দুই শতাধিক থিয়েটারকর্মী কাজ করছে দুরন্ত টিভিতে

মাসুম আওয়াল
মাসুম আওয়াল মাসুম আওয়াল , স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশিত: ০৬:০৫ পিএম, ১৬ আগস্ট ২০১৮

একজন নাট্যকর্মীর স্বপ্ন থাকে আকাশ ছোঁয়া। অনেক স্বপ্ন নিয়ে কোনো একটি নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। কিন্তু দেশে এখনো প্রফেশনাল নাট্য চর্চা গড়ে না ওঠার কারণে এক সময় সেই নিবেদিত নাট্যকর্মী হারিয়ে যান, হতাশায় নিমগ্ন হয়েই।

জীবনের প্রয়োজনে অভিনয় ছেড়ে চলে যান অন্য কোনো পেশায়। শিল্পের প্রতি প্রচুর প্রেম থাকার পরেও আর থাকা হয় না এই নাট্যজীবনের সঙ্গে। এমনই এক অসময়ে দারুণ দৃষ্টান্ত তৈরি করলো বেসরকারি টিভি চ্যানেল দুরন্ত টিভি। প্রায় দুই শতাধিক থিয়েটারকর্মীর কর্মসংস্থান করেছে দেশের একমাত্র শিশুতোষ টিভি চ্যানেলটি।

দেশের অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেও অনেক থিয়েটার কর্মী কাজ করছেন। তবে এখন সবচেয়ে বেশি থিয়েটারকর্মী এক হয়েছেন দুরুন্ত টেলিভিশনে। এবং এখানে থিয়েটারকর্মীদেরকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে।

যাত্রা শুরুর অল্প দিনেই দর্শকের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে দুরন্ত টিভি। বিদেশি চ্যানেলের হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার কার্টুনের পরিবর্তে বাঙালি শিশুরা অনেকেই বাংলা কার্টুনের জন্য বেছে নিয়েছি দুরুন্ত টিভি। আর এই কার্টুনের ভয়েসের জন্য তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থানের বিশাল সুযোগ। প্রায় দুই শতাধিক থিয়েটারকর্মী যুক্ত হয়েছেন চ্যানেলটির সঙ্গে। এই বিষয়টি বেশ আলোচিত একটি বিষয় মিডিয়াতে। থিয়েটার অঙ্গনেও দুরন্ত টিভির প্রশংসার শেষ নেই।

শিশুদের সঙ্গে অনেক মা-বাবাও সঙ্গী হয়েছেন চ্যানেলটির। আর তাই শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপহার দিতেই দিন রাত পরিশ্রম করে চলেছেন অনুষ্ঠানের আয়োজকরা। চ্যানেলটির ব্যাবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ সাঈদ, পরিচালক হিসেবে আছেন অভিজিৎ চৌধুরী, হেড অব প্রোগাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বটতলার ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মাদ আলী হায়দায়, প্রোগাম এক্সিকিউটিভ হিসেবে আছেন সুমনা সিদ্দিকী। ব্রডকাস্ট ও টেকনিক্যাল বিভাগে আছেন সাকিব আরেফিন আর বিক্রয় ও বিপনন বিভাগে আছেন আমজাদ হোসেন আরজু। আর তাদের সঙ্গে রয়েছে ডাবিংয়ের বিশাল এক টিম।

দুরন্ত টিভির হেড অব প্রোগাম মোহাম্মদ আলী হায়দার বললেন, ‘আমরা শুরু থেকেই চেয়েছি থিয়েটারকে গুরুত্ব দিতে। আমরা নিজেরাও বিভিন্ন নাট্যদলের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। তাই আমরা জানি থিয়েটার ভুবনে কতো মেধাবী আর পরিশ্রমীরা রয়েছেন। তথাকথিত গ্ল্যামারের ছটার সামনে অবহেলার শিকার হন তারা। আমরা খুঁজেছি যারা অভিনয় চর্চা করে, কণ্ঠ নিয়ে পরিক্ষা নিরিক্ষা করে, বিভিন্নরকম স্বর তৈরি করতে পারে তাদের। আমরা লোক খুঁজেছি নাট্যকলা বিভাগ ও বিভিন্ন থিয়েটার গ্রুপ থেকে।

ইন্টারন্যাশনাল কার্টুনগুলো বিভিন্নরকম করে কথা বলে। এগুলো অনায়াসেই করতে পারে থিয়েটারের ছেলেমেয়েরা। থিয়েটারের শিক্ষার্থিরা উপযুক্ত এই কাজের জন্য। তাই আমরা তাদের প্রধান্য দিয়েছি। ওদের কাজের জায়গাতো এগুলোই। বাংলাদেশে ভয়েসে কাজ করার জায়গা আগে অনেক কম ছিল। এখন জায়গাটা তৈরি হচ্ছে। আমরা এই সুযোগটা পাইনি। এখন ছেলে মেয়েরা শুধু ভয়েস নিয়ে কাজ করেই মাসে ১৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারছে। থিয়েটার কর্মীদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারছি আমরা এটা আনন্দের।’

প্রোগাম এক্সিকিউটিভ সুমনা সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের প্রোগাম ডিপার্টমেন্টে প্রোগাম হেড থেকে শুরু করে ভয়েস আর্টিস্ট প্রায় শতকরা ৮০ভাগ থিয়েটার ব্যকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন। বিশেষ করে তালিকাভুক্ত ভয়েস আর্টিস্ট ২০০জন। তারা প্রত্যেকেই থিয়েটার থেকে এসেছেন। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে থিয়েটার করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু আবেদন তারাই বেশি করেন। এটার সুবিধাও আছে। স্টেজের কাজটিই এখানে করতে হয় তবে সেটা শুধু ভয়েসের মাধ্যমে। থিয়েটার কর্মীরা এটা সহজেই করতে পারেন। এখানে অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করছেন যারা, প্রোডিউসার আছেন যারা তারাও বেশির ভাগ থিয়েটার থেকে আসা। যেহেতু এই চ্যানেলটি ছোটদের এখানে জানা শোনা মানুষ বেশি প্রয়োজন। গ্ল্যামার নিয়ে অতো ভাবনার সুযোগ নেই। সেজন্যই আমরা নাট্যকলা থেকে পড়া লেখা করাদের সুযোগ তৈরি করতে পারছি। তাদের আউটপুটটাও অনেক ভালো। ’

সুমনা সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘আমি এর আগে দেশ টিভি, একুশে টিভিতে ছিলাম। সেখানেও দেখেছি অনেক থিয়েটার কর্মীরা চাকরি করে। তবে আমাদের এখানে কাকতালীয়ভাবেই সংখ্যাটা বেশি হয়ে গেছে। এর খুব ভালো ফলও আমরা পাচ্ছি। থিয়েটার আসলে অনেক কিছু শেখায়। কারো থিয়েটার ব্যাকগ্রাউন্ড থাকলে সে যে কোনো ইন্টারভিউ বোর্ডেই অনেক কনফিডেন্ট থাকে। থিয়েটারের লোকজন টেলিভিশনে আসুক এটা আমরা সবসময়ই চাই। যারা থিয়েটার করে তাদের অনেকেরই পরিকল্পনা থাকে নাটক সিনেমাতে অভিনয় করা, ডিরেকশন দেওয়া। আমাদের এখানে যারা ভয়েস আর্টিস্ট আছে তারা অনেকেই টেলিভিশন নাটকে অভিনয়ও করছেন।’

ছোটদের জন্য অনেক দেশীয় মজার মজার অনুষ্ঠান প্রচার হয় এখানে। প্রতি তিন মাস পরপর নতুন নতুন অনুষ্ঠান নিয়ে হাজির হয় দুরন্ত টিভি। অনেক বিদেশি ক্ল্যাসিক্যাল সিনেমা, কার্টুনও বাংলায় ডাবিং করে প্রচার করা হয় এখানে। মূলত এই অনুষ্ঠানগুলো ডাবিং করেন থিয়েটার কর্মীরা। ডাবিং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অভিনেতা শাহাদাৎ হোসেন ও ডাবিং প্রোডিউসারে হিসেবে আছেন বাকার বকুল।

শাহাদত হোসেন বলেন, ‘আমি যখন এখানে ডাবিং বিভাগের দায়িত্বটা নিই তখনই ভেবেছি থিয়েটার কর্মীদের কাজের সুযোগ তৈরি করবো। আমি নিজেও প্রফেশনাল থিয়েটার করে বেড়ে উঠেছি। থিয়েটার কর্মীদের নিয়ে কাজ করতে আমি অনেক সাচ্ছন্দবোধ করি তাই। আমি যখন কাজ করতে শুরু করলাম। আমি দেখেছি থিয়েটার কর্মীদের কমিটমেন্ট, পারফরমেন্স কোয়ালিটি অন্যদের থেকে বেটার। আমার প্রথমে আর্টিস্ট ছিল ৮০ জন। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ১৪০ জনে। আমরা ডাবিংয়ের ক্ষেত্রে ও লোকাল কনটেইন্টে থিয়েটার কর্মীদের ব্যবহার করবো এটা একটা পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই। আমরা মনে করি এটার সফলতা পেয়েছি। সবচেয়ে ভালো লাগার ব্যাপার হলো যারা কাজ করছেন তাদের আমরা ভালো সম্মানিও দিতে পারছি। আপনি শুনে খুশি হবেন, আমাদের এখানে এমন অনেক ভয়েস আর্টিস্ট আছেন যারা শুধুমাত্র এখানে ডাবিং করেই পুরো পরিবারকে সাপোর্ট দিচ্ছেন।’

দুরন্ত টেলিভিশনে অনেক দিন থেকেই ভয়েস ওভার দিয়ে আসছেন ঢাকা থিয়েটারের থিয়েটার কর্মী হাসান চৌধুরী সউদ। কিছুটা উচ্ছাস প্রকাশ করেই সউদ বললেন, ‘অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ডাবিং করছি এখানে। প্রচুর থিয়েটারকর্মী কাজ করছেন। কাজের পরিবেশটাও অনেক সুন্দর। আর এখানে প্রতিমাসে হ্যান্ডসাম একটা সম্মানিও পাওয়া যায়। সবমিলিয়ে ভালো একটা কর্মসংস্থান হয়েছে আমাদের জন্য।’

২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর যাত্রা শুরু করে দেশের প্রথম শিশুতোষ টেলিভিশন চ্যানেল দুরন্ত টেলিভিশন। ওইদিন রাজধানীর হোটেল সোনারগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চ্যানেলটির লোগো উন্মোচন করা হয়। লোগো উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, লেখক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রেজা সাগর, দুরন্ত টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাঈদ।

এমএবি/এলএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।