত্রে মানের দিকটা নজর দেয়া উচিত।

kobir bokulজাগোনিউজ : নতুন যারা বিনোদন সাংবাদিকতায় আসছে তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
কবির বকুল : যে পেশাই হোক সেটাকে সম্মান করতে জানতে হবে, মূল্যায়ন করার ক্ষমতা রাখতে হবে। কাজকে ভালোবাসতে হবে। আর একটা বিষয়, আজকাল প্রায়ই অভিযোগ শুনি বিনোদন সাংবাদিকরা বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে গান লিখছেন, নাটক লিখছেন, অভিনয় করছেন। এসব খবর ব্যথিত করে। একজন বিনোদন সাংবাদিকের অনেক কিছুই করার যোগ্যতা ও ইচ্ছে থাকতে পারে। কিন্তু তাকে লক্ষ রাখতে হবে তার পেশার সাথে অন্য ইচ্ছেগুলো যেন মিশে না যায়, তালগোল না পাকিয়ে যায়।

জাগোনিউজ : আপনার নিজের লেখা পছন্দের কিছু গান...
কবির বকুল : আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো, ও প্রিয় আমি তোমার, যায় দিন যায় একাকী, কেউ প্রেম করে কেউ প্রেমে পড়ে, আমার মাঝে নেই এখন আমি, আসবার কালে আসলাম একা, আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে, এত ভালোবেসো না আমায়, লাজুক পাতার মত লজ্জাবতী, তোমারে দেখিলো পরানো ভরিয়া, একটা চাঁদ ছাড়া রাত আঁঁধার কালো।

জাগোনিউজ : ব্যক্তিগত প্রশ্নে যাচ্ছি। আপনার পরিবার সম্পর্কে পাঠকদের কিছু বলুন...
কবির বকুল : আমার পরিবার নিয়ে আমি খুব সুখী মানুষ। একজন সুখী স্বামী, একজন আনন্দিত বাবা। আমার স্ত্রী দিনাত জাহান মুন্নী গান করে। নিশ্চয় পাঠকরা তাকে ভালো করেই চেনেন। আমি নিজে গানের গাগল। ওর জন্য সেই পাগলামিটা মধুর হয়েছে। আর দুই মেয়ে প্রেরণা, প্রতীক্ষা ও প্রচ্ছদ নামে আমার এক ছেলে রয়েছে। সবাই দোয়া করবেন তাদের জন্য।

জাগোনিউজ : সবশেষে কবির বকুলের শেষ কথা কী?
কবির বকুল : আমি গানের মানুষ। গান ভালোবাসি। গান নিয়ে অমরত্ব চাই।

এলএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।