সত্যজিৎ স্মরণে অপু-অপর্ণা
রেললাইনের পাতা খুঁটিতে কান পেতে অপু-দুর্গা যেদিন দূরাগত রেলের আওয়াজ শুনেছিলেন, বাংলা ছবিও যেন সেদিনই কান পেতে শুনেছিল আধুনিকতার পদধ্বনি। বস্তুত সত্যজিতের আগেও বাংলা ছবি ছিল, তবে বলা ভালো তা ছিল সাহিত্যের নেওটা, ছায়া অনুসারী। সাহিত্যের সাতমহলায় দাঁড়িয়েও ছবিকে পৃথক শিল্প হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবার আত্মবিশ্বাস বাংলা ছবিকে দিয়েছিলেন এই মানুষটিই। গল্প বলার নিখুঁত কাঠামো থেকে নান্দনিকতার শীর্ষবিন্দু ছোঁয়া সম্ভব হয়েছিল তার জন্যই৷ তাই আজও শুধু বাংলা নয় বিশ্বের সিনেপ্রেমী এই মহারাজাকে সালাম জানায়।
কিন্তু সে তো সিনেদুনিয়ার তুলে রাখা সম্ভ্রমের ডালি। আর তার ঘরের ‘অপর্ণা’? বিভূতিভূষণের পাতা থেকে যাকে নিজের হাতে তুলে সাজিয়েছিলেন সত্যজিৎ? সত্যজিতের জন্মদিনের প্রাক্কালে বাংলা ছবির মহারাজাকে স্মরণ করলেন তার ‘অপর্ণা’ শর্মিলা ঠাকুর। পাশে বসে সত্যজিতের ‘অপু’৷ অজস্র মণি-মাণিক তখন ভিড় করছে তাদের স্মৃতিপথেও।
ছোটবেলা থেকে কোনোদিন অভিনয় করবেন ভাবেননি শর্মিলা। অপর্ণার জন্য তখন কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তার প্রোডাকশনেরই একজন চিনতেন শর্মিলাকে। তিনিই শর্মিলার বাবাকে ফোন করে বলেন দেখা করতে। একদিন গুটি গুটি পায়ে গিয়ে হাজিরও হন শর্মিলা। দরজা খোলেন স্বয়ং বিজয়া রায়। শর্মিলাকে দেখেই তড়িঘড়ি শাড়ি পরে আসতে বলেন। তারপর মনে মনে ভেবে রাখা অপর্ণার ছবির সঙ্গে তাকে মিলিয়ে নেন। ব্যাস বাংলা ছবি সেদিনই পেয়ে গেল তার চিরকালীন সম্পদকে।
প্রথম দিনের কথা শুটিংয়ের কথা আজও মনে করতে পারেন তিনি। শট ছিল, অপু দরজা খুলে বলবে, এসো। ঘরে ঢুকবে অপর্ণা। সেদিন এতটুকুও নার্ভাস ফিল করেননি। আজ এই বয়সে এসে বুঝতে পারেন, কার সঙ্গে কাজ করছেন বুঝে ফিল করার মতো নার্ভ ছিলই বা কোথায়! সেদিন তার ‘মানিকদা’ বলেছিলেন, এদিকে তাকাও, ওদিকে তাকাও, ডাইনে দেখো, বাঁয়ে দেখো- কথামতো কাজটুকু করে গিয়েছিলেন তিনি। শট শেষে মিলেছিল জলদ গম্ভীর স্বরের প্রশংসা– ‘ভেরি গুড’।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির শুটিংয়ের সঙ্গে ক্ল্যাশ করে শক্তি সামন্তর ‘আরাধনা’ ছবির শুটিং। কিন্তু মানিকদার শুটিং ফেলে যাননি শর্মিলা। ফলে ‘আরাধনা’র আইকনিক দৃশ্যটি স্টুডিওতে শুট করা হয়েছিল। আজ মজা করে শর্মিলা বলেন, যদি ছবি ফ্লপ করত তাহলে শক্তিদা হয়তো তাকে আর পরের ছবিতে নেওয়া তো দূরের কথা, মুখই দেখতেন না। সেই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শুটিংয়ে সত্যজিতের জন্মদিনও পালন করা হয়েছিল।
অন্যদিকে সত্যজিতের ‘অপু’ যিনি, তিনি সত্যজিতের সবচেয়ে বেশি ছবিতে অভিনয় করা অভিনেতাও বটে। ‘পথের পাঁচালী’র সাফল্যের পর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধুবান্ধবরা এক সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেছিল। সেখানেই সত্যজিতের সঙ্গে তার প্রথম পরিচয়। তারপর তো শুরু হলো এক অন্য পথের পাঁচালীর। বাংলা ছবিতে পরিচালক-অভিনতার বৌদ্ধিক দীপ্তিতে যা ভাস্বর।
আরও এক জন্মদিন তার? সেই জন্মদিন উপলক্ষে শহরে তার ছবি নিয়ে হয়েছিল এক উৎসবের আয়োজন। সেখানেই সত্যজিতের অপু-অপর্ণা স্মৃতিসরণিতে হাঁটতে হাঁটতে হাত ধরলেন তাদের ‘মানিকদা’র।
বিএ/পিআর