কেন কমে যাচ্ছে সিনেমা হল?

কাওসার বকুল
কাওসার বকুল কাওসার বকুল , সহ-সম্পাদক, আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:১৮ পিএম, ০৬ আগস্ট ২০১৭

যৌগিক শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্রকে ভাগ করলে এক ভাগে নির্মাণ এবং অন্য অংশে পড়ে প্রদর্শন। পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলি সবাই মিলে এতো শ্রম দিয়ে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, তার শেষ ঠেকে প্রেক্ষাগৃহে গিয়েই। এই প্রেক্ষাগৃহেই রচিত হয় চলচ্চিত্রের সফলতা কিংবা ব্যর্থতা।

চলচ্চিত্রের আসল উদ্দেশ্য যেহেতু দর্শকের কাছে যাওয়া, তাই দর্শকের কথা মাথায় রেখেই চলচ্চিত্রের কারিগরির সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ অংশ প্রক্ষেপণের দিকেও খেয়াল রাখতে হয় সমানভাবে। অন্যথায় পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকুশলিদের অত্যন্ত পরিশ্রমে নির্মিত চলচ্চিত্রটি ব্যর্থ হয়।

একসময় পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো চলচ্চিত্রের রঙিন হাওয়া ভারতীয় উপমহাদেশেও বইতে শুরু করে। রাশিয়া, জার্মানির ধারাবাহিকতায় ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই তৎকালীন বোম্বাইয়ের ওয়াটসন হোটেলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য আসেন লুমিয়ের ভাইয়েরা।

অবশ্য তা শুধু প্রদর্শনেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে বাণিজ্যিক সফলতা লাভের অল্প সময়ের মধ্যেই চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা শুরু করেন আমাদের দেশের হীরালাল সেন। যদিও সেই কৃতিত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাকে দিতে দেখা যায় না। আর পঞ্চাশের দশকে ‘মুখ ও মুখোশ’-এর মাধ্যমে আজকের বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণের পথ উন্মুক্ত হয়। একটি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিও দাঁড়িয়ে যায়।

পরবর্তী সময়ে প্রদর্শনের উন্নতির জন্য একে একে আবিষ্কার হয়েছে নানা আধুনিক যন্ত্র; ১৬ মিলিমিটার, ৩৫ মিলিমিটারের গণ্ডি পেরিয়ে প্রদর্শনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এসে ঠেকেছে থ্রিডি আইম্যাক্স স্ক্রিন-এ। ৭২ ফুট দীর্ঘ ও ৯২ ফুট প্রস্থের এই আধুনিক প্রযুক্তির পর্দায় প্রদর্শন করা যায় সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি রেজ্যুলেশনের চলচ্চিত্র।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেই যখন প্রদর্শন প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষ, ঠিক সেই সময়ে আমাদের দেশে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একসময়ের গড়ে ওঠা অসংখ্য প্রেক্ষাগৃহ বা সিনেমা হল। অথচ গত এক শতকে নানা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার মধ্য দিয়ে এই প্রেক্ষাগৃহগুলো গড়ে উঠেছিল। হয়ে উঠেছিলো আমাদের আনন্দের দারুণ এক মাধ্যম।

এখন তাহলে সিনেমা হল বন্ধ কিংবা ভেঙে ফেলা হচ্ছে কেন? তাহলে কী ছিলো আমাদের অতীত, আর বর্তমান অবস্থাই-বা কী? প্রেক্ষাগৃহের এই ভাঙা-গড়ার বিষয়টা আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে মিলিয়ে পর্যবেক্ষণ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রদর্শন শুরু হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে এখানকার মানুষের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিনোদন মাধ্যম। দর্শক চাহিদার কারণে বাড়তে থাকে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা।

দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ১২০টি প্রেক্ষাগৃহ ছিলো। ১৯৫৪ সালে এসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২২টিতে। একটি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিও দাঁড়িয়ে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহের এই সংখ্যা ২০৮টিতে পৌঁছায়। এ যাবৎ দেশে এক হাজার দুইশ ৩০টি প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ হলেও বর্তমানে ২০১৭ সালে এসে এক-তৃতীয়াংশ প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গেছে।

দেশের এমন অনেক জেলা শহর রয়েছে, যেখানে একসময় প্রেক্ষাগৃহ থাকলেও বর্তমানে আর নেই। কোনো কোনো জেলায় কিছু বন্ধ আছে, কিছু ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। বাকিগুলো কেবল ঈদ উপলক্ষে চালু করা হয়। কতগুলো সারের কিংবা খাদ্যের গুদাম করে ফেলা হয়েছে। আবার যেসব প্রদর্শক এখনও ভেঙে ফেলেননি, সেগুলোও ভেঙে ফেলার উপক্রম।

তাহলে কোন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সেই সময়ে এতগুলো প্রেক্ষাগৃহ গড়ে উঠেছিল, আর বর্তমানে সেগুলোর এই দৈন্য দশা কেন; এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া মানুষ তো চলচ্চিত্র দেখছে; তবে চলচ্চিত্র দেখার মূল যে স্থান প্রেক্ষাগৃহ, সেখানে তারা আর সেভাবে যাচ্ছে না। প্রেক্ষাগৃহ যেভাবে গড়ে উঠেছিল আর বর্তমানে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে; অনেক প্রেক্ষাগৃহই ভেঙে ফেলা হয়েছে, বাকিগুলোও ভেঙে ফেলার উপক্রম, এর কারণ খুঁজে দেখার জন্যই জাগো নিউজের নতুন আয়োজন।

এই আয়োজনে অনুসন্ধান করা হবে কোন আর্থ-সামাজিক অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রেক্ষাগৃহ গড়ে উঠেছিল; প্রেক্ষাগৃহ বন্ধের কারণ কী কী; আর প্রেক্ষাগৃহের বর্তমান অবস্থা কী- সেটাও।

সমসাময়িককালে গণমাধ্যমবোদ্ধা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও অবশ্য এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করছেন। তাদের অনেকেই সিনেমা হলের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তো কেউ দুষছেন চলচ্চিত্রকে।

তবে সেই আলোচনার বেশিরভাগই চলচ্চিত্রের আধেয় বিশ্লেষণ মানে নির্মাণকেন্দ্রিক, না হয় চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের মতামত নির্ভর। চলচ্চিত্রের যে আরেক অংশ প্রদর্শন; সেই প্রদর্শনের স্থান-প্রেক্ষাগৃহ বা সিনেমা হল নিয়ে তেমন কোনো সংবাদ কিংবা বিশ্লেষণী লেখা খুব একটা দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহগুলো যেহেতু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে দর্শকের প্রেক্ষাগৃহ ছাড়ার কারণ খুঁজে বের করা দরকার। তবে সেটা কোনোভাবেই কেবল প্রদর্শিত চলচ্চিত্রের আধেয় বিশ্লেষণ কিংবা চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতামত নির্ভর নয়। এজন্য প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্ট মানুষদের কাছ থেকে এর সঙ্কট, সম্ভাবনার কারণ জানতে হবে।

কারণ, প্রেক্ষাগৃহ সংশ্লিষ্ট প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলোর কাছ থেকেই উঠে আসতে পারে সঙ্কটের মূল কারণ। তাতে প্রেক্ষাগৃহ গড়ে ওঠার স্বরূপ সুস্পষ্টভাবে উন্মোচিত হবে।

এলএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।