ভারতীয় গণমাধ্যমে যা বললেন ফারুকী
ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিস অব ইন্ডিয়ার চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশ নিতে কলকাতায় গিয়েছেন দেশবরেণ্য চিত্রনির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সেখানে উৎসব অংশ নিতে তার সঙ্গে গেছেন স্ত্রী তিশাও। উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্থানীয় কিছু গণমাধ্যমের মুখোমুখী হন ফারুকী। তার মধ্যে ফারুকীর নামের বানান ভুল করলেও (ফারুখি) দৈনিক আজকাল একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার ছেপেছে তার। জাগো নিউজের পাঠক ও ফারুকীর ভক্ত-অনুরাগীদের জন্য কিছুটা সম্পাদনা করে সেটি তুলে ধরা হলো-
আজকাল : আপনার শেষ তিনটি ছবি দেখেছি। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’, ‘টেলিভিশন’ আর ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার’। বিকল্প ধারার ছবি হয়েও শুনেছি এগুলো বাণিজ্যিকভাবেও সফল ছিলো। এটা কতোটা ঠিক?
ফারুকী : ‘টেলিভিশন’ বা ‘থার্ডপার্সন’ মোটামুটি ১০ লাখ করে দর্শক দেখেছে। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ও চলেছে মাস দুয়েক। ‘থার্ডপার্সন’র মতো কম বাজেটের ছবিও বাজার থেকে ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা তুলেছে। এখন এগুলো যদি আপনাদের হিসেবে সাফল্য হয় তো সাফল্য।
আজকাল : কিন্তু আপনার প্রথম দুটো ছবি ‘ব্যাচেলার’ আর ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ দেখতে পাই না কেন?
ফারুকী : বলতে পারেন আমি লুকিয়ে রেখেছি। এই ছবি দুটো আমি কোনও ফেস্টিভ্যালে নিয়ে যাই না। আসলে এরা আমার এখনকার কাজের থেকে এতটাই আলাদা… (একটু থেমে) তবে ওগুলোর মধ্যে হয়ত আজকের আমার বীজটা ছিল।
আজকাল : আর সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কী অবস্থা?
ফারুকী : এক কথায় যদি বলি, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। যেখান থেকে যে কোনও দিকেই তা চলে যেতে পারে। বাংলাদেশে অন্য ধারার ছবির দর্শক এখন অনেক। তা না হলে কীভাবে ‘টেলিভিশন’ বা ‘থার্ডপার্সন’ দেখতে এত দর্শক হয়! তবে সমস্যা হলো আমাদের চলচ্চিত্রকারদের একাংশই ঝুঁকি নিয়ে ভাল ছবি বানাতে পারছেন না।
আজকাল : কিন্তু দু’বছর আগে ‘টেলিভিশন’ নিয়ে যখন কলকাতায় এসেছিলেন তখন তো আপনি কথা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নতুন ছবি নিয়ে ভীষণ আশাবাদী ছিলেন।
ফারুকী : ঠিকই বলেছেন। আমি ভীষণই আশাবাদী ছিলাম। তখন একঝাঁক তরুণ টেলিভিশনের নানা চ্যানেলে দুরন্ত কিছু অন্য ভাবনার টেলিছবি বানাচ্ছিলেন।
আজকাল : যাদের নিয়ে আপনারা ‘ছবিয়াল’ নামের চলচ্চিত্র আন্দোলনটা গড়েছিলেন?
ফারুকী : হ্যাঁ। কিন্তু এরাই যখন বড় পর্দায় এলেন, যে সব ছবি করলেন, তা ভয়ঙ্কর প্রচলিত ভাবনার তো বটেই, বলতে দুঃখ হচ্ছে সেগুলো তামিল-তেলুগু ছবির হুবহু কপি। একটা ‘টেলিভিশন’ কি একটা ‘থার্ডপার্সন’ বা এরকম আর একটা-দুটো ছবি দিয়ে তো একটা আন্দোলন দাঁড়াতে পারে না।
আজকাল : তার মানে এই মুহূর্তে ‘ছবিয়াল’ কি বন্ধ?
ফারুকী : না। তবে থমকে আছে। আশা করব শুভবুদ্ধির উদয় হবে সবার। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের পরিচালকদের। তারা ঘুরে দাঁড়াবেন।
আজকাল : কিন্তু বাংলাদেশে ‘মনপুরা’র মতো ছবিও তো মূলধারায় তৈরি হচ্ছে। যে ছবি ঠিক বাণিজ্যিক ছবি ছকের নয়। বরং অন্য ধারার ছবির মতো।
ফারুকী : ঠিকই বলেছেন। ‘মনপুরা’ বাণিজ্যিক সাফল্য পেলেও একে আমরা ঠিক তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবি বলে ভাবি না।
আজকাল : তবে কি বাংলাদেশ সিনেমায়ও ‘মিডল রোড’র জন্ম হচ্ছে?
ফারুকী : হতে পারে। তবে আমি ঠিক এতেও খুশি নই। আমি বরং ‘রোড-ফোড’ ছেড়ে বলি, আমি চলচ্চিত্রের বিশুদ্ধতায়, মৌলিকতায় বিশ্বাস করি। যা বাংলাদেশের ছবির একটা ‘আইডেন্টিটি’ তৈরি করবে। যেরকম আত্মপরিচয় খানিকটা আমাদের ঔপন্যাসিকরা তৈরি করতে পেরেছেন।
আজকাল : তাহলে বলছেন, তামিল-তেলুগু ছবির বাংলায় রিমেক হওয়াটা আপনাদের কাছেও সমস্যার।
ফারুকী : নিশ্চিতভাবেই একটা বড় ‘থ্রেট’। যারা মৌলিক, ভাল গল্প নিয়ে ছবি করতে চাই তাদের জন্য হুমকি। দেখুন, আমি মনে করি, যতদূর খোঁজ পাই, দুই পারের বাঙালি মৌলিক ‘ফিল্ম মেকার’দেরই লড়াইটা এক। একটা ‘বজরঙ্গি ভাইজান’র মতো ছবি যদি মুক্তি পায়, তা আমাদের মতো বাংলা ছবির নির্মাতাদের কপালে ভাঁজ ফেলে। আপনাদের এখানে মারাঠি বা মালয়ালম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু নিজেদের শক্ত পায়ে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে মৌলিকতার জোরেই। আমি এসব ছবি খুব দেখি।
আজকাল : কীভাবে?
ফারুকী : নানা ফেস্টিভ্যালে। যেখানে আমার ছবি যায়। তবে আপনাদের দেশের বাণিজ্যিক বাংলা-হিন্দি সব ছবিই আমাদের দেশে দ্রুত ঢুকে পড়ে ‘পাইরেটেড ডিভিডি’, ‘ইউটিউব’ ইত্যাদি সূত্রে।
আজকাল : সেইসব হিন্দি ছবি নিয়ে আপনার কী বক্তব্য?
ফারুকী : মজাটা হচ্ছে বলিউড এখন নিজেই কিন্তু নিজের চেনা ফর্মুলাকে বাতিল করছে। তা না হলে ‘পিকু’র মতো ছবি হয়! অথচ আমরা সাহস করে পারছি না।
আজকাল : এখন তো সরকারিভাবেই দু’দেশের ভেতর ছবি আদানপ্রদানের কথা হচ্ছে।
ফারুকী : এ ব্যাপারে আমার একটা স্পষ্ট বক্তব্য আছে। এই বিনিময়ের ক্ষেত্রে সীমান্তের দু’পারেই যেন প্রদর্শন কর এবং ছবির স্লট বিভাজন নিয়ে সমতা থাকে। তা না হলে বাজারের সমতা থাকবে না। আবার বাণিজ্যিক ছবি প্রদর্শনের জন্য যে কর দিতে হবে, তা যেন অন্যধারার ছবি-মেকারদের জন্য বরাদ্দ না হয়। অনুপাতটা ৩০:১০ হওয়া উচিত। আমি ওই ব্যাপারে দেশের সরকারের কাছে স্পষ্ট প্রস্তাব রেখেছি। আর যারা ‘স্বাধীন’ ছবি বানান, তাদের ছবি করমুক্ত করে দেওয়া উচিত।
আজকাল : আপনার নিজের ছবির কথায় ফিরি। আপনার ছবি করার ওপর পূর্বসূরিদের প্রভাব আছে?
ফারুকী : আমার কাছে ছবি করাটা একটা অবচেতনের প্রক্রিয়া। ফলে কে বা কে কে সেখানে আছেন, তা তো বলতে পারব না… (হাসি)। তবে ভাল লাগে কিম কি দুক, মইসিন মখমল বাফ, আব্বাস কিয়েরোস্তামি, ওয়াংকার ওয়াই, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, এম এস সথ্যু… (একটু ভেবে) আনন্দ পর্টবর্ধনের ছবি। আর সত্যজিৎ রায় তো আছেনই। উনার ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ দেখে আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ব্রেসোঁও খুব টানেন।
আজকাল : ভারতের কোনও শিল্পীকে নিয়ে কাজ করার কথা মনে হয়?
ফারুকী : কাজ করেছি তো। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র নায়িকা শিনা চৌহান। ওকে বি পি এল’র অ্যাঙ্কার হিসেবে দেখেছি। খুব ভাল লাগে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকিকে। ওকে নিয়ে হয়ত একটা ছবি করব।
আজকাল : আপনার ছবি ঠিক মুক্তিযুদ্ধ চেতনার ছবি নয়।
ফারুকী: আমরা আসলে উত্তর মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম। আমার একটি টেলিফিল্ম ‘স্পার্টাকাস ৭১’র বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের কাল। ওই ছবি দেখে তারেক মাসুদ আমায় বলেছিলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধটা দেখেছি ভেতর থেকে, কাশবনের ভেতর রাইফেল নিয়ে। আর তোমরা দেখছ অনেক দূরত্ব থেকে। নির্মোহ হয়ে।’
আজকাল : এ রকম অদ্ভুত সব গল্প পান কোথা থেকে?
ফারুকী: (মজার মুখ করে) হয়ত চুল কাটতে কাটতে সেলুনে। আমি জীবনে অনেকরকম কাজ করেছি- সাংবাদিকতা, ইনস্যুরেন্স’র দালালি, ভিসার ফর্ম ভর্তির কাজ- এসব থেকেও গল্প এসেছে। তবে আমার ছবির গল্পের ‘সিনপসিস’ হয় না। মানে আমি তো লিখতেই পারি না। উৎসবে ছবি পাঠানোর সময় তাই মুশকিলে পড়ি।
আজকাল : হ্যাঁ, আপনার ছবিতে এতবার গল্প বাঁক নেয়, মোড় নেয়…
ফারুকী : একটা হালকা চিত্রনাট্য থাকে শুটিংয়ের সময়, এই পর্যন্ত। ছবি চলতে চলতে তা বদলায়। হয়ত পুরোটাই উল্টে যায়। আর ‘এডিটিং’র সময় তো আরেকটা নতুন চিত্রনাট্য তৈরি হয়ে যায়। ‘টেলিভিশন’- এ যে প্রথম দৃশ্য সেটা ছবি এড়িয়ে য়াওয়ার পরে শুটিং হয়েছে।
আাজকাল : পরের ছবি?
ফারুকী : ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’। (হেসে) বাংলা নাম জিজ্ঞেস করবেন না। এখনও ভাবতে পারিনি। ইংরেজি নামেই আপাতত কাজ চলাচ্ছি। ছবি শেষ হবে ২০১৬ তে। শেষ করতেই হবে। কারণ তিনটে উৎসব থেকে ইতিমধ্যেই ডাক চলে এসেছে।
আজকাল : এর বিষয় কী?
ফারুকী : ছবির কেন্দ্রে আছে ইন্দো-আমেরিকান কিছু চরিত্র। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। (হেসে) বললাম না আমার ছবির ‘সিনপসিস’ হয় না।
আজকাল : ভাবনার জগতে আপনি কী? বামপন্থী নাকি মুক্ত চিন্তার শরিক?
ফারুকী : আমি একজন ‘নন কনফর্মিস্ট’। যে কোনও মানবিক সৎ চিন্তাতেই আস্থাবান।
আজকাল : মৌলবাদী হুমকির মুখে পড়েননি?
ফারুকী : পড়েছি। ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার’ বেরোনোর পরে আমাকে ভারতের দালাল পর্যন্ত বলা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন করা হয়েছে। মজার কথা, ‘টেলিভিশন’ দেখার পর কিন্তু মৌলবাদীদের অধিকাংশই সমর্থন করেছে ছবির মৌলভীর পরিবর্তনটাকে। মানতে পারেননি বরং মুক্তমনারাই। আসলে আমি কোনও খাঁচায় বিশ্বাসী নই।
এলএ/আরআইপি