পরিচিত যৌনকর্মী হওয়াতেই যত আপত্তি

কাওসার বকুল
কাওসার বকুল কাওসার বকুল , সহ-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:৫৫ এএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

নওগাঁর ১১টি উপজেলার মধ্যে মান্দা’র অবস্থান সর্ব দক্ষিণে; একেবারে রাজশাহী-নওগাঁ জেলা সীমান্তে। মান্দা’র প্রত্যন্ত এক অঞ্চলের নাম দেলুয়াবাড়ি। বিভাগীয় শহর রাজশাহী থেকে ৪৫ কিলোমিটার উত্তরের দেলুয়াবাড়ি নওগাঁ থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে।

এখানকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষিজীবী, উৎপাদন সম্পর্কে তারা মূলত ভূমি শ্রমিক; সঙ্গে রয়েছে সামন্ত প্রভুদের প্রতাপ। ফলে খুব একটা বেশি এগোতে পারেনি মানুষগুলো।

তবে প্রভুদের শিক্ষায় ঝোঁক ছিল। সেই ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠা হয় এই এলাকার প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছিল উচ্চ বিদ্যালয়ও। মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও স্বাধীনতাযুদ্ধের পর প্রথম মহাবিদ্যালয় গড়ে ওঠে এ অঞ্চলে।

পিছিয়ে পড়া এ মানুষগুলোর বিনোদনের মাধ্যম ছিল সাপখেলা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, কবিগান, মাদারের গান, আলকাপ গান আর হরি বাসর। তবে যাত্রাগান ছিল এ অঞ্চলের বিনোদন মাধ্যমগুলোর অন্যতম।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মানুষের বিনোদনের বহুল জনপ্রিয় মাধ্যম যাত্রাগানকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করেন এই অঞ্চলের সংস্কৃতিমনা কিছু লোক। যারা এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন আবুল কালাম তাদেরই একজন; প্রচুর জমির মালিক এই মানুষটি, এক কথায় যাকে বলে সামন্ত প্রভু।

কালাম ও তার কিছু বন্ধুবান্ধব মিলে ১৯৭২-এ গড়ে তোলেন ‘রজনীগন্ধা একতা বহুমুখী সংসদ’ (যার রেজিস্ট্রেশন নম্বর-৪৩৮)। ক্লাবটি ছিল মূলত এই মানুষগুলোর অবসর কাটানোর একটি জায়গা, সঙ্গে তারা টুকটাক সমাজসেবামূলক কাজও করতেন।

বাল্যবিবাহ বন্ধ, নারী নির্যাতনের বিচার করা, গরিব শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার খরচ দেয়া, শহর থেকে চিকিৎসক নিয়ে এসে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

ক্লাব চলত সদস্যদের মাসিক চাঁদায়; টাকা জমা হতো সদস্যদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট একজনের কাছে। উদ্দেশ্য, জমানো টাকা দিয়ে টুকটাক কিছু কাজ করার পাশাপাশি সদস্যদের নিয়ে বিশেষ দিনে পিকনিকের আয়োজন করা।

এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে এই ক্লাব থেকে আয়োজন করা হতো নাট্যানুষ্ঠানের। ধান কাটার পর কিংবা শীত মৌসুমে সদস্যরা অবসর পেলে নিজেরা মিলে বিভিন্ন নাটকের রিহার্সেল করতেন।

মাস দুয়েক মহড়ার পর গণচাঁদা তুলে ব্যবস্থা হতো নাটক মঞ্চায়নের। নাটকে সদস্যরা নিজেরা অভিনয় করলেও নারীশিল্পী, পোশাক, বাদ্যযন্ত্র ও বাদককে ভাড়া করে নিয়ে আসা হতো কোনো যাত্রাদল থেকে।

গ্রামের মানুষ এই আয়োজনকে বলত ড্রামা নাটক। এভাবেই চলছিল; পরবর্তী সময়ে ক্লাবের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন যাত্রাদল নিয়ে এসে দর্শনীর বিনিময়ে তা দেখানোর।

এরপর দেলুয়াবাড়ীতে তারা আয়োজন করেন যাত্রানুষ্ঠানের। দর্শক-চাহিদা দেখে পরবর্তীকালে ক্লাবের পক্ষ থেকে পার্শ্ববর্তী সাবাই হাট, চৌবাড়িয়া হাট, পানিয়াল, একরুখী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ ও তেঁতুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্যান্ডেল নির্মাণ করে যাত্রা দেখানো হয়।

hall

যাত্রা প্রদর্শনীর উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেয়া হতো বিশেষ করে শীত মৌসুমকেই; জমজমাট আয়োজনে তা শুরু হতো মধ্যরাতে। এ উৎসব চলত এক নাগাড়ে পাঁচ থেকে সাতদিন; দর্শক ছিল নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবাই।

যাত্রানুষ্ঠানে রজনীগন্ধা ক্লাবের সফলতা দেখে সমসাময়িক সময়ে গড়ে ওঠে আরও দু-একটি ক্লাব। এদের মধ্যে অন্যতম ‘শ্রীরামপুর টাইগার ক্লাব’ (১৯৭৪/৭৫), একরুখী প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার ‘মিলন সংঘ’ (১৯৭৭)। এ ক্লাবগুলোর পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও যাত্রা আয়োজনের কথা শোনা যায়।

তাদের মধ্যে অন্যতম সাবাই হাটের মিষ্টি ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র। যাত্রা যেখানেই হোক না কেন প্রত্যেক আয়োজনে বিপুলসংখ্যক লোক সমাগম হতো। এভাবেই চলছিল ১৯৮০ সাল অবধি। এরপর ক্লাবের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন, আর শিল্পী ভাড়া করবেন না, নিজেরাই যাত্রাদল করবেন। রজনীগন্ধা থেকে একটি যাত্রাদল গঠন করা হয় ১৯৮১ সালের দিকে।

প্রথম দিকে এই দলের যাত্রা দেখতে লোক সমাগম ভালো হলেও ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। ফলে ক্ষতির মুখ দেখতে থাকে দলটি। দীর্ঘদিন ধরে যাত্রা দেখে আসা এসব মানুষ কোনো এক অজানা কারণে যাত্রা দেখতে আসছিল না!

বিনোদনের বিকল্প কোনো মাধ্যম অবশ্য তখনো হাজির হয়নি। এ নিয়ে ক্লাবের সদস্যরা এলাকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন, নারী অভিনয়শিল্পীদের কারণেই আসলে দর্শক আগ্রহ বোধ করছে না।

রজনীগন্ধা ক্লাবের যাত্রায় মূলত নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য নেয়া হয় দেলুয়াবাড়ি বাজারের পার্শ্ববর্তী কইকুঁড়ি (অনেকের কাছে জায়গাটি ‘হঠাৎ পাড়া’ নামেও পরিচিত) থেকে। ভূমিহীন নিঃস্ব কতগুলো নিম্নবর্গের মানুষের বাস ছিল সেখানে। জীবিকার জন্য যাদের অনেকেই যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করত।

যাত্রাগানের নারী চরিত্রে অভিনয় করেছিল এই যৌনকর্মীরাই। এর আগে যখন যশোর থেকে নারী ভাড়া করে যাত্রা করানো হতো, তখন কিন্তু ঠিকই দর্শক এসেছিল। কিন্তু দর্শকের কাছে সঙ্কটটি দেখা দিল দেলুয়াবাড়িরই নারীরা অভিনয় করায়।

একে তো এই নারীরা পরিচিত, তার ওপর যৌনকর্মী; পরিচিত এই যৌনকর্মীদের অভিনেত্রী হিসেবে মঞ্চে মেনে নিতে পারছিল না এলাকার লোকজন! অথচ চেনা পুরুষের বেলায় কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি।

ফলে দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে বিনোদন দিয়ে আসা এই রজনীগন্ধা ক্লাবের সদস্যরা খানিকটা বাধ্য হয়েই যাত্রাদল বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকেন।

কেএ/এলএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।