দুর্বল প্রদর্শনী ব্যবস্থায় বিতর্কে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব


প্রকাশিত: ০৯:০১ এএম, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭

রাজধানীতে ‘পঞ্চদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’ শুরু হয়েছে গেল ১২ জানুয়ারি থেকে। চলবে ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত। ‘নান্দনিক চলচ্চিত্র, মননশীল দর্শক, আলোকিত সমাজ’ স্লোগানে নয়দিনের এ উৎসবের আয়োজক রেইনবো ফিল্ম সোসাইটি।

জাতীয় জাদুঘর, সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তন, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, আমেরিকান সেন্টার মিলনায়তন ও স্টার সিনেপ্লেক্সের পাঁচটি ভেন্যুতে চলবে এ উৎসব।

অংশ নেবে বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, আফগানিস্তান, ইরান, জার্মানি, শ্রীলঙ্কা, কাতার, ফ্রান্স, মঙ্গোলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, গ্রিস, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেক্সিকো, চীন, নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, কিউবা, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, ইরাক, আফগানিস্তান, নরওয়ে, সৌদি আরব, তুরস্ক, মিশর, থাইল্যান্ড, পোল্যান্ডসহ ৬৭টি দেশ। কথা ছিলো এই দেশগুলোর মোট ১৮৮টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হবে এই উৎসবে। তবে সেখান থেকে কমে গেল একটি ছবি।

গতকাল শুক্রবার ১৩ জানুয়ারি ‘মাটির প্রজার দেশে’ নামে বাংলাদেশি একটি ছবির প্রদর্শনীর ছিলো। কিন্তু দুর্বল প্রজেকশন ব্যবস্থায় হতাশ হয়ে উৎসব বর্জন করেছেন ছবিটির প্রযোজক-পরিচালক।

‘মাটির প্রজার দেশে’র প্রযোজক আরিফ রহমান বলেন, ‘এক টুকরো কাপড়কে পর্দা আর দুর্বল লুমিনেসেন্ট এর প্রজেক্টরের কারণে ঝাপসা ছবি এবং বাজে সাউন্ড সিস্টেম দিয়ে উৎসবে এখানে ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। একটি আন্তর্জাতিক মানের উৎসবে এমন দুর্বল আয়োজন হতাশাজনক।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার ছবিটির ষাট ভাগ শুট করা হয়েছে রাতের বেলায়। যেখানে কূপি, মশাল ছাড়া আর কোনো বাড়তি লাইট ব্যবহার করা হয়নি। শক্তিশালী প্রজেকশন ব্যবস্থা ছাড়া এই ছবির প্রদর্শনী হলে দর্শক খুবই বিরক্ত হবেন। শুধু তাই নয়, দশ ফিটেরও কম পর্দায় ছবি দেখানো হবে শুনে আমি এবং আমার পরিচালক ইমতিয়াজ আহমেদ বিজন আহত হয়েছি। এর চেয়ে বড় পর্দার টেলিভিশন তো আজকাল মানুষের ঘরেই থাকে। তারউপর ওই পর্দাটাও পরিষ্কার নয়। এর মাঝ বরাবর ভাঁজের দাগ যা ছবির প্রদর্শনীর সময় চোখে লাগে। এতবড় উৎসবে কী করে এমন বেহাল দশা মেনে নেয়া যায়!’

এদিকে দুর্বল প্রদর্শনীর বিষয়ে ‘পঞ্চদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’র পরিচালক আহমেদ মুজতবা জামালের বরাত দিয়ে উৎসবের মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর রুহুল আমিন খান বলেন, ‘একজন পরিচালক বা প্রযোজক চাইলে নিজের ছবি উৎসব থেকে সরিয়ে নিতে পারেন। এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু এ জন্য অন্যের উপর অভিযোগ আনা ঠিক নয়। উৎসবে ৬৭টি দেশের ১৮৮টি ছবি দেখানো হচ্ছে। বেশ কয়েকটি ভেন্যুতে ছবিগুলোর প্রদর্শনী হচ্ছে। কোথাও কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কিন্তু উনারা এই অভিযোগ করছেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘লন্ডন বা আমেরিকার চলচ্চিত্র উৎসবের সঙ্গে আমাদের উৎসবের মিল খুঁজতে যাওয়া ঠিক নয়। প্রযুক্তির দিক থেকে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে। তবে দিনে দিনে অনেক উন্নতি হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে নিশ্চয়ই আরো অনেক আধুনিকতা আসবে, অনেক আপগ্রেড প্রযুক্তি থাকবে। এইসব সীমাবদ্ধতাগুলোও সবার বোঝা উচিত। তাছাড়া যে পর্দায় ‘মাটির প্রজার দেশে’ ছবিটি দেখানোর কথা ছিলো সেই পর্দায় তারেক মাসুদ, আব্বাস কিয়ারোস্তামির মতো পরিচালকদের ছবি দেখানো হয়েছে। দর্শকরাও বেশ উপভোগ করেছেন। তবে ওই ছবিটির ক্ষেত্রে কী এমন সমস্যা হতো!’

Dhaka

এ প্রসঙ্গে ‘মাটির প্রজার দেশে’ ছবির প্রযোজক আরিফ রহমান বলেন, ‘এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। আমি তো নিশ্চিত করে বলতে পারি, তারেক মাসুদ এবং আব্বাস কিয়ারোস্তামিরা এই পর্দা ও প্রজেকশন দেখলে নিজেদের ছবি প্রদর্শন করতে দিতেন না। কেউই চায় প্রদর্শনী ব্যবস্থার দুর্বলতায় না কষ্টে বানানো ছবিটি দেখার পর কেউ মন্দ বলুক। এখানে যে ধরনের প্রজেকশন রয়েছে তাতে হাই রেজুল্যেশনের ভিডিওগুলো স্পষ্ট হয় না। সবুজ ঘাসকে হলুদ দেখায়। এটা দর্শকের জন্য বিরক্তিকর।’

উৎসবে থাকা প্রজেক্টর ছাড়া বিকল্প কোনো ব্যবস্থা ছিলো কি না জানতে চাইলে আরিফ রহমান বলেন, ‘আমি যখন এই প্রজেক্টরে আপত্তি জানাই তখন কর্তৃপক্ষ আমাকেই প্রজেক্টর ম্যানেজ করতে বলেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমরা সেটি ম্যানেজও করি। সেইসঙ্গে বড় পর্দাও। কিন্তু গতকাল সকালে যখন জাদুঘরে প্রবেশ করতে যাই তখন আমাদের বাঁধা দেয়া হয়। বলা হয় বিকেল ৩টার আগে কারো প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু ৩টার সময় ছবিরই প্রদর্শনী। আমাদের তার আগেই হলে প্রবেশ করতে হবে। কমপক্ষে দুই ঘণ্টা সময় না পেলে নতুন প্রজেক্টর, পর্দা সেট করা সম্ভব না। কিন্তু আমরা অনেক চেষ্টা করেও আয়োজকদের সহায়তা পাইনি। বাধ্য হয়েই বর্জন করতে হয়েছে। এটা খুবই দু:খজনক যে, নিজ দেশের ভেতরে অনুষ্ঠিত হওয়া উৎসবগুলোতে পরিচালক ও তাদের ছবিগুলোকে এভাবে অপমান করা হচ্ছে। দেশের বাইরের অনেকেও এই আয়োজন হতাশা প্রকাশ করেছে। এভাবে উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়া লাভের চেয়ে আমাদের জন্য অনেক বেশি লজ্জার।’

তবে এই বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন উৎসবের মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর রুহুল আমিন খান। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো অভিযোগ পাইনি। সবাই আনন্দেই সময় কাটাচ্ছেন উৎসবে। আর একটি বড় উৎসব থেকে একটি ছবির সরে দাঁড়ানোটা তেমন প্রভাব ফেলে না। দেশ-বিদেশের নির্মাতারা উৎসবে তাদের সেরা ছবিগুলো নিয়ে এসেছেন। সেগুলোর প্রদর্শনী হচ্ছে। দর্শকও আসছেন প্রচুর। আমরা সামনের দিকে চোখ রাখতে চাই।’

এদিকে এই ঘটনা নিয়ে উৎসবের সমালোচনা করেছেন জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। তিনি নিজের ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘পাড়ার মোড়ের প্রজেকশন সিস্টেম, ফকিরি হালতের আয়োজন, লোকাল ফিল্ম কমিউনিটি এবং অডিয়েন্সের সাথে কোনো রকম কার্যকর সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়া, প্রোগ্রামিং ভিশনের কোনো স্পষ্ট উপস্থিতি না থাকা, এই রকম এক শত অভিযোগ করা যাবে আমাদের ফিল্ম ফেস্টিভাল নিয়ে। কালকে (শুক্রবার-১৩ জানুয়ারি) বিজনের ছবি নিয়ে যেটা হলো সেটা চূড়ান্ত রকম অবহেলা। ফেস্টিভাল কর্তৃপক্ষ বাজে প্রজেকশনের অভিযোগের জবাবে প্রজেকশন ঠিক না করে যেভাবে ‘দেখালে দেখান, না দেখালে খোদা হাফেজ’ অ্যাটিটিউড দেখিয়েছে এটা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। ফিল্ম মেকারের প্রতি অশ্রদ্ধা, দর্শকের প্রতি অবজ্ঞা, এবং ফেস্টিভালের স্পিরিট বিরোধী।’

যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে ‘সিয়াটল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’- এ সেরা ছবির সম্মান অর্জন করে বিজনের ‌‘মাটির প্রজার দেশে’।

এলএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।