ঈদের পর বন্ধ হয়ে যাবে ঝুমুর সিনেমা হল
একসময়ে বাংলা ছবির পোকা যারা ছিলেন, তারা বেশিরভাগই এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। সেজন্য সিনেমা হলে এখন আর উপচে পড়া ভিড় দেখা যায় না। দর্শক না থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের শহর ও মফস্বলের অধিকাংশ সিনেমা হল।
এতে চরম হতাশা আর লোকসান গুনতে হচ্ছে হল মালিকদের। তাই এই হতাশা আর লোকসান কাটাতে মালিকরা সিনেমা হলের ব্যবসা বাদ দিয়ে ঝুঁকছেন অন্য ব্যবসায়। হল বন্ধের মিছিলে যোগ হতে যাচ্ছে গাজীপুরের জনপ্রিয় সিনেমা হল ‘ঝুমুর’। ঈদের পরই হলটি বন্ধ করে দেয়া হবে বলে জানা গেছে।
শুক্রবার (৯ জুন) বিকেলে গাজীপুরের জয়দেবপুরে অবস্থিত ঝুমুর সিনেমা হলে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দর্শক-খরায় ভুগছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এই সিনেমা হলটি। বিকেলের শোতে চলছিল জীবন চৌধুরী পরিচালিত ‘জীবন মরণ’ ছবিটি। দুই শতাধিক আসন বিশিষ্ট ঝুমুর হলে লোক সংখ্যা ছিলো সর্বসাকুল্যে ১০ জন! হলটির কোথাও তার নাম নেই। খালি দেখাচ্ছে ‘নেমপ্লেট’।
ঝুমুর সিনেমা হলে ঘুরে তেমন কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে হলের হিসাবরক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন প্রাণেন্দু ঘোষ। তিনি বলেন, ‘আমি ঝুমুর হলে চাকরি করছি ছয় বছর। চাকরি নেয়ার পর এই হলে শুধুমাত্র একবার দর্শকদের জোয়ার দেখেছিলাম। ‘তোর কারণে বেঁচে আছি’ ছবি দেখতে দর্শকের ঢল নেমেছিলো। এরপর আর কোনো ছবিতেই দর্শক দেখিনি। মালিক লোকসান গুনেই চলেছে। অবশ্য হলের পরিবেশও ভালো না। দর্শক এমন পরিবেশে কেন ছবি দেখবেন টাকা দিয়ে!’
প্রাণেন্দু ঘোষ বলেন, ‘বছরের পর বছর এভাবে লোকসান বহন করা আর মালিকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আমরা এখানে ১৫ জন কর্মচারী আছি, তারাও ঠিকমতো বেতন পাই না। দুই মাস-চার মাস পর পর আমাদের বেতন দেয়া হয়। আমাদের প্রাথমিকভাবে জানানো হয়েছে ঈদের পর ঝুমুর বন্ধ হয়ে যাবে। শুনেছি, সিনেমা হল ভেঙে নাকি আবাসন কোম্পানিকে দিয়ে শপিং মল বানানো হবে।’
ঝুমুর সিনেমা হলের ম্যানেজারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি মুঠোফোনে খোঁজ করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। আগামী ঈদে কোন ছবি চালানো হবে সেটা এখনও ঠিক হয়নি বলে জানান প্রাণেন্দু ঘোষ। তিনি বলেন, ‘ঈদের ছবিতেও লোক হয় না। শুধু শুধুই লোকসান গুনতে কে চায় বলুন? তারপরও আগামী সপ্তাহে জানা যাবে কোন ছবি ঈদে আসছে।’
মানুষ কেন হলে আসেনা জানতে চাইলে প্রাণেন্দু ঘোষ বলেন, ‘এখন তো ঢিশ এন্টেনার (স্যাটালাইট টিভি) যুগ। কিছুদিন অপেক্ষা করলে সব ঘরে বসেই দেখা যায়। ফেসবুক, ইউটিউবেও মানুষ ছবি দেখছে। তাহলে আর হলে কেন আসবে? আর হলের পরিবেশ ভালো না। নোংরা, ফ্যান নেই। ছারপোকায় ছেয়ে আছে পুরো হল। বসার আগেই আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। তাহলে টাকা দিয়ে কেন লোকজন কষ্ট করতে আসবে। তারচেয়ে আরামসে ঘরে শুয়ে-বসে বিনোদন নেয়াই ভালো।’
ঝুমুর সিনেমা হলের মালিক ঢাকার ব্যবসায়ী সাফ উদ্দিন এলাহি চৌধুরী। তিনি হল ব্যবসা ছাড়াও আরও কিছু ব্যবসায়ে জড়িত। এই হলটির ভিত্তি প্রস্তর উদ্বোধন করেন তৎকালীন শিল্প ঋণ সংস্থার চেয়ারম্যান জবান বজল আহমেদ, ৯ মে ১৯৮০ সালে। তবে সিনেমা প্রদর্শিত শুরু হয় ১৯৮১ সাল থেকে।
এদিকে, গাজীপুর জেলা তথ্য অফিস ও সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১৮টি সিনেমা হল ছিল। এগুলো হলো চান্দনা, ঝুমুর, নন্দিতা, উল্কা, বর্ষা, বর্ষণ, চম্পাকলি, আনারকলি, ক্যাপ্রি, এরিণ, মোহনা, সাগর, আলোঘর, নাদিয়া, বনরুপা, শাপলা, চিত্রপুরী ও মনোরম। গত ৫ বছরে এই ১৮ টি সিনেমা হলের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো আছে সেগুলোও বন্ধ হওয়ার পথে। ঘরে ঘরে টেলিভিশন, ডিস ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে এবং হলের পরিবেশের কারণে মানুষ এখন ঘরে বসেই সিনেমা দেখে। ফলে সিনেমা হলের দিকে আগ্রহ নেই মানুষের।
স্থানীয়দের দাবি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় হলগুলো সংস্কার করলে দেশের চলচ্চিত্রশিল্প আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে।
এনই/এলএ