মীরাক্কেল আমাকে দিন বদলের গান শুনিয়েছে : আরমান


প্রকাশিত: ০১:০৫ পিএম, ২৭ নভেম্বর ২০১৬
ছবি : মাহবুব আলম

ভারতীয় টিভি চ্যানেল জি বাংলায় জনপ্রিয় কমেডি শো ‘মীরাক্কেল আক্কেল চ্যালেঞ্জার-৯’র গ্র্যান্ড ফিনালেতে ছিলেন বাংলাদেশের তিন প্রতিযোগী। তাদের অন্যতম একজন কমর উদ্দিন আরমান। তিনি বাংলাদেশের প্রতিযোগী সাইদুর রহমান পাভেলের সঙ্গে যৌথভাবে দ্বিতীয় রানারআপ হয়েছেন।

এই সাফল্যের পর অখ্যাত আরমান হয়ে উঠেছেন বিখ্যাত। সারা দেশের মানুষ তাকে এখন চেনে, জানে। শুধু তাই নয়, জনপ্রিয়তার ঢেউ লেগেছে ওপার বাংলার দর্শকদের কাছেও। আর হবেই বা না কেন! মীরাক্কেল হচ্ছে  বাংলার ভাষার অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। সারা বিশ্বের বাংলার ভাষার দর্শক অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। এমন একটি প্লাটফর্ম থেকে উঠে আসা সেরা প্রতিযোগীরা তো সবার প্রিয় হবেনই। আরমানও সুযোগটা পেয়ে উতরে গেলেন। কৌতুকে প্রাণবন্ত উপস্থাপনা দিয়ে জয় করে নিয়েছেন দর্শক ও অনুষ্ঠানের বিচারকদের মান। তারই ফল দ্বিতীয় রানার আপের মুকুট।  

সব অর্জন সঙ্গে নিয়ে যখন ফিরে আসলেন, পা রাখলেন নিজের প্রিয় আঙিনায়; অবাক হয়ে দেখলেন অনেক কিছুই বদলে গেছে। অবশ্য এমনটি হবারই কথা। আগে তিনি ছিলেন কক্সবাজারের চকোরিয়ার আরমান, এখন সারা বাংলাদেশের। সাধারণ আরমান নিজের এলাকার মানুষের কাছে অনেকটাই অসাধারণ হয়ে গেছেন। সবাই নিজে থেকে এগিয়ে আসছেন। কথা বলছেন। অভিনন্দিত করছেন। বুকে টেনে নিচ্ছেন। এই ভালোবাসার আবেগ দৃশ্যে নিজের অজান্তেই চোখ মুছেছেন আরমান। কে ভাবতে পেরেছিলো, হুট করে নেয়া একটি সিদ্ধান্ত এভাবে বদলে দেবে চারপাশ! কৌতুক তিনি বলতে ভালোবাসেন। তবে মীরাক্কেলের মতো আসর থেকে পুরস্কার আর স্বীকৃতি নিয়ে আসবেন তা ভাবেননি কখনো।

তবে আরমান চেষ্টা করেন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতেই। তিনি বলেন, ‘মীরাক্কেল আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। তবে নিজের পরিবার ও বন্ধুদের কাছে আমি এখনো সেই আরমানই আছি।’ মজা করে বললেন, ‘একটু বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয় বাইরে গেলে। আগের মতো ঘুরতে পারি না। লোকজন ভিড় করে, গল্প করে। সেলফি তুলতে চায়। আর আগে বাসে করে যাতায়াত করতাম। এখন লোকাস বাসে চড়লে উৎসুক মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাই। তাই বাধ্য হয়ে সিএনজিতে যাতায়াত করি। জনপ্রিয়তার পাশাপাশি মীরাক্কেল আমার যাপিত জীবনকে ব্যায়বহুল করে দিয়েছে। এটিই আমাকে দিন বদলের গান শুনিয়েছে।’

ARMAN

আরমান জানালেন, সম্প্রতি তিনি যুক্ত হতে যাচ্ছেন দেশের বৃহত্তম শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল’র সঙ্গে। এখানে তিনি নতুন কিছু কাজ করতে যাচ্ছেন।

আরমান বর্তমানে ব্যস্ত থাকছেন নানা অনুষ্ঠানে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নিমন্ত্রণ আসে আর হাসির পসরা সাজিয়ে ছুটে যান আরমান। তার মতে, ‘এই যান্ত্রিক ব্যস্তময় জীবনে মানুষ দিন দিন রোবট হয়ে যাচ্ছে। তাদের মুখে হাসি ফুটানোর মতো কঠিন আর কিছু হতে পারে না। সারাক্ষণ নিজের কৌতুকের লিস্ট বড় করার চেষ্টা করি। তবে সব পরিশ্রমের কষ্ট ভুলে যাই যখন মানুষকে প্রাণ খুলে হাসতে দেখি।’

আরমান জানান, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কৌতুক পরিবেশনার পাশাপাশি টিভি চ্যানেলেও তিনি হাজির হচ্ছেন আজকাল আর বিশেষভাবে তিনি উপস্থাপনা করছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) চট্টগ্রাম থেকে প্রচার হওয়া অংশে ‘আনন্দক্ষণ’ নামে একটি অনুষ্ঠান। এর গ্রন্থনা ও পরিকল্পনাও করেছেন তিনি। শিগগিরই হয়তো টিভি-রেডিও’র আরো বেশ কিছু অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন। তবে প্রায় সময়ই দেখা যায় মীরাক্কেল থেকে আসা প্রতিযোগীরা নাটক-টেলিছবিতে ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে একটু ভিন্ন আরমান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বর্তমান সময়ের বেশিরভাগ নাটকই মানহীন। জোর করে মানুষকে হাসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে সেগুলোতে। সৃষ্টিশীল কিছু পাওয়া যায় না। তাই নাটক বা টেলিফিল্মে কাজের আগ্রহ নেই। কৌতুক নিয়ে নানা অনুষ্ঠানেই ব্যস্ত থাকতে চাই। আর যদি সুযোগ হয় তবে চলচ্চিত্রে অভিনয় করবো।’

আরমান জানালেন একটি নতুন খবরও। চলতি মাসেই ইপিএস বাংলা কমিউনিটির নিমন্ত্রণে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় যাচ্ছেন। সেখানে ইপিএস অ্যাওয়ার্ড ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পারফর্ম করবেন। সেখানে তার সঙ্গে আরো থাকবেন পূজা, ইমরান ও লুইপা।

মীরাক্কেলে আরমানের অনেক স্মৃতি। বেশিরভাগই আনন্দের। সকল প্রতিযোগী, মেন্টরদের সঙ্গে দারুণ সময় কেটেছে দীর্ঘ সাড়ে সাত মাসে। অনেক কিছু নতুন দেখেছেন, অনেক কিছু শিখেছেনও। তিন বিচারক পরাণ বন্ধ্যোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র এবং রজতাভ দত্তকে নিয়েও তার মনে আজীবন থাকবে সোনায় মোড়ানো। আরমান বলেন, ‘তিন বিচারকের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে নানাভাবে সাহস দিয়েছেন, প্রেরণা যুগিয়েছেন। তবে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি পরাণ স্যারের কাছে। তিনি আমাকে অভিভাবকের মতো আদর করেছেন, শাসন করেছেন। হেরে গেলে তিনিই বুকে টেনে নিয়ে বলতেন- তুই আরো ভালো পারফর্মার। ঘাটতিগুলো দূর কর। পরেরবার ঠিকই আমি পেরে যেতাম। তিনি আমাকে কৌতুকের পাশাপাশি মীরাক্কেলের মঞ্চে গানের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত করিয়েছেন। আমার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তিনি আমাকে ওয়াদা করিয়েছিলেন আমি যেন প্রতি পারফর্মেন্স শেষেই একটা করে গান করি। সেই অনুযায়ী আমার নাম হয়ে গেল ওয়াদাকুমার। এই বিষয়টা খুব অনুভব করতাম। আর রনি দা (রজতাভ দত্ত) ছিলেন সেই বিচারক যিনি আমাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ণ করতেন। উনি যা বলতেন আমরা মন দিয়ে শোনতাম। আর শ্রীলেখা ম্যাডামও অনেক কিছু শিখিয়েছেন।’

মীরাক্কেলের উপস্থাপক মীর আফসার আলী (মীর) কে বলা হয় অনুষ্ঠানটির প্রাণ ভ্রোমরা। তিনি মাতিয়ে রাখেন এই কমেডি শোকে প্রাণবন্ত উপস্থাপনায়। আরমানও বিশ্বাস করেন এই মানুষটির মেধা ও যোগ্যতা অনেক অনেক বেশি। একটি শোকে তিনি ইচ্ছে করলেই মাতিয়ে দিতে পারেন। যখন কৌতুকের অভাব দেখা দেয় প্রতিযোগীদের তখন মীর নিজেই বাজিমাত করে দেন। আরমানের মতে, ‘মীর ভাইয়ের সান্নিধ্য পাওয়াটা সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। এছাড়াও অনুষ্ঠানে অন্য মেন্টররাও আমাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন।’

ARMAN

তবে মন্দের একটি স্মৃতি মনে পড়ে প্রায় সময়ই আরমানের। তিনি বলেন, ‘অনেক সময়ই দেখা যেত এক রাতে তিনটি পর্বের পারফর্মেন্স থাকতো। কষ্ট হলেও না করার কোনো উপায় নেই। তেমনি এক রাতে নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম। হঠাৎ খবর এলো আমার এক কাজিন মারা গেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তাকে দেখার জন্য ফিরে যেতে হবে দেশে। আর তখন ফেরত আসা মানে মীরাক্কেল থেকে বাদ যাওয়া। দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এক ক্যামেরাম্যান ভাই এসে তখন বলে উঠলেন, আর্টিস্টদের অনেক কিছু ছাড় দিতে হয়। বাবা মায়ের মৃত্যুর খবরও চাপা দিয়ে আর্টিস্টরা নিজের কাজে মত্ত থাকেন। তার কথায় অনুপ্রাণীত হয়ে পারফর্ম করলাম মন খারাপ নিয়ে। মজার ব্যাপার হলো সে রাতের তিন পারফর্মের দুটিতেই আমি চেক জিতেছিলাম। এই স্মৃতি যেমন আনন্দের তেমনি বেদনার।’

কমর উদ্দিন আরমান কক্সবাজার চকোরিয়ার সন্তান। তার বাবা আশরাফ উদ্দিন ছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্য। মা খায়রুননেছা গৃহিনী হয়ে সামলেছেন পরিবার। ছয় বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট আরমান। আদর-আহ্লাদে বড় হওয়া এই ছেলেটি পড়াশোনাতে শৈশব থেকেই ছিলেন বেশ ভালো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রথমদিকে আরমান নামে মাত্র সম্মানীর বিনিময়ে লায়ন মুখলেছুর রহমান ফাউন্ডেশনের হয়ে ঠোঁট কাটা শিশুদের অপারেশনে যুক্ত ছিলেন। মীরাক্কেল থেকে ফিরে এসেও তিনি এই পেশার সঙ্গেই রয়েছেন। তবে সেটি বিনামূল্যে।

আরমান, মীরাক্কেল মাতিয়ে আসা আরমান। যার চমৎকার কৌতুক উপস্থাপনার পাশাপাশি সুমধুর গলায় গানে মুগ্ধ হয়ে প্রতি পরিবেশনায় একটি করে গান করার জন্য ওয়াদা করিয়েছিলেন করেছিলেন কলকাতার কিংবদিন্ত অভিনেতা পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই থেকে আরমানের নামও হয়ে গিয়েছিলো ওয়াদাকুমার।

এলএ/এনই/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।