সব সুলতানের নৌকা ভিড়ুক বিবিয়ানার ঘাটে


প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ০২ এপ্রিল ২০১৭

সমাপ্তি
বলা হয়ে থাকে কোনো গল্পের শেষটাই গল্পটিকে পাঠকের কাছে সার্থক করে তুলে, গল্পকারকে সফল করে তুলে। একইভাবে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও সমাপ্তির একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। ছবি শেষ হবার পর তার রেশ দর্শকের মনে দাগ না কাটলে ছবিটি মার খেয়ে যায়। সেইদিক থেকে বলা চলে ‘সুলতানা বিবিয়ানা’ নির্মাণ করে সফল হতেই যাচ্ছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে অভিষিক্ত হওয়া হিমেল আশরাফ। সফল হতে পারে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ভার্সেটাইল মিডিয়া ও প্রযোজক আরশাদ আদনানের লগ্নিও। কেননা, ছবিটির শেষাংশে গল্পকার প্রয়াত ফারুক হোসেন চমৎকার সমাপ্তি টেনেছেন, যা দেখার পর দর্শক উদাস হয়েছেন, দর্শকের মন খারাপ হয়েছে আবার দর্শক স্বস্তিরও নিঃশ্বাস ফেলেছেন।

মানুষ একে অপর থেকে আলাদা রঙ, বর্ণ, পছন্দ, ভালো আর মন্দে। সেদিক থেকে অভিমতেও পার্থক্য থাকে। তবে একটি জায়গায় সব রুচির দর্শককে এক করেছে বাপ্পী-আঁচল জুটির ‘সুলতানা বিবিয়ানা’ ছবিটি। তা হলো ছবিটি শেষ হওয়ার পর সব দর্শকই হাততালি দিয়েছেন, ছবিটি নিয়ে কথা বলছেন, এর শেষটা কেউ বলছেন দারুণ হয়েছে, কেউ বলছেন আরেকটু এমন হতে পারত, মিল না দেখিয়ে বিচ্ছেদ দেখানো যেত।

এই যে এত সব ভাবনা এটাই দর্শকের হৃদয় থেকে হৃদয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এজন্যই হলে যাচ্ছেন দর্শক আগ্রহভরে, বন্ধু-বান্ধব ও সপরিবারে। ইন্ডাস্ট্রিও স্বপ্ন দেখছে আরও একটি সফল ছবির, যা চলতি বছরের খরাকে ভুলিয়ে দেবে।

আমাদের গল্পে আমাদের সিনেমা

দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকাই ছবিতে দারুণ এক সমালোচিত বিষয় চলচ্চিত্রের নকল গল্প। বিশেষ করে মূলধারার ছবিগুলোতেই এর প্রভাব অনেক বেশি। তামিল, তেলেগু, বলিউড, হলিউড তো বটেই কানাডা, কোরিয়া, চীন, আফ্রিকার চলচ্চিত্রের গল্পও চুরি হচ্ছে দেদারছে বাবুগিরি স্টাইলে। ছবির পোস্টার কিংবা ট্রেলার প্রকাশের পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বরাতে ধরা পড়ছে নকল ছবিগুলো। বিরক্ত হচ্ছেন দর্শক।

শুধু তাই নয়, আয়নাবাজির মতো ছবিরও গল্প নকলের অভিযোগ উঠেছে ফেসবুকে। সেইদিক থেকে দর্শকদের মৌলিক গল্পের ছবি দেখানোর দারুণ আয়োজন বলা যেতে পারে ‘সুলতানা বিবিয়ানা’। গেল শুক্রবার (৩১ মার্চ) সারাদেশের ৫১টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে সিনেমাটি। ছবিটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান তাই ‘আমাদের গল্পে আমাদের সিনেমা’ স্লোগান নিয়ে হাজির হয়েছে। ছবিটি দেখার পর মনে হলো এই স্লোগান স্বস্তা পাবলিসিটি বা প্রতারণার আড়ালে কোনো প্রচার নয়।

প্রয়াত গল্পকার ফারুক হোসেন গল্প ভাবনার প্রতি হৃদয় নত করতেই হয়। বাঙালির জীবনবোধ, চাষাবাদ, গ্রামগঞ্জ, পাড়া প্রতিবেশীর সম্পর্ক, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি, গ্রামীণ অর্ধশিক্ষিত মানুষের পাপবোধ, গ্রামীণ যুবক-যুবতীর প্রাণ দোলানো প্রেম- সব আছে এখানে। এগুলো খুবই চেনা বিষয় দর্শকের কাছে। কিন্তু ‘সুলতানা বিবিয়ানা’তে ফারুক হোসেন সবকিছুকেই এঁকেছেন ভিন্নতায়, নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মানসে। যতক্ষণ ছবিটি দেখা হয়, চোখ আটকে থাকে পর্দায়। মৌলিক গল্পের মজাটা তো এখানেই।

তাই নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, আমাদের গল্পে সিনেমাই ‘সুলতানা বিবিয়ানা’। অকালে চলে যাওয়া গল্পকার ফারুক হোসেনকে ছবিটি উৎসর্গ করা হয়েছে। এজন্য ‘সুলতানা বিবিয়ানা’ টিমকে কৃতজ্ঞতা জানাই দর্শক হিসেবে।

সুলতানা বিবিয়ানা

ছবির শুরুতেই দেখা যায় একটি কারাগারে ডাকাতের আক্রমণ। ডাকাত সর্দার অমিত হাসান। তিনি নিজেই পুলিশকে জিম্মি করে কারাগারে প্রবেশ করেন। উদ্দেশ্যটা বোঝা যায়নি। কেবল অনুমান করা গেল, কারও বা কোনো আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতেই নিজেকে কারাগারে ঢুকিয়ে নিরাপদ করলেন তিনি। কারাগারে প্রবেশ করে ডাকাত সর্দারের পরিচয় হয় সুলতান নামের বাপ্পী চৌধুরীর সঙ্গে। ভদ্র নিষ্পাপ চেহারা দেখে ডাকাত সর্দারের মায়া হয়। সে জানতে চায় কোন অপরাধে সুলতানের এ করুণ পরিণতি।

সুলতান বলতে থাকে, প্রেমের দায় মাথায় নিয়েই কারাগারে বন্দি সে। ফ্ল্যাশব্যাকে দেখা যায় সবুজে ঘেরা চমৎকার এক গ্রাম। যেখানে সবাই ফুলের চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই এলাকার কাজী বাড়িতে ফুল চাষের কাজ নেয় বাপ মরা যুবক সুলতান। যার মা দ্বিতীয় বিয়ে করে সন্তানকে ফেলে রেখে গেছে।

নতুন স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় সুলতানের নতুন জীবন। কাজী বাড়ির কেয়ারটেকার মজার মানুষ শহীদুজ্জামান সেলিমের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠে সুলতান চরিত্রের বাপ্পীর। কিন্তু ভাগ্য যার বরাবরই সংগ্রামের তার জীবন শান্তিরে স্রোতে ভাসবে কেন। সুলতানের সঙ্গে দেখা হয় উত্তর পাড়ার মেয়ে সোনালীর সঙ্গে। মেয়েটির রুপ, সৌন্দর্যে মজে যায় সুলতান। সে মনে মনে নিজের বিবি ভাবে। সোনালীরও মনে ধরে দুষ্টু-মিষ্টি স্বভাবের যুবকটিকে।

ধীরে ধীরে দুটি মন যখন এক হতে যাবে তখনই নেমে আসে হঠাৎ ঝড়। সেই ঝড়ে ভেসে যায় তাদের বিশ্বাস ও টান। বিনাদোষে কারাবরণ হয় সুলতানের। তবে বাকবদলের জীবনে সুলতানের ভাগ্যেও বদল আসে। সোনালীই ছুটিয়ে নিয়ে যায় সুলতানকে। এ যাত্রায় যেন সম্পর্কটা আরও গাঢ় হলো। কিন্তু নানা কূটচাল, গ্রামীন জীবনের কঠিন স্রোতে ভেসে যায় সবকিছু। সুলতান নিক্ষেপ হয় করুণ পরিণতির অন্ধকূপে। সেখানেই সে বৃষ্টি নামায় ভালোবাসার, ভেসে যায় মিলনের অমিয়ধারাতে।

তার বুকে অমরত্ব খুঁজে নেয় প্রাণের মানুষ সোনালী। প্রেমের এই নিটোল গল্প সত্যি মনকে ছুঁয়ে যাবে। আর মনে দাগ কেটে থাকবে সুলতান-সোনালীর প্রেম। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, বাপ্পী চৌধুরী তার ক্যারিয়ারের সেরা তিনটি ছবির কথা যখন বলবেন অনায়াসেই উঠে আসবে ‘সুলতানা বিবিয়ানা’র নাম। একই কথা বলা চলে চিত্রনায়িকা আঁচলের নামেও। এই জুটি অনেকবারই পর্দায় হাজির হয়েছেন। তবে চরিত্র আর গল্পের অভাবে তাদের রসায়নটিকে ভালোভাবে এতদিন উপভোগ করতে পারেননি দর্শক। তারা চাইলেই নিকটস্থ প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে মজে যেতে পারে বাপ্পী-আঁচলের প্রেমে। ছবিটিতে দুজনকে দেখতে দারুণ লেগেছে। গ্রামীন সাধারণ সাজ-পোশাকেও আবেদনময়ী লেগেছে আঁচলকে। দুজনেই দুর্দান্ত অভিনয় দিয়ে পাল্লা দিয়েছেন একে অপরের সঙ্গে।

এটাই মুগ্ধ করে যায়। নায়ক-নায়িকার পরই উল্লেখ করতে হয় শহীদুজ্জামান সেলিমের নাম। মমতা, স্নেহ, অভিভাবকসুলভ বড় ভাই তিনি বাপ্পীর। কিন্তু গৎবাঁধা চলচ্চিত্রের অতিমানবীয় কিছু নন। তারও দোষ আছে, মন্দ আছে। চরিত্রটিকে দেখতে দেখতে দর্শক নিজের চারপাশের অনেকের সঙ্গেই মিলিয়ে নিতে পারবেন। তিনি হাসিয়েছেন, তিনি ভাবিয়েছেন, তিনি কাঁদিয়েছেনও। তাই শক্তিমান এই অভিনেতার চরিত্রটিকে বেশ আপন মনে হবে। মনে দাগ কেটেছে ভিলেন চরিত্রে অমিত হাসানের উপস্থিতি। তার মুখে কথায় কথায় ‘বিউটিফুল’ সংলাপটি এরই মধ্যে আলোচনায় এসেছে। আর ছবিটিতে দারুণ একটি চরিত্র ধারণ করেছেন বর্ষীয়ান অভিনেতা মামুনুর রশীদ। ছবিজুড়েই তার চরিত্রে রহস্য। পাঠক বা দর্শকদের জন্য সেই রহস্যের জট এখানে খোলিনি। কেবল বলছি, সিনেমার ক্লাইমেক্স নিয়ে হাজির হয়ে মুগ্ধ করবেন মামুনুর রশীদ।

ভালো লেগেছে ছবির গানগুলো। কবির বকুলের লেখা হাবিব ও ন্যান্সির কণ্ঠে ‘তুমি আমার’ গানটি এরই মধ্যে সারা দেশের শ্রোতাদের মন জয় করেছে। কক্সবাজারের মনোরম লোকেশনে গানটির চিত্রায়নে বাপ্পী-আঁচল নতুন করে মুগ্ধ করে যাবেন। ভালো লাগবে জাহিদ আকবরের কথায় আকাশ সেনের গাওয়া বৈঠকি মেজাজের ‘আল্লাহ আল্লাহ আল্লাহু/ প্রেমের কী জাদু’ শিরোনামের গানটিও।

প্রশংসা করতেই হয় ছবিটির সিনেমাটোগ্রাফির চমৎকার সব লোকেশন তুলে ধরার জন্য। ছবিটিজুড়েই ছিল ফুলের ঘ্রাণ, সবুজের কলতান। কালারফুল একটি রঙিন ক্যানভাস যেন ‘সুলতানা বিবিয়ানা’।

অভিনন্দন পরিচালক হিমেল আশরাফ। ছোট পর্দার নির্মাতারা চলচ্চিত্র নির্মাণে আসলে কাকরাইল পাড়ায় তাদের বলা হয় মিডিয়া ডিরেক্টর। একটু ভিন্ন চোখে দেখা হয় তাদের ছবি বানাতে পারেন না বলে। ছবি বানাতে গিয়ে শেষমেষ তারা নাটকই বানান। সেদিক থেকে এই অভিযোগ শত্রুও করবে না হিমেল আশরাফের নামে। ‘আমাদের গল্পে আমাদের সিনেমা’ স্লোগানে সত্যিই চলচ্চিত্র বানিয়েছেন তিনি।

আর বাপ্পী-আঁচলের জন্য বলব, ‘সকল সুলতানের প্রেমের নৌকা ভিড়ুক সোনালী নামের ঘাটে। হৃদয়ে হৃদয়ে ছড়িয়ে যাক এই প্রেমের গান।’

জয় হোক বাংলা ছবির

গেল কয়েক বছর ধরেই ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা করুণ। হুট করে কিছু ছবি ব্যবসা করে গেলেও নিয়মিত থাকা যাচ্ছে না বক্স অফিসে। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছর ব্যবসাসফল ছবি খুঁজতে গেলে কষ্টই হবে। তবে এ কথা বলা যায়, প্রথম দুদিনের যা হালচিত্র ‘সুলতানা বিবিয়ানা’ হাঁটছে ব্যবসায়িক সাফল্যের পথেই। জমকালো বা চোখ ধাঁধানো প্রচারণা না থাকা সত্ত্বেও ছবিটি দেখতে হলে যাচ্ছে মানুষ। নিজে দেখে অন্যকে পরিবারসহ দেখায় উৎসাহিত করছেন।

বিশেষ করে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো ছবিটির জন্য প্রচুর নারী দর্শক হলে যাচ্ছেন। ইতিহাস বলে, নারী দর্শক হলে ফিরলে ছবির ব্যবসা ভাগ্য প্রসন্ন হয়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, প্রসন্ন হবে মন্দার বাজারে আশা জাগানিয়া ‘সুলতানা বিবিয়ানা’। যে আশা থেমে গেছে ‘আয়নবাজি’র পর সেই আশা নিয়মিত হবে ঢাকাই ছবিতে। ইন্ডাস্ট্রিতে সাফল্যের সোনালি দিন ফিরুক ভার্সেটাইল মিডিয়ার ‘সুলতানা বিবিয়ানা’র হাত ধরে।

এলএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।