এখন আর শিল্পীদের নিয়ে আগ্রহ দেখায় না মানুষ : আশরাফ উদাস
গান গাইতে পারা না পারার ব্যাপার নয়, গুন গুন করে গান গাওয়া বাঙালির আজন্ম স্বভাব। কখন কোন গান মনে বেজে ওঠে, যিনি গেয়ে ওঠেন তিনিও জানেন না। এমন একটা গানের সূত্র ধরেই আশরাফ উদাসের কাছে ছুটে যাওয়া। তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় আড্ডা দেওয়া, সাক্ষাৎকার নেওয়া, তাকে নতুন করে আবিস্কার করা।
কেউ একজন গেয়ে উঠেছিলেন জনপ্রিয় এই শিল্পীর দুটি গানের লাইন। মনে হলো গানটা যেনো কার? মনে পড়লো আশরাফ উদাসের। তিনি এখন কোথায় আছেন? কেমন আছেন? গানেই আছেন তো! নাকি জীবনের তাড়নায় শহর ছেড়ে দূরে কোথাও।
না, খোঁজাখুজি করে তাকে পাওয়া গেল। মালিবাগে বসবাস করেন তিনি। সেখানেই তার সঙ্গে হয়ে গেল দীর্ঘ এক আড্ডা। আসর বসিয়ে গানও শোনালেন। তার সঙ্গে আলাপচারিতার কিছু কথা দুটি পর্বে প্রকাশ করা হবে জাগো নিউজে।
জাগো নিউজ : আপনি কেমন আছেন?
আশরাফ উদাস : এই তো ভালো আছি।
জাগো নিউজ : এখন গানের ব্যস্ততা কেমন?
আশরাফ উদাস : এই তো গান নিয়েই আছে। অন্যদের জন্যও গান তৈরি করি। নিজের গানও করে যাচ্ছি টুক টাক। চ্যানেলে লাইভ করছি। রেডিওতে লাইভ করা হয় না এখন। তারা যে সম্মানি দেয় তাতে পোষায় না।
প্রাইভেট চ্যানেলগুলোতে লাইভ করতে ভালো লাগে। তারা সম্মানিটাও ভালো দেয়। প্রোগাম পাওয়ার জন্য কাউকে অনুরোধ করবো, খুশি করবো এমন মন মনসিকতা আমার কখনো ছিল না। এখনো নাই। যারা মনে করেন এই শিল্পীকে ডাকা উচিৎ, ডাকে। ডাকলে যাই।
জাগো নিউজ : বললেন, নতুন গান নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এখন তো গান প্রকাশের ধরণ পাল্টেছে। আপনারা এক সময় ক্যাসেটে অ্যালবাম করেছেন। এরপর সিডি, এখন তো সিঙ্গেল গানের ভিডিও প্রকাশ হয়, আপনার নতুন গানগুলো কোন মাধ্যমে প্রকাশ করছেন?
আশরাফ উদাস : আমি যখন প্রথম গানের অ্যালবাম প্রকাশ করি, তখন তো ফিতার ক্যাসেট ছিল। একটা অ্যালবাম হতো এক ঘন্টা দৈর্ঘ্যের। ১০টা গান হতো। আমার মনে আছে এক ঘন্টাতেই একটা অ্যালবামের রেকর্ডিং করেছিলমা। নিজে হারমনি বাজিয়ে ছিলাম। তবলা আর মন্দিরা ছিলো সাথে। সেই গানেও কিন্ত সারা বিশ্বে খবর হয়েছে সেই সময়।
জাগো নিউজ : আর এখন?
আশরাফ উদাস : এখন যেই গান হচ্ছে তাতে বাহারি মিউজিক আছে কিন্তু গানের প্রাণ নেই। একটা গান হয় তো পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে করছে। তেমন সাড়াও পাচ্ছে না। আবার নরমাল একটা গান হিট হয়ে যাচ্ছে, যেমন ‘মাইয়া ও মাইয়া তুই অপরাধীরে’ গানটার কথাই ধরা যাক। হালকা কথার এই গান হিট হয়ে গেল কেন?
নিশ্চয় এই গানের মধ্যে তেমন কিছু আছে। যেমন আমি যখন গান করতাম, ‘আমার লাইন হয়ে যায় আঁকা বাঁকা’, ‘বাঙ্গি খাইতে বালুর মতো’, ‘পুকুরেতে পানি নাই’, ‘গাছটা হইলো সবুজ বন্ধু ফুলটা হইলো লাল’, ‘বন্ধু তুমি আইবারে বলে’- গানগুলো সহজ কথার ছিলো।
অনেক মানে ছিলো। শ্রোতারা যেন গানের সঙ্গে নিজের জীবনকে খুঁজে পায় সেই উপাদান ও আবেদন ছিলো। সব মিলিয়ে আমার তো প্রায় তিনশত অ্যালবাম। অসংখ্য গান জনপ্রিয়।
জাগো নিউজ : অনেক ডুয়েট অ্যালবামও তো করেছেন?
আশরাফ উদাস : হ্যাঁ । অনেক ডুয়েট অ্যালবাম করেছি। আজকের এমপি মমতাজ তিনি তো আগে বাউল ছিলেন। আমার অনেকগুলো অ্যালবাম হয়েছে মমতাজের সঙ্গে। আমার সঙ্গে গান করেই আলোচনায় আসেন মমতাজ।
তার ভাগ্য অনেক ভালো। অনেক পরিশ্রমও করেছেন জীবনে। তার জন্য দোয়া করি আরও অনেক বড় হোক। আল্লাহ তাকে দুই হাত ভরে দিয়েছেন। এর জন্য ভাগ্য লাগে। এমন আরও অনেকের সঙ্গেই ডুয়েট অ্যালবাম হয়েছে।
জাগো নিউজ : নিজের সেলিব্রেটি ইমেজ কেমন উপভোগ করতেন। বিশেষ করে নব্বই দশকে তুমুল জনপ্রিয়তার সেই সময়গুলোতে আপনার কিছু গল্প ও অভিজ্ঞতা শুনতে চাই.....
আশরাফ উদাস : আমরা যখন গান করেছি। তখন একটা ব্যাপার ছিল শিল্পীদের কেউ দেখতে পেত না। সবাই ক্যাসেটের কাভার দেখতো। তখন শিল্পীদের প্রতি সবার অন্যরকম একটা আকর্ষণ ছিল। অনেকেই ভাবতো, আহা শিল্পীকে যদি একবার দেখতে পারতাম সামনে থেকে।
যখন গান সিডিতে আসলো, তখনো ঠিক ছিল। কারণ সিডিতেও অডিও অ্যালবাম প্রকাশ পেত। যখন ভিসিডি আসলো, শিল্পীদের কম দেখা গেলেও মডেলদের দেখা যেত। এখন আর সেই রকম নেই। ফেসবুক ইউটিউবে সব সহজ হয়ে গেছে। শিল্পীরা নিজেরাই হাজির হচ্ছেন ভিডিওতে।
যার ফলে এখন আর শিল্পীদের নিয়ে আগ্রহ দেখায় না সাধারণ মানুষ। শ্রোতা-দর্শক বা সাধারণ মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। আগের দিনে শিল্পীরা ছিলেন রুপকথার নায়ক-নায়িকাদের মতো। আর এখন তো মোবাইলটা চালু করলেই যাকে খুশি তাকে দেখা যাচ্ছে।
সেদিক থেকে নব্বই দশকের সেইসব দিন ছিলো দারুণ। সবাই আমাকে বা যে কোনো শিল্পীকে এক পলক দেখার জন্য হা করে থাকতো। কারো সঙ্গে হুট করে দেখা হলে পাগলামির অন্ত ছিলো না। আজকাল কে আর কোন শিল্পীর খবর রাখে। ছবি বা সেলফি তোলাটা একটা অভ্যাস তাই তুলে রাখে। লোকজনকে দেখানোর জন্য যে দেখো অমুক অমুক আমার কাছের লোক। সবটাই ফেইক।
জাগো নিউজ : আপনাদের সময় গীতিকার সুরকারদের মূল্যায়ন কেমন ছিল?
আশরাফ উদাস : বাংলাদেশে প্রথম অ্যালবামের কাভারে আমি গীতিকারের ছবি দেওয়া শুরু করি। আমার দেখাদেখি সাউন্ডেক, সংগীতা সবাই অ্যালবামের কাভারে গীতিকারদের ছবি দেওয়া শুরু করলো।
৯৪-৯৫ সালের দিকে হবে সময়টা। আমার অ্যালবামের নাম ছিলো ‘হারানো প্রেম’। গান লিখেছিলেন হাসান মতিউর রহমান। এটা তার সৃষ্টি। তবে কাভারে কেনো তার ছবি যাবে না? গীতিকার আড়ালের লোক। শিল্পী চিনাইলে গীতিকারকে মানুষ চিনবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটটা এই রকম। এটা কার গান? আব্দুল আলীমের গান। এটা কার গান মুজিব পরদেশীর গান। কার গান? আশরাফ উদাসের গান। কিন্তু গানগুলো কে লিখেছে সেই খোঁজ রাখে না কেউ। এটা আমার কোনোদিন ভালো লাগেনি।
গীতিকার সুরকারের পরিচিতি পাওয়াটা তো তাদের মৌলিক অধিকার। একটা গান প্রথমে লিখেন গীতিকার, তারপর সুরকার সুর করেন, তারপর হলো গায়কী।
জাগো নিউজ : আপনার কণ্ঠে ফোক গানই প্রাধান্য পেয়েছে সব সময়। কেন?
আশরাফ উদাস : গানের কয়েকটা ধরণ আছে। আধুনিক, ব্যান্ড, সিনেমা, আর জারি-সারি-ফোক। এই চার ধরণের গানই গায় শিল্পীরা। আমি ফোক গান গেয়েছি বেশি। ফোক গানেই সবশ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়।
আমি আধুনিক গানেরও ক্যাসেট করেছি। আমার ভক্তরা রেগে গেছে। তারা বলে, আপনি কেন আধুনিক গান করবেন। আপনি গাইবেন ফোক গান। আপনাকে যেই গানে আমরা চিনি আপনি সেই গান গাইবেন।
লোকজ ব্যপারটা কেবল ফোক গানেই পাওয়া যায়। ফোক গান হলো সেইটা। আটষট্টি হাজার গ্রাম যদি আমাকে চিনে, পুরো পৃথিবী আমাকে চিনবে। হয়েছেও তাই। আপনাদের দোয়ায়, যতটুকু না হওয়ার তার চেয়ে বেশি আল্লাহ পাক আমাকে দিয়েছে। এবং আমি মরার আগেও গান গেয়ে মরতে চাই।
এটা সব চেয়ে বড় বিষয়। কারণ আমার ধ্যানে জ্ঞানে চিন্তা চেতনায় শুধু সুর আর সুর। অন্য কিছু নাই।
জাগো নিউজ : সিনেমাতেও তো অনেক গেয়েছেন?
আশরাফ উদাস : সিনেমাতে আমার যতো গান গেছে সেগুলো আমার ক্যাসেট থেকেই নেওয়া। আলাদাভাবে কখনই সিনেমার গান তৈরি করিনি।
জাগো নিউজ : মুজিব পরদেশী যখন সুপার হিট। তখন আপনার শুরু হলো মাত্র। চ্যলেঞ্জিংটা কেমন ছিল?
আশরাফ উদাস : যখন মুজিব পরদেশী সাহেব জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন আমি জমিনে। কেউ তখন ভাবতেও পারেনি মুজিব পরদেশী বেঁচে থাকতে একশ বছরের মধ্যে কোনো শিল্পী হিট হতে পারে। কিন্তু উনার ছিল শুধু বিচ্ছেদ গান।
আর আমার ছিল অর্ধেক রোমান্টিক গান অর্ধেক বিচ্ছেদ গান। এই কারণে মানুষ আমার গানও শুনেছে। আমি যদি তার মতো গাইতাম তাহলে আমার গান কেউ শুনতো না। নতুন ডাইমেনশন নিয়ে না আসতে পারলে নতুনদের গান কেন শুনবে শ্রোতা?
আমাকে নতুন ডাইমেনশন ঘটাতে হয়েছে। কী ঘটিয়েছি। যেমন ছন্দ নিয়ে কাজ করেছি গানে। পুকুরেতে পানি নাই, গাছটা হইলো সবুজ বন্ধু ফুলটা হইলো লাল, তোমার আমার ভালোবাসা থাকবে চিরকাল।
বাঙ্গি খাইতে বালুর মতো তরমুজ খাইতে পানি, রুমালেতে লেখা ছিল বন্ধু ভুইলো না আমায়, রুমালেতে লেখা ছিল মধুরও মিলন, সেই কথা কী ভুলতে পারি থাকিতে জীবন। আমি ঘর বাঁধিলাম নদীর কুলে আইবার চাইয়া তুমি আইলা না।
এই সহজ কথার গান, হৃদয় ছোঁয়া সুর মানুষ গ্রহণ করেছে। এগুলো অধিকাংশ লিখেছেন হাসান মতিউর রহমান। যারা সুর করে তাদের সুরেও আমি গাইতে পারি না। পছন্দ হয় না। আমার যতো গান আছে সব আমার নিজের সুর করা।
হাসান মতি ভাই একদিন বললেন, এখন কী করি? আমি বললাম আপনি সহজ ছন্দে গান লেখা শুরু করেন। আমরা সফল হলাম। মুজিব পরদেশী ও আমার গায়কীটা কাছাকাছি ছিলো তো। নিজেকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করাটা বেশ কঠিন ছিল।
জাগো নিউজ : এখনকার গান নিয়মিত শোনেন?
আশরাফ উদাস : হ্যাঁ শোনা হয় তো। কিন্তু এখন বর্তমানে যে গান হয় সেই গানে আমি তৃপ্তি পাই না। কিছু গান আছে দুম করে হিট হয়ে আবার দুই দিন পরে থাকে না। ভারতীয় গান যত শুনি। ততবারই মনে হয় গানটি নতুন করে শুনছি। কিছু গান আছে যেগুলো চির সবুজ।
যে গান হৃদয় ছুঁয়ে যায় না, সেই গান তো বেঁচে থাকবে না। আমি সব সময় বলি, নতুন জেনারেশনের কাছে আমার একটাই দাবি তোমরা একটা গান হিট হলে সেই গানের পেছনেই ছুটতে থেকো না। একটা গান হলো কিছু কথা অদল বদল করে, একটু সুর এদিক সেদিক করে ওই গানের মতো আরও গান না বানিয়ে, তোমরা নতুন কিছু করো। যেটা মানুষ গ্রহণ করতে পারে। একটু মেধা খাটাও।
তোমাকে তো নতুন করে মিউজিক করতে হচ্ছে, ভেরিয়েশন না থাকলে লাভ টা কী? তোমার কী থাকলো? তোমাকে কীভাবে চিনবে। গীতিকারদেরও বলি ভালো গান লিখতে হবে, সুরকারকে ভালো সুর করতে হবে। গায়ক ফিনিসিং দিবে। ভালো গানই যদি না পায় তাহলে গায়ক কী করবে?
এমএবি/এলএ/পিআর