সপ্তাহ শেষের পথে, ডুবেই চলেছে ডুব

বিনোদন প্রতিবেদক
বিনোদন প্রতিবেদক বিনোদন প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:০৭ এএম, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

ডুব! নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর এই সিনেমাটিকে ঘিরে দর্শকদের মধ্যে ছিলো টানটান উত্তেজনা। কেন থাকবে না? দর্শক আক্রান্ত ছিলেন সিনেমাটি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের জীবনী নিয়ে তৈরি নামক স্ট্যান্টবাজিতে। ডুব’র নায়িকা কলকাতার পর্ণ মিত্র বলেছিলেন এটি হুমায়ুনের বায়োপিক। বাংলাদেশি অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীও বলেছিলেন একই কথা।

এরপর হুমায়ুন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এটির প্রতিবাদ জানায়। নির্মাতা ফারুকি বলেন, ‘এটা হুমায়ুনের বায়োপিক নয়’। সমস্ত বিষয়টি নিয়ে হয়েছে বিস্তর জলঘোলা। এরপর ২৭ অক্টোবর কিছু দৃশ্য কর্তনের পর ভারত ও বাংলাদেশে একযোগে মুক্তি পায় যৌথ প্রযোজনার এ সিনেমাটি। ছবিটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই। এইসব কিছুর বাইরে থেকে রাজধানীর হলগুলো ঘুরে বিশেষ এই রিপোর্ট লিখেছেন রুদ্র রুদ্রাক্ষ-

মুক্তির প্রথম দিন থেকেই দর্শক পায়নি ছবিটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে ছবিটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা। কেউ কেউ লিখেছেন নিজের জীবনের ষষ্ঠ সিনেমা নির্মাণে এসে এটা কি করলেন ফারুকী? তিনি নিজেকে উপস্থাপন করলেন আনকোরা নির্মাতার মতোই। আবার কেউ কেউ একথাও বলছেন, নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ সিনেমাটি বানিয়ে ফেললেন ‘ডুব’।

এদিকে প্রথম সপ্তাহ শেষের পথে। ৩৯টি হলে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি কোনো হলেই আশানুরূপ ব্যবসা দিতে পারেনি। ১২ কোটি টাকার ছবির এমন দৈন্যদশায় হতাশ চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও ব্যবসায়ীরা। বুকিং এজেন্ট সূত্রে ঢাকার বাইরের হলগেুলোর সেল রিপোর্ট শুধু হতাশারই নয়, খানিকটা লজ্জারও। ঢাকার কিছু হলে তবু ছবিটি দেখতে আসছেন দর্শক। বিশেষ করে সিনেপ্লেক্সগুলো এখনো জমিয়ে রেখেছে ডুব। কিন্তু সেটাও ডিমে তালে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকটি সিনেমা হলের ম্যানেজার জাগো নিউজকে জানায়, দর্শক টানতে পারছেনা ডুব। এরকম হাইপ ক্রিয়েট করা একটা সিনেমা এভাবে মার খেয়ে যাবে ভাবতেও পারেননি তারা।

এরপর হল থেকে হলে ছুটে জাগো টিম। রাজধানীর বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সে চলছে সিনেমাটির ১৩টি শো। কিন্তু দর্শক সমাগম দেখে হতাশ হতেই হয়। হল থেকে বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর ছাত্র নাবিল আহমেদ বললেন, ‘বন্ধুর মুখে শুনেছি ছবিটি হুমায়ুন আহমেদকে নিয়েই বানানো। সেটাই দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু ইরফান খান যেভাবে ভেঙে ভেঙে বাংলা বলে তাতে আমার মনে হয়েছে আমরা ব্রিটিশ কোনো কবি বা লেখকের বায়োপিক দেখছি। যাকে এই দেশে থাকার বদৌলতে জোর করে বাংলা শিখতে হয়েছে।’

এটা তো হুমায়ুন আহমেদের বায়োপিক নয়, নির্মাতা নিজেই বলেছে। হুমায়ুন আহমেদ যদি আপনার মাথায় না থাকতো তাহলে ব্যপারটা কীভাবে নিতেন? নাবিল বলেন, ‘গল্পের প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজেই মনে হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের বায়োপিক দেখছি। পরিচালক তার মতো গুণী মানুষকে স্রেফ বিক্রি করে দিয়েছেন ভন্ডামী করে। তার মিথ্যাচারে বিরক্ত লাগলো ছবিটির গল্পে প্রবেশ করে।

আর যদিওবা তর্কের খাতিরে মেনে নেই এটা হুমায়ুন জীবনী নয়। একজন বাংলাদেশি লেখক ও নির্মাতার জীবনী। সেখানে প্রথমেই মার খেয়ে গেছে ইরফান খানের উচ্চারণ। আমার মনে হয় না এই একটা মন্দ লাগার কথা বলে আর সামনের দিকে এগোনোর সুযোগ আছে। ইরফান খান মিসকাস্টিং অন্তত তার বাংলা উচ্চারনের জন্য। এতোবড় গ্যাপ নিয়েও যখন শুনব ফারুকী এই ছবির জন্য পুরস্কার পেয়েছেন তখন সেটা হাস্যকর বৈকি।’

জুবায়ের সিদ্দিকি আপন কাজ করেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন সিনেপ্লেক্সে। সিনেমা দেখে বের হয়ে চরম উচ্ছ্বসিত তারা। বললেন, ‘সিনেমাটি দারুণ লেগেছে। আর মুলত আমরা দুজনেই হুমায়ুন স্যারের ভক্ত। এজন্যই জীবনে প্রথমবারের মত সিনেমা হলে এসেছিলাম। আর তানিয়ার সাথে আমার প্রেমটাও হয় হুমায়ুন আহমেদের বই বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। তবে স্যারের পূর্ণাঙ্গ জীবনীটা দেখতে পেলে ভালো লাগতো। পরিচালক এখানে অনেক কিছু উল্টে পাল্টে দিয়েছেন।’

নির্মাতা তো বলেছেন এটা হুমায়ুনের বায়োপিক না। তাহলে আপনি কীভাবে হুমায়ুন আহমেদকে খুঁজে পেলেন এখানে? জাগো নিউজের এমন প্রশ্নের জবাবে আপন বলেন, ‘আসলে ডুব নিয়ে তর্ক বিতর্ক শুরু হওয়ার পর থেকেই আমি পত্রিকার বিনোদন পাতায় চোখ রাখতাম। আমার কাছে মনে হয়েছে কৌশলগত কারণেই নির্মাতা এটা অস্বীকার করেছেন। তাতে খুব বেশি ক্ষতি নেই। আমরা যারা স্যারের ভক্ত তারা মেঘের আড়াল থেকেও স্যারের ছায়া স্পস্ট দেখতে পারি।’

সিনেমাটি এই নিয়ে তিনবার দেখেছেন উল্লেখ করে তেঁজগাও কলেজের হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র পলাশ বলেন, ‘এরকম সিনেমা আরও অনেক নির্মাণ হওয়া উচিৎ। আমরাও চাই উইকেন্ডে সিনেমা হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখতে। কিন্তু মানসম্মত সিনেমার অভাবে হলে যেতে পারি না। ছবির গানটা বেশ ভালো। তিশা ভালো অভিনয় করেছেন। ইরফান খান খুব বাজে ছিলেন উচ্চারণে।’

রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত মধুমিতা সিনেমা হল। সোমবার হল থেকে বেড়িয়ে নিজের প্রতিক্রিয়ার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আরিশা ইসলাম বলেন, ‘স্যারকে দেখতে এসেছিলাম। কিন্তু ইরফান খানের বাংলা বলা শুনেই মন খারাপ হয়েছে। ভালো বাংলা বলতে পারে এমন কাউকে কাস্ট করলেই পারতেন নির্মাতা। আর হুমায়ূনের জীবনী দেখাতে এতো নাটকের কী প্রয়োজন বুঝতে পারছি না। সুন্দর ছবি, কিন্তু নির্মাণে সততার অভাব আছে। আমি ছবিটাকে দশের মধ্যে তিন দেব।’

এদিকে রাজধানীর বলাকা সিনেমা হলে গিয়েও দেখা গেল হতাশার করুণ চিত্র। নেই দর্শক। যারাওবা আসছেন ছবি শেষ না করেই বের হয়ে যাচ্ছেন। হলের কর্মচারী সাজিদ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘ম্যালা বাজেটের সিনেমা ভেবে হল মালিক ছবিটি এনেছিলেন। কিন্তু এভাবে মার খাবে ভাবতে পারেননি। এখন মাথায় হাত। ভারতের হিরো আছে তবু মানুষ আসে না। আর দেশের একজন স্যারকে নাকি ছবিতে অপমান করা হইছে এজন্য ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও আসছে না। এই হলের বড় কাস্টমার তো তারাই ‘

তিনি আরও বললেন, ‘তবে এমন নজির আছে যে একটা সিনেমার প্রথম সপ্তাহে খুব বাজে অবস্থা কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আপাতত এটুকু সান্ত্বনা দিচ্ছি নিজেকে, ডুব ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ এরকম বিগ বাজেটের একটা সিনেমা ফ্লপ হলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির উপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমাদেরও কয়েক মাস ভুগতে হবে।’

বলাকায় সন্ধ্যার শো শেষ করে বের হচ্ছিলেন ইডেন কলেজের দুই বান্ধবী। নাম ইলা ও তন্বি। ছবি দেখার অনুভূতি জানাতে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন তারা। বললেন, ‘মিথ্যে স্ট্যান্টবাজি করে মুখে ফেলা তুলে ফেলা হয়েছে ছবিটি নিয়ে। কিন্তু দর্শক হিসেবে এই ছবি থেকে ভালো লাগা বা মন্দ লাগা কোনো কিছুই পেলাম না। মনে হচ্ছে কেউ একটা কিছু সামনে ছেড়ে রেখেছে, কাজ নেই তাই দেখছি। হুমায়ূনের আহমেদের জীবনীটাই আসলে নির্মাতা দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু উনার পরিবারের বাঁধা পেয়ে সেটা আর পারেননি মনের মতো। তাই সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। আমি ফেসবুকে আনিসুল হকের স্ট্যাটাস দেখে এসেছিলাম। কিন্তু উনার কথার কোনো মিল এই ছবিতে নেই। অনেক বাড়িয়ে বলেছেন তিনি।’

শ্যামলী সিনেমা হলের অবস্থা আরও করুণ। হলটির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‌‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমার পর বড় একটি ধাক্কা হয়ে আসলো ‘ডুব’। প্রথম দুইদিন আশায় ছিলাম দর্শক বাড়বে বলে। আজকাল তো এমনটা হচ্ছেই। ‘আয়নাবাজি’ ও ‘ঢাকা অ্যাটাক’ প্রথম দুই-তিনদিন দর্শক পায়নি। পরে হুমড়ি খেয়েছে দর্শক। কিন্তু ডুবের বেলায় সেই লক্ষণ নেই। দর্শক ছবি দেখে বাজে রিঅ্যাক্ট করছেন। কোনোমতে সপ্তাহটা পার করতে চাইছি। আগামী সপ্তাহ থেকে আবারও ঢাকা অ্যাটাক চলবে। আমাদের ফেসবুক প্যাজেও সেই ঘোষণা দেয়া আছে।’

বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়া ও ভারতের এসকে মুভিজের যৌথ প্রযোজনায় তৈরি ‘ডুব’ ছবির প্রধান চরিত্র অভিনয় করেছেন ইরফান খান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, রোকেয়া প্রাচী, পার্ণো মিত্র প্রমুখ।

এলএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।