‘দেশীয় চলচ্চিত্রে ক্যামেরাম্যানদের মূল্যায়ন কম’


প্রকাশিত: ১২:০৩ পিএম, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭
ছবি : মাহবুব আলম

মাহফুজুর রহমান খান। বাবা-মা চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা নিয়ে ছেলে মস্ত বড় চাকরি করবে, স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তা হবে। কিন্তু ভালোবাসার খেয়ালে তিনি বেছে নিলেন ক্যামেরা। হয়ে উঠলেন কালের কিংবদন্তি। চার দশকেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতায় তিনি এখন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার। বাংলা চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত সব সিনেমাটোগ্রাফি উপহার দিয়েছেন তিনি। কাজ করেছেন আজহারুল ইসলাম খানের ‘সহযাত্রী’, আখতারুজামানের ‘পোকা মাকড়ের ঘর বসতি’, কোহিনূর আক্তার সুচন্দার ‘হাজার বছর ধরে’, গোলাম রব্বানী বিপ্লবের ‘বৃত্তের বাইরে’, হুমায়ূন আহমদের ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘আমার আছে জল’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’সহ অসংখ্য প্রশংসিত চলচ্চিত্রে। ঘরে তুলেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা চিত্রগ্রাহক হিসেবে নয়টি স্বীকৃতি! একজন নায়ক, পরিচালক, প্রযোজক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন তিনি। সম্প্রতি শীতের এক সন্ধ্যায় কথা হলো ঢাকাই ছবির অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের সাক্ষী এই মানুষটির সঙ্গে। নিজের কাজ, অভিজ্ঞতাসহ তিনি কথা বলেছেন বর্তমান চলচ্চিত্রের সামগ্রিক অবস্থান নিয়ে। লিমন আহমেদের লেখায় ছবি তুলেছেন জাগো নিউজের নিজস্ব আলোকচিত্রী মাহবুব আলম

জাগোনিউজ : কেমন আছেন আজকাল?
মা. র. খান : এইতো বাবা বেঁচে আছি, সবার প্রার্থনা আর ভালোবাসায়। চমৎকার এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা দারুণ আনন্দের বিষয়। উপভোগ করছি।

জাগোনিউজ : নতুন কোনো কাজ করছেন?
মা. র. খান : যতোদিন বেঁচে থাকবো ক্যামেরার পেছনে কাজ করে যেতে চাই। এক জীবনে ক্যামেরার মতো অতো বেশি ভালো আর কাউকে বাসতে পারিনি। এই ক্যামেরার জন্য যৌবনেও পাগলামি ছিল, এখনো আছে। একজন চিত্রগ্রাহক হওয়ার যে নেশা ধরে বসেছিল আজও তা একরকম। প্রতিনিয়তই শিখছি অনেক নতুন কিছু। আর এটা কাজ করতে গিয়েই সম্ভব হচ্ছে। চলচ্চিত্রের অবস্থা আগের মতো নেই। ছবিও কম। বেকারত্ব বাড়ছে। সেখানে আমার মতো প্রবীণ লোকের নিয়মিত কাজ করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তবু তোমাদের দোয়ায় কাজ করছি। নতুন করে ড. জাফর ইকবালের গল্পে বরেণ্য নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম নির্মাণ করছেন ‘আঁখি ও তার বন্ধুরা’। এ ছবিটির সিনেমাটোগ্রাফার আমিই। আপাতত এ ছবিটাই আমার ধ্যান-জ্ঞান।

জাগোনিউজ : চলচ্চিত্রে বেকারত্বের কথা বলছিলেন। আপনি তো মুক্তিযুদ্ধের পর চারটি দশক দেখেছেন ফিল্মে। এমন মন্দা অবস্থা আর কখনো ছিল?
মা. র. খান : না। কখনোই এতোটা ভয়ংকর সময় কাটাইনি আমরা। ছবি আগেও ফ্লপ হয়েছে। একজন নায়ক বা নায়িকা ফ্লপ হয়েছেন তো অন্য কেউ এসে হিট করিয়ে ইন্ডাস্ট্রি চাঙা করেছেন। কিন্তু এখন তো কেউই সেটা পারছেন না। যাদের নাম্বার ওয়ান বা এই সেই বলা হচ্ছে কেউই কিন্তু বাজার ঘুরাতে পারছেন না। হুটহাট কিছু চমক আসছে। কিন্তু বাজার নিয়মিত হচ্ছে না। আগেও অনেক প্রতিকূলতা ছিল। কিন্তু তার ভিড়েও ভালো গল্প নিয়ে ছবি হতো। দর্শকের রুচি ও পছন্দকে প্রাধান্য দেয়া হতো। এখন সেটি নেই। যারা এই চর্চাটা করছেন তাদের কোণঠাসা করা হচ্ছে সুশীল বলে, মূলধারার বাইরের মানুষ বলে। কিন্তু আগে কোনো ধারা-টারা ছিল না। চলচ্চিত্র ছিল কেবল দর্শকের। কেন জানি মনে হয়, এ যুগে জন্মালে জহির রায়হানও সুবিধা করতে পারতেন না। যাই হোক, আগে চলচ্চিত্রের কোনো মন্দাভাব আসলে সবাই মিলে চেষ্টা করতেন নতুন কী করা যায়? কীভাবে দর্শককে হলে আনা যায়। সেই একতাবদ্ধ চেষ্টাটাও কমে গেছে। নতুনত্ব কমেছে। তাই দিনে দিনে প্রযোজক কমছে, চলচ্চিত্র কমছে, হল কমছে, বাণিজ্য কমছে। পেশাদারিত্বেও হুমকি আসছে। তবে আশার কথা হলো সাম্প্রতিক সময়ে চলচ্চিত্রে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। অনেকেই মৌলিক গল্প নিয়ে আসছেন। নির্মাণেও মুন্সিয়ানা দেখা যাচ্ছে। তরুণরা আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছেন। এটা আশাব্যঞ্জক। চলচ্চিত্র অনেক বড় একটি শিল্প। এটি হুট করে ধ্বংস হয়ে যায় না। আমি অপেক্ষায়, এখানে সুদিন ফিরবেই। অলরেডি সুবাতাস বইছে।

জাগোনিউজ : নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে আপনার দারুণ এক বন্ধুত্বের গল্প শোনা যায়। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
মা. র. খান : এ আমার পরম সৌভাগ্য যে রাজ্জাক সাহেবের মতো গুণী মানুষ আমাকে বন্ধু ভাবেন, আমাকে পছন্দ করেন। আড্ডা-আলোচনায় তিনি আমার কথা বলেন। রাজ্জাক সাহেব ইন্ডাস্ট্রির মুরুব্বি। সত্যিকারের সুপারস্টার তিনি। তার সঙ্গে সখ্যতা অনেকদিনের। তার ছবি দিয়েই আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিনি পরিচালকদের বলতেন আমি ক্যামেরার পেছনে না থাকলে অভিনয় করবেন না। এটা আমার জন্য দারুণ বিষয়। আসলে বলা যায়, রাজ্জাক সাহেবই আমাকে তৈরি করেছেন, নানাভাবে। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে তিনি আমাকে সূর্যের মতো আলো দিয়েছেন। আমার মধ্যে যদি দুইটা ভালো গুণ থাকে তবে সেটা রাজ্জাক সাহেবের কাছ থেকে পাওয়া। একটা সময় আমরা সবাই তটস্থ থাকতাম উনাকে ঘিরে। ভাবতাম এটা করা যাবে না, এটা বলা যাবে না তবে রাজ্জাক সাহেব রাগ করবেন। তারপর নায়ক আলমগীরও আমার খুব ভালো বন্ধু। চলচ্চিত্রে আসার আগে থেকেই ওর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আমার। দুজন দুই স্কুলে পড়তাম; অনেক কম্পিটিশন হতো। তারপর যখন ফিল্মে এলো ওর প্রথম ছবি ‘আমার জন্মভূমি’র নায়কও আমি, ক্যামেরাম্যানও ছিলাম আমি। আমাদের বন্ধুত্বটা দারুণ। নায়ক ফারুক ছিল ছোটবেলার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে খেলাধুলা করতাম।

জাগোনিউজ : জাফর ইকবালও আপনার বন্ধু ছিলেন বলে জানি। উনার সম্পর্কে কিছু বলবেন?
মা. র. খান : জাফর ইকবালও আমার খুব ছোটবেলার বন্ধু। অনেক স্মৃতি আছে আমাদের। ও ছেলেবেলা থেকেই খুব সুদর্শন আর স্টাইলিস্ট। নানা গুনের প্রতিভা। ভালো গাইতো। খুব ভালো গিটার বাজাতো। অভিনয় করতে এসেও নাম কামিয়ে গেল। বিশ্বাস করো, এখন পর্যন্ত ওর মতো একটা হিরো আর আসেনি। এই উপমহাদেশে জাফর ইকবাল সবার থেকে ব্যতিক্রম। পাকিস্তান, ইন্ডিয়ায়ও এমন রুচিশীল নায়ক দেখা দেয়নি। যারা তাকে দেখেছে, তার সঙ্গে মিশেছে কেবল তারাই অনুধাবন করতে পারবে জাফর ইকবালের ক্যারিশমা। এরকম ক্যারিশমা কিছুটা দেখাতে পেরেছিল সালমান শাহ। ওর সঙ্গেও আমি অনেক কাজ করেছি। এক্সট্রা অর্ডিনারি ছেলে ছিল। আমাকে খুব পছন্দ করতো। আমাদের চলচ্চিত্রের অনেক ক্ষতি হলেও মৃত্যু ব্যক্তি সালমানকে অনেক বেশি নন্দিত করেছে। এরপর রিয়াজ এসেছে এই ধারাবাহিকতা নিয়ে।

জাগোনিউজ : হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গেও আপনার সখ্যতার গল্প শুনি। তার প্রায় সব ছবিতেই আপনি চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ নিজেও নানা জায়গায় আপনার প্রশংসা করে গেছেন-
মা. র. খান : এই মানুষটার কথা মনে হলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। খুব কষ্ট পাই। আমি তার ছয়টা ছবিতে কাজ করেছি। চারটা ছবিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। হুমায়ূন আহমেদকে আমার কাছে মনে হতো- হি ওয়াজ এ সামথিং এক্সট্রা অর্ডিনারিপারসন। এ ধরনের মানুষ খুব বেশিদিন বাঁচেন না। তিনিও চলে গেলেন অবেলায়। তার কাজ করে যে আরাম, যে প্রশান্তি সেটা অন্য কারো সঙ্গে তুলনা করা যায় না। তার স্ক্রিপ্ট হাতে নিলেই বোঝা যেতে কোথায় ক্যামেরা বসাতে হবে, উনি কী ধরনের দৃশ্য চাচ্ছেন। এত বড় মাপের মানুষ, কখনো অহংকার দেখিনি। ক্যামেরা সম্পর্কে তিনিও অনেক কিছু জানতেন। কিন্তু কোনো দিন আমাকে খবরদারি করেননি। গুণের কদর করতে জানতেন তিনি। তার আরেকটি বিশেষ গুণ, খুব ভালো টিম গঠন করতে পারতেন। এজন্য তার কাজগুলো সহজ হয়ে যেত।

জাগোনিউজ : হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আপনার প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে?
মা. র. খান : সেন্টমার্টিনে প্রথম দেখা হয়েছিল। সে প্রায় ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে। উনি সেন্টমার্টিনে ছিলেন। আমিও একটি ছবির শুটিংয়ে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে দেখা হয়। অনেক কথা হয়েছিল। দেখলাম ক্যামেরা ও ফটোগ্রাফি নিয়ে তার রাজ্যের আগ্রহ। তার কিছুদিন পরই মেকআপম্যান দীপক সুর একদিন এসে বললেন হুমায়ূন ভাই আপনাকে উনার বাসায় যেতে বলেছেন। গেলাম। উনি শ্রাবণ মেঘের দিন ছবির গল্প শোনালেন। আমাকে ক্যামেরার দায়িত্ব নিতে বললেন। উনার গল্প শোনলে তো না করার কোনো সুযোগই নেই। আমিও করতে পারিনি। শুরু হলো ‘গ্রেট ম্যান’র সঙ্গে কাজ করা। তারপর অনেক স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে হৃদয়ের অলিন্দে। তিনি আজ নেই। দোয়া করি বেহেশত নসিব হোক তার। এদেশের চলচ্চিত্র তাকে চিরদিন মনে রাখবে।

জাগোনিউজ : আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে একাল-সেকালের নায়িকাদের নিয়ে বলুন-
মা. র. খান : আমাদের এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে নায়ক, সংগীত আর নায়িকা- এই তিনটি বিষয়ের অন্যরকম গুরুত্ব আছে। আমাদের সময়ও নায়িকাদের গ্ল্যামারটাকে প্রাধান্য দেয়া হতো, এখনো তাই। তবে একটা সময় পর্যন্ত সুন্দর মুখের পাশাপাশি নায়িকারা ভালো অভিনয়টাও রপ্ত করতেন। আজকাল অভিনয়ের গুরুত্বটা কমে গেছে। সেজন্যই অনেকে আসছেন কিন্তু টিকছেন না। আর তারকাখ্যাতি হলে দায়িত্ববোধ ভুলে যাওয়াটা উচিত নয়। চলচ্চিত্র একটি বিশাল মাধ্যম। বড় আয়োজনের ব্যাপার। এখানে একদিনের শুটিং নষ্ট হওয়া মানে অনেক টাকা ক্ষতির বিষয়। এসব বিষয় আজকালকার নায়িকারা কমই উপলব্দি করেন বা বোঝেন। তবে অনেকেই আছেন যারা চলচ্চিত্রকে ভালোবাসেন। অনেক চেষ্টা করছেন ইন্ডাস্ট্রিটাকে ভালো একটি অবস্থানে নিয়ে যেতে।

Mahfuz Chacha 2
জাগোনিউজ : চলচ্চিত্রের একাল-সেকালের পরিবর্তন, উন্নয়নগুলো কেমন?

মা. র. খান : সময় তো চলমান। সে বদলে যাবেই। যখন এদেশে চলচ্চিত্রের যাত্রা হলো সেটা অবশ্যই সোনালি সময়। অনেক প্রতিকূলতা ছিল তবু দর্শক ছবি দেখতেন। এখন অনেক কিছুই সহজ হয়েছে কিন্তু দর্শক আর হলে যাচ্ছে না। তার মানে কিন্তু কেউ ছবি দেখছে না এটা বলা যাবে না। দর্শক আছে, তবে মাধ্যম বদলেছে। হলের স্থানে মোবাইল, টেলিভিশন, কম্পিউটার এসেছে। লোকে এখন ঘরে বসে ছবি দেখছে। প্রযোজকদেরও এ মাধ্যমে আয় করার ব্যবস্থা করতে হবে। আচরণেও কিছু পরিবর্তন এসেছে। আগে সবার সঙ্গে সবার হৃদ্যতা ছিল। প্রতিযোগিতা ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন সম্পর্কের ফিতেটা ঢিলে মনে হয় প্রায় ক্ষেত্রেই। আর সবাই দ্রুত তারকা হতে চায়। সবাই নিজেকে লাইম লাইটে আনতে চায়। প্রচার মাধ্যমও সহজ হয়ে গেছে। আগে একজন পরিচালককে দর্শক চিনতেন না। এখন একজন পরিচালকও তারকা বনে যাচ্ছেন। এর ভালো ও মন্দ দুই দিকই রয়েছে। ভালোটাকে গ্রহণ করতে পারলেই হয়।

জাগোনিউজ : আপনি মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই এদেশের ফিল্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। একাত্তরে এফডিসি ও ঢাকাই চলচ্চিত্রের অবস্থা কেমন ছিলো?
মা. র. খান : খুবই ভয়াবহ। পাকিস্তানিরা চাচ্ছিলো এখানকার সব যন্ত্রপাতি নিয়ে যাবে। আমরা দেইনি। কৌশলে বাঁচিয়েছি। বিপদে ছিলেন হিন্দু শিল্পরা। অনেকেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন। দিলীপ বিশ্বাসের পরিবার, সুমিতা দেবী, সত্য সাহারা আমার বাসায় ছিলেন অনেকদিন। মোহাম্মদপুরে আমার সঙ্গে থাকতন তারা। এখান থেকে পরে ইন্ডিয়া চলে যান। অনেকেই তখন প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছিলেন এফডিসিকে। সবারই উদ্দেশ্য ছিলো এই শিল্পটাকে ধ্বংস হতে না দেয়া। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন সরাসরি। অনেক পরিচালক, নায়ক ও কলাকুশলীরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। দেশ স্বাধীন হলে পরে সেইসব যোদ্ধারা আবার চলচ্চিত্রের হাল ধরেছেন। এই অঙ্গনটি অনেক ত্যাগ, শ্রম আর ভালোবাসার বিনিময়ে এতদূর এসেছে!

জাগোনিউজ : এবার আপনার শুরুর গল্প শুনবো। এতকিছু থাকতে ক্যামেরারম্যান হতে ইচ্ছে করলো কেন? আর সেটাও ফিল্মে?
মা. র. খান :  আমার বাবার একটা বক্স ক্যামেরা ছিলো। তিনি আলীগড়ে পড়াশোনা করেছিলেন। সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলেন। সেটা তিনি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। ওই ক্যামেরাই আমাকে এই নেশা ধরিয়ে দিয়েছিলো ছেলেবেলায়। স্কুলে বন্ধুদের নিয়ে ছবি তুলতাম। সবাইকে দেখাতাম আমার ক্যামেরা আছে। তখন এই জিনিস খুব একটা ছিলো না। তাই বন্ধুদের কাছে আমার একটা আলাদা কদর ছিলো। এই বিষয়টা আমি খুব উপভোগ করতাম। একটা সময় কলেজ শেষ করে দেখলাম সব বন্ধুরা ইংল্যান্ড আমেরিকা যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ওরা সবাই জুট টেক্সটাইল পড়তে যাচ্ছে। তখন এই জুট টেক্সটাইল বেশ জনপ্রিয় বিষয়। কারণ আমাদের দেশে পাট শিল্পের তখন রমরমা অবস্থা। আমার পরিবারও ভাবছিলো। কিন্তু আমি চাইছিলাম ফটোগ্রাফি বা ক্যামেরা নিয়ে পড়তে যাবো। কিন্তু বাবাকে বিষয়টা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো আমি আর দশজনের মতো ভারী কোনো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে বড় চাকরি করবো। তাই একটু ইতস্তত করছিলাম। একদিন চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত মানুষ এহতেশাম মুস্তাফিজ আমাদের বাসায় এলেন। তিনি ছিলেন আমার ফুফাতো ভাই। তাকে জানালাম বিদেশ যাবো ফটোগ্রাফি পড়তে। উনি যেন বাবাকে বলে দেন। উনি বেশ খুশি হলেন। আমাকে পরামর্শ দিলেন এসব বিষয় নিয়ে দেশের বাইরে পড়তে যাবার আগে একটু হাতে কলমে শিখে যাওয়া ভালো। আমাকে একদিন ছবির শুটিং দেখাতে নিয়ে গেলন। ছবিটি ছিলো নায়ক রাজ্জাকের। সেখানে মুস্তাফিজ সাহেব আমাকে ক্যামেরাম্যান আব্দুল লতিফ বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করালেন। তার সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করতে বললেন। উনিই আমার গুরু। এভাবে জড়িত হওয়া। তারপর যখন দেশ স্বাধীন হলো মূল ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করা করে দিলাম। আর বিদেশ যাওয়া হয়নি। দিনে দিনে নেশাই পেশাই হয়ে উঠলো। চিত্রগ্রাহক হিসেবে আমার প্রথম ছবি ছিলো আবুল বাশার চুন্নুর ‘কাঁচের স্বর্গ’। এটি ১৯৭২ সালে মুক্তি পেয়েছিল।

জাগোনিউজ : দেশের বাইরে কোনো কাজ করেছেন কখনো?
মা. র. খান : আমি বেশ কয়েকবারই দেশের বাইরে কাজ করেছি। উড়িষ্যার ছবিতে কাজ করেছি, তামিলে অ্যাড করেছি, থাইল্যান্ডেও কাজ করেছি। আর শুটিং করতে বহুবার দেশের বাইরে গিয়েছি। এগুলোও বর্ণিল অভিজ্ঞতা।

জাগোনিউজ : আপনি তো বেশ কিছু ছবিতে নায়ক হিসেবেও কাজ করেছেন...
মা. র. খান : হ্যাঁ। ৭২ সালের দিকের ঘটনা। হঠাৎ একদিন আজমল হুদা মিঠু ভাই বললেন. মাহফুজ তোমাকে নায়ক হতে হবে। ছবির নাম ‘জল্লাদের দরবার’। জার্মান ফেরত এক যুবকের গল্প। আমি বললাম এটা কী করে সম্ভব। আমি অভিনয় জানি না। উনি ভারী কণ্ঠে বললেন, ‘ইউ হেভ টু’। আমি আর কথা বাড়াইনি। বেশ কয়েক সপ্তাহ জার্মান ভাষা শিখলাম। কিন্তু ছবিটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। এরপর আলমগীর কুমকুম সাহেব একদিন একই প্রস্তাব দিলেন। রাজি হলাম। তার ‘আমার জন্মভূমি’ ছবিতে মিনু রহমানের বিপরীতে নায়ক হলাম। ওই ছবির ক্যামেরাম্যানও ছিলাম আমি। এরপর ববিতার সঙ্গে দিলীপ বিশ্বাসের ‘দাবি’, শাবানার সঙ্গে মুস্তাফিজুর রহমানের ‘আলো ছায়া’, কবরীর সঙ্গে প্রফেসর নুরুল ইসলামের ‘চলো ঘর বাঁধি’ চলচ্চিত্রে কাজ করেছি।

জাগোনিউজ : এতো বড় বড় পরিচালক, নায়িকাদের নায়ক হয়েও নিয়মিত হতে ইচ্ছে করেনি?
মা. র. খান : আসলে বাবা, আমি নায়ক হয়েছি অনুরোধ রাখতে গিয়ে। অভিনয় করতে গিয়ে মনে হলো এটা আমার কাজ না। আমি পারবো না। অভিনয় খুব কঠিন কাজ। তাই ওইদিকে আর পা রাখিনি। নিজেকে ক্যামেরাম্যান হিসেবেই দেখতে চেয়েছি, এখানেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। এই প্রতিষ্ঠার পেছনে আকবর কবির পিন্টু, আবুল বাশার চুন্নু, বাবুল চৌধুরী, কামাল আহমদ, শিবলী সাদিক, আজহারুল ইসলামের কাছে কৃতজ্ঞ আমি।

জাগোনিউজ : আপনি প্রযোজক হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন। আগে থেকেই কী প্রযোজনার পরিকল্পনা ছিল?
মাহফুজুর রহমান খান : না, তা ছিল না। আমারা কজন ভালো বন্ধু মিলে প্রযোজনার কাজ শুরু করেছিলাম। আমাদের প্রযোজনায় চারটি সিনেমা নির্মিত হয়েছিল। এখন আপাতত কোন সিনেমা প্রযোজনা করছি না।

জাগোনিউজ : আপনার পেশাটিতে যারা নতুন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন.....
মা. র. খান : বিশ্বজুড়েই এই পেশাটি অনেক প্রশংসিত এবং মূল্যায়িত। সেই তুলনায় আমাদের দেশে কম। বিশেষ করে চলচ্চিত্রে ক্যামেরাম্যানদের খুব একটা মূল্যায়ণ দেখা যায় না। ক্যামেরাম্যানরাও নিজেদের ঋদ্ধ না করেই কাজ করতে আসছেন। তবে অনেকের কাজ আমি দেখেছি। চমৎকার। মুগ্ধ হয়েছি। ধীরে ধীরে আমরা উন্নতির পথে যাচ্ছি। অনেক লম্বা একটা সময় খারাপ অবস্থা পার করেছি আমরা। পরিবর্তনের সময় দিতে হবে। যারা ক্যামেরা নিয়ে কাজ করছে বা করতে আগ্রহী তাদের বলবো, ফটোগ্রাফিটা ভালো করে রপ্ত করতে হবে। হৃদয় দিয়ে উপলব্দি করতে হবে। ‘ফটোগ্রাফি ইজ এ পেইন্ট অব লাইট’। লাইটের সঙ্গে ক্যামেরার দারুণ সম্পর্ক। আর মন থেকে চাইলে মানুষ সবকিছুই পারে। কেউ যদি নিজেকে এই পেশায় নিবেদিত করতে চায় তার সুফল সে পাবেই।

জাগোনিউজ : আপনার ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে জানতে চাই....
মা. র. খান : আমি ঢাকার লোকাল ছেলে। জন্ম চকবাজারে, ১৯৪৯ সাল। আমার বাবা ইরতেজা হোসেন, মা রওশন আরা বেগম। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। আমার স্ত্রী শিবরা। ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে বার্মিংহাম থেকে বিশেষ শিক্ষার উপর পিএইচডি করেছিল। ২০০১ সালে মারা গেছে। এরপর থেকে ব্যক্তিগতভাবে আমি একা। তবে এই চলচ্চিত্র, এখানকার মানুষেরা আমার আপনজন। এখানে আমার অনেক সন্তান। অনেকেই আমাকে বাবা বলে ডাকে। আমিও তাদের সন্তানের মতো ভালোবাসি।

এলএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।