চৌরাসিয়ার বাঁশিতে হৃদয় ভেঙে খান খান

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:০২ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭

ভোর আসবে বলে চাঁদ তখন আকাশ থেকে নেমে পড়ছে। কুয়াশার বিড়ম্বনা না থাকায় আকাশ আরও সুউচ্চ মনে হচ্ছিল। আকাশের বিশালতায় হৃদয়ের জমিনও গিয়ে মিলছে যেন। হৃদয়ের সে জমিন পেতেই রাত ভর অপেক্ষা সুরপ্রেমীদের। কখন আসবে ওই বাঁশরিয়া! কখন হরণ করবে মন সেই বাঁশের বাঁশি!

অপেক্ষার ইতি টেনে আড়বাঁশি হাতে যখন মঞ্চে বসলেন, তার মিনিট পাঁচেক আগে ঘড়ির কাঁটা চারটার ঘর পেরিয়েছে। এর আগে খেয়ালের ঢেউয়ে হারিয়েছিলেন শ্রোতারা। বাঁশির যাদুকর পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়াকে মঞ্চে পেয়েই উল্লাসে ফেটে পড়েন সুর পাগলেরা। বাঁশিওয়ালা। বয়সের ভার চোখে-মুখে। কপালের চামড়া কুচকানো। চোখের মনিও ঘোলাটে। মাথার পশ্চাৎভাগে যে কয় গোছ চুল, তার সবই প্রায় পাকা। দম নিচ্ছেন নিজ শরীরেই ভর করে করে।

sayem sabu

এমন নুয়ে পড়া শরীর, তবুও অত জোর! বাঁশি ফেটে যেন সুর ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছে। রাগ ললিতায় সুরে সুরে প্রেমসুধা ঢেলে দিলেন। রাজধানীর আবাহনী মাঠে তখন শুধু সুরের সঙ্গেই মিতালি। শ্রোতারা মুগ্ধ অথচ পাথরের ন্যায় স্থির হয়ে বসে গেছেন। যারা দাঁড়িয়ে আছেন, তারাও এক চুল নড়ছেন না। বাঁশিতে কোন বেলায় মন হরণ করলো, তা সবাই ভুলেছিল সহসাই।

রাগ ললিতার পর যখন জনপ্রিয় লোকসুর পরিবেশন করেন এই সাধক, তখন যেন জ্ঞান ফিরল শ্রোতামহলে। মঞ্চের পেছনের স্কিনে ভেসে ওঠা রক্তিম সূর্য তখন ভোরের আভা ছড়াচ্ছে। সুরযন্ত্রে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় নিবিষ্ট সকলে। আর বাঁশি ছেড়ে যখন দুই হাত জোড় করে বিদায় অভিবাধন জ্ঞাপন করলেন চৌরাসিয়া, ততক্ষণে শ্রোতাদের হৃদয় ভেঙে খান খান।

sayem sabu

গতরাতে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৭-এর সমাপ্তি ঘটে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে। তিনি প্রথমে রাগ ললিত এবং পরে জনপ্রিয় লোকসুর পরিবেশন করেন। শিল্পীকে বাঁশিতে সঙ্গত করেন বিবেক সোনার ও ইউকা নাগাই, তবলাতে পণ্ডিত শুভংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, পাখোয়াজে পণ্ডিত ভবানী শংকর, এবং তানপুরাতে মুশফিকুর ইসলাম।

শেষ দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয় নৃত্য দিয়ে। বিদূষী সুজাতা মহাপাত্র মঞ্চ আলোকিত করেন ওড়িশি নৃত্য দিয়ে। পরিবেশনাটি ছিল অর্ধনারীশ্বর ও রামায়ণ-লঙ- এ দুই পর্বে বিভক্ত। রাগমল্লিকা ও তালমল্লিকা ভিত্তিক প্রথম পর্ব অর্ধনারীশ্বরের কোরিওগ্রাফি ও নৃত্য রচনা করেছিলেন প্রয়াত পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্র; সংগীত পদ্মশ্রী রঘুনাথ পানিগ্রাহী ও পণ্ডিত ভুবনেশ্বর মিশ্রের।

sayem sabu

আনুষ্ঠানিক সমাপনী অধিবেশনের পর আবার শুরু হয় বাদন পরিবেশনা। এবার মোহন বীণা পরিবেশন করেন পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভট্ট। তিনি রাগ মরু বেহাগ ও ধুন পরিবেশন করেন। শিল্পীকে তবলায় সঙ্গত করেন সুভেন চ্যাটার্জি।

মোহন বীণার পর খেয়াল পরিবেশন করেন ব্রজেশ্বর মুখার্জি। তিনি রাগ যোগ পরিবেশন করেন। এরপর তিনি একটি ঠুমরী পরিবেশন করেন। শিল্পীকে তবলায় সঙ্গত করেন শুভংকর ব্যানার্জি এবং হারমোনিয়ামে গৌরব চ্যাটার্জি এবং তারপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী এসএম আশিক আলভি ও অপূর্ব কর্মকার।

sayem sabu

এরপর সেতারের যুগলবন্দি পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে আসেন পিতা-পুত্র পণ্ডিত কুশল দাস ও কল্যাণ জিত দাস। তারা সেতারে যোগ কোষ পরিবেশন করেন। তাদেরকে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত শুভংকর ব্যানার্জি।

যুগলবন্দি পরিবেশনার পর খেয়াল পরিবেশন করেন পণ্ডিত কৈবল্য কুমার। তিনি রাগ গোরখ কল্যাণ ও খাম্বাজ রাগে ঠুমরী পরিবেশন করেন। শিল্পীকে তবলায় সঙ্গত করেন শ্রীধর মন্দ্রে, হারমোনিয়ামে ড. সুধাংশু কুলকার্নি, তানপুরায় বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থী উজ্জ্বল কুমার মালাকার ও অভিজিৎ দাস।
সবশেষে পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরের মধ্য দিয়ে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৭-এর পর্দা নামে।

এএসএস/জেএইচ/আইআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।