কমে যাচ্ছে সিলেট বন বিভাগের জমি
সিলেট বন বিভাগের জমির পরিমাণ কাগজে কলমে আছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৭৪৭ দশমিক ১৯ একর। তবে এসব জমি কেবল খাতাপত্রেই আছে। বাস্তবে বন বিভাগের দখলে আছে মাত্র ৮১ হাজার ৯৮১ একর ভূমি। বন বিভাগের বাকি অর্ধেকের চেয়েও বেশি ৮২ হাজার ৭৬৬ একর দশমিক ১৯ একর জমি বেদখল হয়ে গেছে।
দখলীয় কিছু ভূমি নিয়ে আদালতে একাধিক মামলা চলমান থাকলেও হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এ বিপুল পরিমাণ ভূমি উদ্ধারে তেমন কোনো তৎপরতা নেই। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন বিভাগের বেদখলীয় ভূমি উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়েছিলো। তবে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাঝপথেই থেমে যায় সে অভিযান।
সিলেট বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিভাগের সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, হবিগঞ্জ সদর, বাহুবল, নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট, মাধবপুর, শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার সদর, কুলাউড়া, জুরী, বড়লেখা, ছাতক, দোয়ারাবাজার, ধর্মপাশা, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভপুর, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় থাকা বনবিভাগের বেশিরভাগ ভূমিই অবৈধ দখলদারদের দখলে রয়েছে।
দখলীয় ভূমির বৃক্ষ কেটে নিধন, শ্রেণি পরিবর্তনসহ কোথাও মাটি কেটে কিংবা ভরাট করে ভূমির অবস্থার পরিবর্তনও করে ফেলেছেন দখলদাররা।
বন বিভাগের জমি বেদখলের শীর্ষে রয়েছে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা। এ উপজেলায় বন বিভাগের ২২ হাজার ২০৭ একর জায়গার মধ্যে ২০ হাজার ১৭২ একর জায়গাই বেদখল হয়ে গেছে। বনের জমি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ক্রাশার মেশিন, ডাম্পিং ইয়ার্ড ও আবাসন।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৫০ সালের জরিপে সিলেট বিভাগের চার জেলায় বনবিভাগের ভূমির পরিমান ছিলো এক লাখ ৬৪ হাজার ৭৪৭ দশমিক ১৯ একর। ১৯৬৫ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সিলেট ও সুনামগঞ্জে বনবিভাগের প্রায় ৪৮ হাজার ৫৮২ একর ভূমি সিলেট পেপার ও পাল্পমিলের অধীনে ছিল। দীর্ঘদিন অব্যবস্থাপনায় পড়ে থাকার কারণে সে ভূমির প্রায় ২৩ হাজার ২০০ একর জবরদখল হয়ে গেছে।
এছাড়া বিভাগের অন্যান্য এলাকায় থাকা বনের ৫৯ হাজার ৫৬৬ দশমিক ৫৬ একর ভূমি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছেন।
বন কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এবং অসাধু কিছু ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ও বন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বিভিন্ন সময়ে বনের অর্ধেকের চেয়েও বেশি ভূমি দখল হয়ে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকাবস্থায় ২০০৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৫৮১ একর জমি দখলমুক্ত করা হলেও বাকিটুকু এখনো জবরদখলে রয়ে গেছে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় ভৌগলিক অবস্থানের এক-চতুর্থাংশ বন থাকা আবশ্যক বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করলেও বন বিভাগের হিসেবে সিলেটে বনের পরিমাণ মোট ভূমির ৯ থেকে ১০ শতাংশ। অবশ্য এ জন্য সংশ্লিষ্টরা অবৈধ দখলীয় ভূমি থেকে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনকে দায়ি করছেন।
সরেজমিনে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলং এলাকায় দেখা গেছে, এ উপজেলার তামাবিল শুল্ক স্টেশন ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অবস্থিত বন বিভাগের ৫৩৭ একর জায়গা রয়েছে। এসব জায়গার অধিকাংশই টিলা এবং এসব টিলায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে বনায়ন করা হয়।
কিন্তু সবুজে ঘেরা এ জনপদ এখন আর সবুজ নেই। বরং পাথর-কয়লা জঙ্গলে ভরা সমতল ভূমি। গাছ এবং টিলা কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। একদিকে টিলা কাটা হচ্ছে অন্যদিকে চলছে ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ কাজ। এর পাশেই বন বিভাগের বিশাল জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ক্রাশার মেশিন।
স্থানীয় এলাকাবাসীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তামাবিল শুল্ক স্টেশন দিয়ে আসা পাথর, চুনাপাথর ও কয়লা ডাম্পিং করা হচ্ছে এসব ডাম্পিং স্টেশনগুলোতে। বন বিভাগের গাছ কেটে এসব জায়গা অর্থের বিনিময়ে উচ্চমূল্যে আমদানি কারকদের ডাম্পিংয়ের স্থান হিসেবে বরাদ্দ দিচ্ছে ক্যাডারা।
এর মধ্যে কিছু প্রভাবশালী মহল নিজেরাও এ ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছেন এবং তারাও ডাম্পিংয়ের স্থান হিসেবে বন ও সড়ক বিভাগের এসব জায়গা দখল করে আছেন। তাছাড়া ডাম্পিংয়ের স্থান বের করতে আশপাশের টিলাও কেটে ফেলা হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এ কাজে জড়িত রয়েছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাশালী ব্যক্তিবর্গ।
বন বিভাগের জমি দখলের দায়ে অভিযুক্ত স্থানীয় প্রভাশলালী সাজ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, তার দখলকৃত জায়গা ডিসির খতিয়ানের। তিনি কোনো জায়গা দখল করেননি। তিনি বলেন, তাদের দখলে বন বিভাগের কোনো জায়গা নেই।
এ ব্যাপারে সিলেট কয়লা আমদানিকারক সমিতির সাবেক সভাপতি এমদাদ হোসেন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, জায়গা দখল করে এই এলাকায় ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ চলছে। তবে কয়লা আমাদানিকারক গ্রুপের কেউ এর সঙ্গে জড়িত নয় বলে জানান তিনি।
এমদাদ হোসেন আরো বলেন, সরকারিভাবে তামাবিল শুল্ক স্টেশনে ডাম্পিং ইয়ার্ডের ব্যবস্থা করার দাবি আমরা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছি। ডাম্পিংয়ের জন্য সরকারের নির্ধারিত জায়গা থাকলে দখল অনেকাংশে কমে যেতো।
বনবিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে জানান, বনের ভূমি জবরদখল হয়ে যাওয়া এখন তাদের অন্যতম প্রধান সমস্যা। বনভূমি জরিপ বর্হিভূত থাকায় বন বিভাগের ভূমির মালিকানা নিয়ে দখলীয়দের সঙ্গে বিরোধ দীর্ঘদিনের।
কোথাও বনবিভাগের ভূমি দখলের সঙ্গে আদিবাসীরা সম্পৃক্ত থাকায় এবং অনেক ভূমি নিয়ে মামলা বিচারাধীন থাকায় দখল উচ্ছেদমুক্ত করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের হিসেবে দখলীয় ভূমির প্রায় ৩০ হাজার একরের উপর আদালতে মামলা রয়েছে। কোনো মামলা দীর্ঘ ২০-২২ বছর ধরে চলছে।
এ ব্যাপারে বনবিভাগের সিলেট বিভাগীয় কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বনবিভাগের এখন বড় সমস্যা ভূমি দখল। অনেক ভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলছে। এছাড়া আধিবাসী ও ভূমিহীন জনগোষ্ঠী বন বিভাগের বিপুল সংখ্যক ভূমি দখল করে আছে। দখলীয় ভূমির তালিকা জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে দাখিল করা হয়েছে। এখন জেলা প্রশাসন বিষয়টি দেখবে।
এমজেড/এমএস