আনন্দবাজারের মিথ্যাচারে নীরব কেন ঢাকাই সিনেমা?

লিমন আহমেদ
লিমন আহমেদ লিমন আহমেদ , বিনোদন প্রধান
প্রকাশিত: ০৩:৫২ পিএম, ০৪ এপ্রিল ২০১৮

সাম্প্রতিককালে কিছু কুচক্রীমহল, অসাধু হল মালিকদের ইচ্ছেয় কলকাতার সঙ্গে ঢাকার সিনেমা আমদানি রফতানির নামে ভারসাম্যহীন ব্যবসা চলছেই। এতে করে ওপারের বেশ কয়টি নামি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এপারের সিনেমায় টাকা লগ্নি করছেন, লগ্নি করার কথা ভাবছেন। সেসব ছবিতে কলকাতার শিল্পী, কলকাতার সংস্কৃতিই প্রাধান্য পাচ্ছে, পাবে।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এখন পর্যন্ত যৌথ প্রযোজনা কিংবা সাফটা চুক্তিতে মুক্তি পাওয়া কলকাতার একটি ছবিও এইদেশের সিনেমা হলে ব্যবসা করেনি, বাংলাদেশের নায়ক শাকিব খানের ‘নবাব’ ও ‘শিকারী’ ছাড়া। একে একে ব্যর্থ হয়েছেন অঙ্কুশ, জিৎ, দেব, সোহম, প্রসেনজিতের মতো তারকারা। আর ওমের তো ক্যারিয়ারটা তার নিজের দেশেই ‘শিকেয়’ উঠেছে এপারের সিনেমায় থিতু হবার চেষ্টা করতে গিয়ে।

কেউ কেউ হয়তো শুভশ্রী, শ্রাবন্তীর নাম সফল ছবির সঙ্গে উচ্চারণ করবেন। তাদের মনে রাখা উচিত দুই তারকার দুটি ছবিই ছিলো শাকিব খানের বিপরীতে। যেখানে শাকিব খানই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হয়ে কাজ করেছেন। অথচ গেল কয়েক বছর ধরেই একটি ডাহা মিথ্যে কথা ছড়ানো হচ্ছে, কলকাতার সিনেমা না আসলে বন্ধ হয়ে যাবে এপারের সিনেমা হল।

বেশ ক’জন হল মালিক, প্রযোজক, সিনেমা আমদানি-রফতানির সঙ্গে জড়িতরা এই কথাটি ছড়িয়েছেন। তারা টিভি অনুষ্ঠান, গণমাধ্যমের সাক্ষাতকার- সবখানেই এই মিথ্যে কথাটি বলে বেড়ান। কিন্তু প্রমাণের জায়গায় থাকেন মুখে কুলুপ এঁটে নয়তো মনগড়া যুক্তি দিয়ে হিসেব বোঝানোর চেষ্টা করেন।

দিনে দিনে এই মিথ্যে কথাটিই ইন্ডাস্ট্রির হতাশাগ্রস্ত কিছু মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। সেইসঙ্গে ছোঁয়াচে রোগের মতো এই কাল্পনিক ‘থিম’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বরাতে এদেশের সিনেমার দর্শকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে।

এবার দেখা গেল মিথ্যে কথা বিশ্বাস করানোর চরম মন্দ প্রভাবটি। সেটি হলো, গেল ৩ এপ্রিল, মঙ্গলবার কলকাতার নামি পত্রিকা ‘আনন্দবাজার’ও এই মিথ্যে কথাটি বিশ্বাস করেছে এবং এদেশর চলচ্চিত্র দিবসের দিনে ‘কলকাতার সিনেমা নেই, হল বন্ধ হচ্ছে বাংলাদেশে’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের দৃষ্টতা দেখিয়েছে। কাল চলচ্চিত্র দিবসে এফডিসিতে আলোচিত বিষয় ছিলো এই রিপোর্ট। কেউ এটি নিয়ে আক্ষেপ করেছেন, কেউ লজ্জা প্রকাশ করেছেন কেউ বা অবাক হয়েছেন কলকাতার একটি পত্রিকার এমন ভিত্তিহীন ও মিথ্য সংবাদ প্রকাশের দৃষ্টতায়। তবে কেউ প্রতিবাদ করেননি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কাউকে পাওয়া গেলা না যিনি এই রিপোর্টের প্রতিবাদ জানাতে পারলেন। অথচ, কলকাতার এই রিপোর্টটি স্রেফ এপারের সিনেমার বাজার দখল করতে ব্যস্ত থাকার ওপারের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান, পরিচালক ও শিল্পী কলাকুশলীদেরই মর রক্ষার চেষ্টা। হয়তো এপারের অসাধু কিছু মানুষেরও ইন্ধন রয়েছে এতে।

অবাক করা ব্যাপার হলো, সংবাদটিতে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বক্তব্যও ছাপা হয়েছে। সেখানে মন্ত্রী বলেছেন, ‘ঢাকার চলচ্চিত্র মহলের একাংশ ক্ষুদ্র স্বার্থে বিদেশের জনপ্রিয় ছবির মুক্তিতে বাধা দিয়ে আসলে এই শিল্পকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা সরকার বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণকে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে শিল্পী ও কলাকুশলীদের কাজের অধিকার সুরক্ষিত করেছে। এপ্রিলের ৩ তারিখকে ‘চলচ্চিত্র দিবস’ হিসাবে পালন করা শুরু করেছে।’

মন্ত্রীর বক্তব্যে প্রশ্ন এসে যায়, বিদেশের ছবি বলতে কেবল কলকাতাকেই কেন ধরা হচ্ছে? সাফটায় বলিউড বা হলিউডের ছবিগুলো কেন আসে না? তামিলের সিনেমার ভালো দর্শক এই দেশে থাকা সত্ত্বেও সেই দেশের সিনেমা কেন হলে মুক্তি দেয়া হয় না সাফটার আওতায়? কেবলই কী বাংলা ভাষার অজুহাত নাকি আরও গভীর কিছু আছে? মন্ত্রীর এই বক্তব্যের সত্যতা যাচাইও হয়নি, এ বক্তব্যের ব্যাপারে চলচ্চিত্রের কেউ মন্তব্যও করেননি।

শুধু তাই নয়, রিপোর্টটিতে বাংলাদেশের সিনেমা হল মালিকদের সংগঠন ‘চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি'র নেতা সুদীপ্তকুমার দাসের বক্তব্যও ছাপা হয়েছে। সেখানে তিনি চলচ্চিত্র পরিবারের লোকজনকে ‘বেকার শিল্পী-পরিচালক বলে দাবি করেছেন। সেখানে তার বক্তব্যে বলা হয়েছে, ‘হলে লোক টানার মতো সিনেমা বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে না। আবার কিছু বেকার শিল্পী-পরিচালক সরকারি আইন মেনে কলকাতার ছবিও আমদানি করতে দিচ্ছেন না। আমরা লোকসানে হল চালাতে পারছি না। এর ফলে সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, যার সঙ্গে কয়েক হাজার মানুষের রুটি-রুজি জড়িত।’ চলচ্চিত্র পরিবারের পক্ষ থেকেই অনিয়মের যৌথ প্রযোজনা বন্ধের আন্দোলন হয়েছে এবং তারা সাফাটা চুুক্তিতে ভারসাম্যহীন সিনেমা আদান-প্রদানেরও বিপক্ষে। তাই কিছু বেকার বলতে এখানে চলচ্চিত্র পরিবারের অন্তর্ভূক্ত শিল্পী-পরিচালকদেরই বোঝায়।

দেশের সেরা নায়ক শাকিব খান দেশীয় একটি পত্রিকায় একাংশ চলচ্চিত্র পরিচালক ও শিল্পী-কলাকুশলীদের বেকার বলায় তাকে বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু বিদেশের পত্রিকায় চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতি'র নেতা সুদীপ্তকুমার দাসের বক্তব্যে চলচ্চিত্রশিল্পী-পরিচালকদের বেকার বলার পরও সবাই নিশ্চুপ! কিন্তু কেন? রিপোর্টটি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা চললেও এর সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

তবে এই প্রদর্শক নেতার ‘হলে লোক টানার মতো সিনেমা বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে না’ বক্তব্যটির প্রতিবাদ করেছেন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না কলকাতার ওই পত্রিকাটি সত্যি সুদীপ্তকুমার দাসের বক্তব্য নিয়েছে কী না। যদি নিয়ে থাকে এবং তিনি এই কথা বলে থাকেন তবে আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। কারণ এটি সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা। এই দেশে এখনো প্রতি বছর তিন-চারটা ছবি ব্যবসা সফল হচ্ছে। যিনি এই কথা বলেছেন তিনিও এই কথার সত্যতা ভালো করেই জানেন। এটা ঠিক, একটি ইন্ডাস্ট্রির জন্য বছরে তিন চারটা হিট ছবি মন্দাবস্থার প্রমাণ দেয়। কিন্তু দিনে দিনে আমরা ভালো ছবি নির্মাণের দিকে যাচ্ছি। সেটা বিশ্বাস করতে চান না আমাদের হল মালিকরা। তাদের ব্যবসা হলেও তারা সত্যি কথাটা বলেন না। আরও অদ্ভূত ব্যাপার হলো বাংলাদেশি সিনেমা নিয়ে নিয়ে আগ্রহ দেখান না তারা। পরিচালক-প্রযোজকদের তারা কলকাতার নায়ক-নায়িকা নিয়ে কাজ করতে উৎসাহিত করেন। তাদের কাছে কলকাতার সিনেমাই স্লোগান হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন? অনুসন্ধানে এর অনেক কারণ পাওয়া গেছে। সেগুলো নিয়ে কাজ করছে চলচ্চিত্র পরিবার।’

তিনি আরও বলেন, ‘কথায় কথায় যে কলকাতার সিনেমার উদাহরণ দেয়া হচ্ছে সেই ইন্ডাস্ট্রিতে বছরে কয়টা সিনেমা হিট হচ্ছে? ওদের বড় বড় তারকারা সুপার ফ্লপ হচ্ছেন। দেব-জিৎ আর প্রসেনজিতের সর্বশেষ ছবিগুলোর ব্যবসায়িক হিসেবটা কী আমাদের দেশের হল মালিকরা বা যারা ওইসব দেশের ছবি আনতে নানা কসরত করছেন তারা জানেন না? নিজের দেশেই যারা ফ্লপ, অন্যের দেশে তারা কেমন করে হল বাঁচাবে? পারেওনি। অনেকবারই তো ওইসব তারকাদের ছবি এই দেশের সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে। একটাও তো হিট করেনি। তবে কেমন করে দাবি করা হয় যে কলকাতার সিনেমা এদেশের হল বাঁচাবে? একেবারেই হাস্যকর এবং এর অন্য কারণ আছে। তাই আমি বলছি আনন্দবাজার পত্রিকাটির রিপোর্ট সম্পূর্ণই মনগড়া এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ঢাকাই সিনেমা নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। অনেক কিছুই আমরা রুখে দিয়েছি। আগামীতেও আমরা এইসব ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সচেতন ও সক্রিয় থাকবো।’

আনন্দবাজারের এই রিপোর্ট নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া নেই চলচ্চিত্রের কোনো সংগঠনের। এ ব্যাপারে মুশফিকুর রহমান গুলজার বলেন, ‘গতকাল আমরা সবাই চলচ্চিত্র দিবস উদযাপন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। তাই এ বিষয়টি নজরে আসেনি। আজ এ নিয়ে আলাপ হবে সবার সঙ্গে।’

এদিকে খোঁজ৮ নিয়ে জানা গেল, কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকার এই রিপোর্টটি বাংলাদেশ থেকেই পাঠানো হয়েছে। এখানে রয়েছে তাদের বাংলাদেশ প্রতিনিধি। পত্রিকাটিতে এপারের নাটক-সিনেমার খবর ও তারকাদের সাক্ষাতকারও এখান থেকেই পাঠানো হয় পত্রিকাটির জন্য। সেগুলো ছাপা হয় নানা ছদ্মনামে।

এলএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।