বঙ্গবন্ধু তো শ্যাম বেনেগালের জাতির পিতা নয় : ফারুক

লিমন আহমেদ
লিমন আহমেদ লিমন আহমেদ , বিনোদন প্রধান
প্রকাশিত: ০৫:২৮ পিএম, ২৭ আগস্ট ২০১৮

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম নিয়ে ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রস্তাবিত সেই চলচ্চিত্রের পরিচালক নির্বাচন করা হয়েছে ভারতের শ্যাম বেনেগালকে।

আজ সোমবার (২৭ আগস্ট) সচিবালয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনভিত্তিক ছবি নির্মাণ নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়ের সময় তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে ভারতীয় নির্মাতাদের হাতে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের পক্ষে বিপক্ষে মতামত পাওয়া গেছে বাংলাদেশি তারকা অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতাদের কাছ থেকে। গত বছরের ৮ এপ্রিল নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে দুই দেশের যৌথ প্রযোজনায় বঙ্গবন্ধুর জীবনীভিত্তিক একটি চলচ্চিত্র ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের চুক্তি হয়। ওই চুক্তির শর্তানুযায়ী একটি জয়েন্ট কমিটি গঠন করা হয়। গত ৯ জুলাই নয়াদিল্লীতে জয়েন্ট কমিটির প্রথম সভা হয়। সেখানে ভারত চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য তিনজন পরিচালকের নাম প্রস্তাব করে। তারা হলেন শ্যাম বেনেগাল, গৌতম ঘোষ ও কৌশিক গাঙ্গুলি। তখন থেকেই বিতর্ক উঠে তিন নির্মাতাকে নিয়ে।

অবশেষে বিতর্কের মুখেই ঘোষণা এলো বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে প্রস্তাবিত চলচ্চিত্রটি ভারতের নন্দিত নির্মাতা শ্যাম বেনেগালই নির্মাণ করবেন। এ নিয়ে আবারও শোনা যাচ্ছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে শ্যাম বেনেগালের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই তাকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক না বানাতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছেন চিত্রনায়ক ফারুক।

ঢাকাই ছবির এই জীবন্ত কিংবদন্তি আজ সোমবার বিকেলে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর উপর চলচ্চিত্র নির্মিত হলে এই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি খুশি হবো আমি। তবে আমি চাই না ‘হ-য-ব-র-ল’ কিছু হোক। জাতির জনকের জীবনী বিদেশি নির্মাতা নির্মাণ করুক সেটি আমি কখনোই চাই না। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের আবেগটা কী বুঝবেন? কখনোই না। কারণ বঙ্গবন্ধু তো শ্যাম বেনেগালের জাতির পিতা নয়। তিনি আমাদের মতো করে বঙ্গবন্ধুকে লালন করেন না, ভালোওবাসেন না। হয়তো বিশ্ব কাঁপানো নেতা হিসেবে তাকে শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু জাতির জনকের মতো করে নয়।’

ফারুক আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হলেন বাংলার মাটি। সেই মাটিতে হাসি আছে, কান্না আছে। এমন কাঁদামাটি নিয়ে খেলতে হলে তার কাছে থাকতে হয়। সেই মাটির ঘ্রাণ মুখস্ত করতে হয়। শ্যাম বেনেগাল তো সেটি করেননি কখনো। তবে তিনি কেমন করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি আদর্শ চলচ্চিত্র বানাবেন? বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাদের কাছে আমার এটি প্রশ্ন রইলো।’

শ্যাম বেনেগালের প্রতিও নায়ক ফারুক প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বলতে আমি বা আমরা সারা বাংলা জুড়ে রক্ত দেখতে পাই। আপনি কী পান? আপনার নির্মাতা হৃদয় কী সেই পিতার রক্তের সন্ধান পাবে?’ নির্মাতা শ্যাম বেনেগালের প্রতিভা ও নির্মাণশৈলী নিয়ে কোনো আক্ষেপ বা হতাশা নেই। তবে বিদেশি হওয়ায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার আবেগ ও অনুভূতির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বাংলাদেশি যে কোনো নির্মাতার চেয়ে। এজন্যই নায়ক ফারুক এই পরিচালক দ্বারা নির্মিত বায়োপিক সমর্থন করছেন না।

ভারতীয়দের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রটি একজন বিদেশি চলচ্চিত্রকার নির্মাণ করেছিলেন। তবে শ্যাম বেনেগাল কেন বাংলাদেশিদের জাতির জনককে নিয়ে ভালো ছবি বানাতে পারবেন না? এই প্রশ্নের জবাবে ফারুক অকপটে বলেন, ‘গান্ধীজী মহান নেতা। কিন্তু ভাই তোমরা বঙ্গবন্ধু আর গান্ধীকে এক করে ফেলো না। দুজনের জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। বঙ্গবন্ধু তার এক জীবনের যতো নাটকীয়তার মুখোমুখি হয়েছেন, যতো সাহসিকতা দেখিয়েছেন, যতো সংগ্রাম-লড়াই করেছেন, যতো কারবারণ করেছেন, যতো শাস্তি-যন্ত্রণা সহ্য করেছেন বিশ্ব ইতিহাসে তেমনটি আর কোনো নেতার বেলায় পাবে না। একটি দিশেহারা দুর্বল ও অস্ত্রহীন জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো ও তা এনে দেয়া অতো সহজ কিছু নয়। শেখ সাহেবের জীবন অনেক বেশি বর্ণিল ও জটিল। এটুকু বুঝে তারপর যুক্তি দেখাতে হবে।

বিশ্ব রাজনীতিতি দুই নেতার অবস্থান ও জনপ্রিয়তাও ভিন্ন। তারচেয়েও বড় কথা, যদিও আমি ওই বিদেশি নির্মাতার বানানো গান্ধীজীর চলচ্চিত্রটি দেখিনি তবুও বলছি, ওই ছবিটি একজন আদর্শ ভারতীয় নাগরিকের দৃষ্টিতে বানানো হয়নি। গিয়ে দেখ সেখানে গান্ধীজীর বৃটিশপ্রেম এসেছে, আমেরিকাপ্রেম এসেছে। মূল বক্তব্য রেখে অন্য কিছু বলার চেষ্টা হয়েছে। অনেক কিছু ছাড় দেয়া হয়েছে। যার ফলে অসন্তুষ্ট হয়ে পরবর্তীতে ভারতীয় নির্মাতারাই গান্ধীজীকে নিয়ে ছবি বানানোর চেষ্টা করেছেন। বঙ্গবন্ধুর বেলায় এমনটি হতে দেয়া ঠিক হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেহেতু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি নিজে আগ্রহী হয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছবিটি বানাতে চাইছেন সেক্ষেত্রে তার ইচ্ছেতে তার দেশের পরিচালক থাকতেই পারেন। তবে তার সঙ্গে বাংলাদেশের উচিত হবে যোগ্য একটি চলচ্চিত্রকর্মীদের নিয়ে গঠিত টিমকে সেই পরিচালকের সঙ্গী করা। আমার কথা খুব সহজ ভাই, শুধু তথ্য-উপাত্ত আর গবেষণা করলেই একজন ভিনদেশি ভালো নির্মাতাকে দিয়ে কোনো জাতির জনকের সিনেমা বানানো যায় না। সেজন্য ওই জনকের আদর্শ লালন করা জাতির প্রতিনিধিও চাই।’

ঢাকার চলচ্চিত্রের মানুষদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা জরুরি দাবি করে ‘মিয়া ভাই’ খ্যাত এই অভিনেতা বলেন, ‘অনেকদিন চলচ্চিত্রের সঙ্গে আছি। টুকটাক কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি। অভিনয় করেছি, প্রযোজনা করেছি। কিছু অভিজ্ঞতা আছে। সেই আলোকে আমি চাই এই ছবিটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে একটি কমিটি হোক। সেখানে চলচ্চিত্রের জানাশোনা মানুষেরা থাকব। তোমরা বলছো সরকার শ্যাম বেনেগালকে নির্বাচন করেছে। আমার সন্দেহ হয়। আমার তো মনে হয় কোনো এদেশের সরকার নয়, কোনো একটি দল বা কোনো ব্যক্তি আগ্রহেই বিদেশি নির্মাতাকে নেয়া হচ্ছে। হয়তো আমার কথায় অনেকেই কষ্ট পাবে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই।

আমি কাউকে তোষামোদ করি না। একটা সময় সিনেমার ইন্ডাস্ট্রি ডমিনেট করেছি। এখনো এই বয়সে নানা ক্রান্তিলগ্নে পাশে থাকার চেষ্টা করছি। জন্মেছি একদিন মরেও যাব। অতো ভাবাভাবির কিছু নেই। বাংলাদেশের নগন্য একজন চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে আমি আবেগী, আপোষহীন। আমার নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। এখন তিনি আদর্শ। আর এখন আমার নেতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। তার বাবার জীবনী নিয়ে তিনি অন্য সবার চেয়ে বেশি মনযোগী হবেন সেটাই প্রত্যাশা করি। সবকিছু দেখে শুনে ও বুঝে তিনি সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন।’

তিনি বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি দাবি করে বলেন, ‘এটা প্রতিষ্ঠিত যে বঙ্গবন্ধু শুধু নেতাই ছিলেন না। তার অনেক গুণ ছিলো। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনেক বৈচিত্রময়, বিশাল। তাকে রাজনীতির কবিও বলা হয়। তাকে নিয়ে কিছু একটা নির্মাণ করতে গেলে বিশ্বের অনেক নামি দামি নেতারা চলে আসবেন। গান্ধীজী আসবেন, ইন্দিরা গান্ধী আসবেন, মার্টিন লুথার কিংয়ের প্রসঙ্গ আসবে, ফিদেল কাস্ত্রোর প্রসঙ্গ আসবে।’

শেষবেলায় তিনি বলেন, ‘তবে এই কথাও মানতে হবে, ৭৫ থেকে আজ অবধি বাংলাদেশের কোনো নির্মাতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারিও বানাতে পারেননি। এটা আমাদের বিরাট দেউলিয়াত্ব প্রকাশ করেছে। এজন্য সরকারও ভরসা হারিয়েছে আমাদের উপর। জাতির জনককে নিয়ে একটি কাজও আমি দেখিনি এইদেশে। অথচ কতো গুণী ও শিল্পীমনা নির্মাতা এই দেশে জন্মেছে। আমি হতাশ নই। হয়তো এই প্রস্তাবিত চলচ্চিত্রটি চোখ খুলে দেবে সবার। নতুন প্রজন্ম আগ্রহী হবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কাজ করতে। শ্যাম বেনেগাল ব্যর্থ হলে তারাই সঠিকভাবে জাতির জনককে নিয়ে চলচ্চিত্র বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেবে। আমি আশাবাদী মানুষ।’

আরএমএম/এলএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।