চলমান বিতর্ক ও দীপ্ত টেলিভিশনের ভূমিকা


প্রকাশিত: ০৮:১৯ এএম, ১৪ নভেম্বর ২০১৬

বিতর্ক চলছে। টেলিভিশনে বিদেশি সিরিয়াল আর দেশি নাটক নিয়ে। বিশেষ করে দীপ্ত টেলিভিশনের সুলতান সুলেমান। যেন এই সিরিয়ালটি বন্ধ করলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যদিও অপরাপর বিষয়গুলো আছে, তবে সেগুলো ঠিক সামনে আসছে কম।

শিল্প সাহিত্যে বিতর্ক সব সময়ই হয়ে আসছে। যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করলে সবার জন্য ভালো। নাট্যকার, পরিচালকসহ গণমাধ্যমের অন্যান্য কর্মীদের খেয়াল রাখতে হবে, সুবিধাবাদীরা যেনো এখান থেকে সুবিধা না নেয়। আমি মনে করি সরাসরি আলোচানার মাধ্যমে এর সমাধান হতে পারে।

বির্তককারীদের কারো কারো জানা বোঝার বিষয়টি খুব একটা পরিস্কার না। এখনো আদর্শিক জায়গা থেকে কোন মুভমেন্ট লক্ষ করিনি। বিচ্ছিন্ন আর ব্যক্তি আক্রোশ থেকে বিক্ষিপ্তভাবে কথা হচ্ছে। যে কোন টিভির অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা সমালোচনা থাকতে পারে; যারা সমালোচনা করছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমি কিছু কথা বলবো।
 
এই কথাগুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত। আমার নিজস্ব বোঝাপড়া থেকে বলছি, কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে না। যা চলমান বিষয়ের সাথে খুবই সম্পর্কযুক্ত।

১. টেলিভিশন নাটকের চলমান বাজার ব্যবস্থাপনা:
টেলিভিশনের ইন হাউজ নাটক নেই বললেই চলে। চ্যানেল আই নিজেদের মতো করে কিছু নাটকের ডিজাইন করে দেয়, যা নিজেদের হলেও ভয়ংকর। কারণ বাজেট কম, তাই মানও খুব খারাপ। তারপরও তারা করছে। বাকী টেলিভিশনগুলো নাটক নেয় বিভিন্ন এজেন্সির কাছ থেকে। যেখানে তাদের করার কিছু থাকে না আর এজেন্সিগুলো এই সুযোগে বেশি লাভের আশায় নিম্নমানের নাটক বানানোর প্রতিযোগিতায় নামে। দশর্করা একই ধরনের কাজ দেখতে দেখতে খুবই বিরক্ত। যার ফলে দশর্কশূন্য হয়ে পড়েছে আমার টেলিভিশন। এখন এই সংকটকালে ভারতীয় নাটক জোয়ারের মতো ঢুকে গেছে প্রতিটি ড্রইংরুমে।

এবার প্রশ্ন রাখা যায়, দেশীয় বাজারের কত পারসেন্ট বাইরের দেশের টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন যায়? সঠিক তথ্য আমার জানা নেই, তবে বোঝা যায়-বেশ বড় একটা অংশ বাইরের টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনে খরচ হয়। এভাবে চলতে থাকলে বেশি দিন লাগবে না, বাকী অংশটুকু যেতে।

২. নাটকের কারিগরি মান:
এই সময়ে বাঙলাদেশের নাটকের কারগরি মান খুব একটা ভালো না। অল্প কিছু নাটক ছাড়া বাকি সব কাজ খুবই নিম্নমানের। বেশিরভাগ নাটকে পরিচ্ছন্ন গল্প পাওয়া যায় না। যা খুশি তাই বলাটা যে নাটকের সংলাপ হতে পারে, তা আমাদের নাটক দেখলে পরিস্কার বোঝা যায়। এক দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যের গাঁথুনি খুবই দুর্বল। লাইট ঠিক থাকে না, কম্পোজিশন শব্দটার সাথে অনেকের আবার পরিচয় নেই, একটিং কন্টিনিউটি খুব খারাপ, চরিত্র হয়ে ওঠে না। বোঝা যায়, অভিনয় শিল্পীরা যে যার চরিত্রে অভিনয় করছে। জাহিদ হাসান, জাহিদ হাসানের মতো, আর মোশারফ করিম- মোশারফ করিমের মতো। এখানে পরিচালক আছে কি নেই, বোঝা যায় না।

নাটকের মিউজিক যে যার মতো করে ব্যবহার করছে। আমি গত ঈদের নাটক দেখেছি। যেখানে দুই চ্যানেলর দুই নাটকে একই মিউজিক। আবার একটা নাটকের প্রিভিউতে ছিলাম, সেখানে ভিন্ন ভিন্ন তিনটা দৃশ্যে টানা ১২ মিনিট একই মিউজিক দিয়েছে। দর্শকের এতো ঠেকা পড়ে নাই যে, এই অখাদ্য-কুখাদ্য বিষয় গ্রহণ করবে।

৩. দর্শকপ্রিয়তা:
আমাদের অন্যতম সমস্যা হলো, দর্শক কি চায়, তা না বুঝে নিজের খেয়াল খুশিমত নাটক চালানো। বিষয়টা এমন হতে পারে, সকালের নাস্তা দুপুরে, বিকালের খাবার রাতে, আর দুপুরের এবং রাতের খাবার যেহেতু বাকী, তা ঠিক ঘুমের আগে আগে দিয়ে বলে- সব খাবেন কিন্তু। দশর্কদের পছন্দের প্রতি সম্মান না দেখিয়ে যা খুশি তাই প্রচার করলে সংকটে পড়তে হবে, এবং সংকটে পড়েছে। দর্শকের পছন্দ অপছন্দ বুঝতে হবে, কোন সময়ের দর্শক কি দেখতে চায়, কারা দেখতে চায়, কোন বয়সিরা দেখতে চায়, সে সম্পর্কে সঠিক ধারনা থাকতে হবে।

৪. ধারাবাহিক নাটক বনাম মেগা সিরিয়াল:
দশর্ক হয়তো বুঝলেও চলবে, তবে নির্মাতা এবং প্রযোজনা সংস্থা কেনো বুঝবে না যে ধারাবাহিক নাটক আর মেগা সিরিয়াল এক বিষয় না। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত সিরিয়াল নির্মিত হয়নি। গুলশান এভিনিউ ও এশিয়ান টিভি একটু আধটু চেষ্টা চালিয়েছিল, তবে মেগা সিরিয়াল হয়ে ওঠেনি।

একমাত্র দীপ্ত টেলিভিশনই মেগা সিরিয়াল নির্মাণ করেছে, এবং আজ সফল। তাহলে বলতে পারে কেউ কেউ সবইতো নাটক- পার্থক্য কোথায়? আমি বলছি, পার্থক্য আছে বিশাল। গল্প বলায়, কনটেন্টে, নির্মাণে, ও প্রচারে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, কাব্য আর মহাকাব্যে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমন পার্থক্য সিরিয়াল আর মেগা সিরিয়ালে। আকারে বড় হলেই মহাকাব্য হয় না। স্বার্থক মহাকাব্য হতে হলে কতগুলো বৈশিষ্ট্য প্রয়োজন, তেমন শত শত পর্ব হলেই মেগা সিরিয়াল হয় না। মেগা সিরিয়ালের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে-যারা সমালোচনা করছে, তারা একটু মনযোগী হলেই হলেই ধরতে পরতো। আর এটা শুধু ভারতকে অনুসরণ না, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জাপান সবখানে ওভার ড্রামাটিক করেই সোপ অপেরা হয়। অন্য সময় এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।

Monon

৫. টেলিভিশনে নাটক প্রচারের নীতিমালা:
মূল সমস্যা হলো প্রচার কাঠামোতে। নাটক বা সিরিয়াল প্রচারের কাঠামো ঠিক নেই কোনো টেলিভিশনের (দীপ্ত টিভি ছাড়া)। নাটক প্রচার করার সময়ের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই, সময় মেইনটেইন করে না। প্রেজেন্টেশনের কোনো বৈচিত্র নেই, কোনো নিয়মনীতি মানে না। বিজ্ঞাপন প্রচারের কোনো আগামাথা নেই। যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ বিজ্ঞাপন চালায়। দর্শকের দেখার ভালো লাগবে কি না, সে বিষয়ে কোনো পাত্তা না দিয়ে নিজেদের মুনাফার জন্য চালাকি করে। ব্যপারটা হয়েছে এমন, টেলিভিশন দর্শকদের পাত্তা দেয় না, দর্শকও সেই টেলিভিশনকে পাত্তা দেয় না।

৬. বিদেশি ডাবিংকৃত টিভি সিরিয়াল:
বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) প্রথম ডাবিংকৃত টিভি সিরিয়াল আমদানি করে। সেগুলো খুবই জনপ্রিয়তা পায়। যদিও সব সিরিয়াল ডাবিংকৃত ছিল না। আর যেগুলো ডাবিং হয়ে প্রচারিত হয়েছে, সেগুলোর ডাবিং মান খুব একটা ভালো ছিল না। চ্যানেল আই সিনেমা চালিয়েছে ডাবিং করে। মানের কথা না-ই বললাম। মাছরাঙা টেলিভিশনে ‘মটু পাতলু’ চলছে। যেই দীপ্ত টেলিভিশনের ‘সুলতান সুলেমান’ তুমুল জনপ্রিয়তা পেলো, সেই থেকে সব গেলো গেলে গুঞ্জন শুরু হলো, আর এখনতো বির্তকই চলছে। আসলেই কি বিদেশি সিরিয়াল চললে বাঙলাদেশের সিরিয়াল চলবে না? এই কথার সাথে আমি একমত না। কারণ এখনো কয়েকটি টিভি সিরিয়াল বেশ জনপ্রিয়- তার মধ্যে পালকী আর অপরাজিতা উল্লেখযোগ্য। আরটিভি, বাঙলাভিশন, এনটিভি, মাছরাঙার ধারাবাহিক নাটকের দর্শক রয়েছে। তুলনামূলকভাবে তাদের নাটকগুলো ভালো হচ্ছে।

৭. আমাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ:
আমাদের সংস্কৃতি বলতে আমরা আসলে কি বুঝবো? হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি? আসলে সেখানে কি আমরা এখনো আছি? সংস্কৃতি বিষয়টা চলমান একটা ট্রেনের মতো। নানান স্টেশন থেকে যাত্রী ওঠে, আর নামে। রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘দেওয়া নেওয়া’ বলতেন।

তবে মূল্যবোধ বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমাজের মূল্যবোধ, আমাদের আচার, আমাদের সামাজিক অভ্যাস আমাদের মতো। আমরা আমাদের পাশের মানুষকে যেভাবে দেখি, অন্য দেশের মানুষ সেভাবে না ও দেখতে পারে। আমরা যতটা না ‘আমার আমি’, আমরা ঠিক ততটাই ‘আমরা আমাদের’। এই সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধটা আমাদের মগজে গ্রথিত রয়েছে। টিভি সিরিয়ালে যেনো সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়- সেদিকে বুদ্ধিদীপ্তিক নজর রাখতে হবে। আমি মনে করছি না, দীপ্ত টেলিভিশনের কোনো সিরিয়াল সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থি।

৮. ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ও আমাদের করণীয়:
অযোগ্য আর অব্যবস্থাপনায় দিনের দিন চলতে চলতে এক সময় আমাদের টেলিভিশনের নাটকগুলো মুখ থুবরে পড়েছে। দর্শক আগের মতো করে বাঙলা নাটক দেখে না। সেই সুযোগে বাজার ফাঁকা পেয়ে বানের পানির মতো বাঙলার ঘরে ঘরে প্রবেশ করলো ভারতীয় সিরিয়াল। প্রথমে হিন্দি পরে কলকাতার টিভি সিরিয়াল। মানুষ গো-গ্রাসে সে সব খেতে শুরু করলো। সংস্কৃতির দোহায় দিয়ে পার পাওয়া গেলো না। আগ্রাসন চলতেই থাকলো। সুবিধা মতো সময়ে দেশের বিজ্ঞাপন বাইরের চ্যানেলে বুকিং চলে গেলো। কেউ থামাতে পারে নাই।

আমাদের করণীয় ছিল অনেক। মিডিয়ার এক শ্রেণির দালাল আর টেলিভিশনের এক শ্রেণির বিবেকশূন্য কর্মকর্তারা দেশীয় মার্কেট টেনে হেচড়ে নর্দমায় ফেলেছে, আর ব্যক্তিগতভাবে তারা বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছে। আমাদের চোখের সামনে মার্কেটিং প্রধান আর অনুষ্ঠান প্রধানদের রাজকীয় উত্থান দেখেছি। পারভেজ চৌধুরীদের মতো দু’একজন মানুষ ভালো ছিলেন। লোকসানের মুখেও যারা দেশীয় সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। টেলিভিশনে এইসব লোকের খুব প্রয়োজন। পরিতাপের বিষয়, তারা পেছনের সারিতেই থেকেছেন, তাদের সামনে আসতে দেওয়া হয়নি।

৯. সংকট নন্দনে ও মননে:
চ্যানেলগুলোতে কাজ জানা যোগ্য ও দক্ষ লোকের অভাব। বিশেষ করে অনুষ্ঠান বিভাগে এই সংকট প্রকট। আবার যারা সত্যিকারের অর্থে কাজ জানে, তাদের নানাভাবে হয়রানী করা হয়। কারণ কাজ না বুঝা লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। আর তারাই চ্যানেলের কর্তাব্যক্তি।
 
এখন কথা হলো যদি কেউ কাজ না জানে, তাহলে ভালো কিছু আসবে কি ভাবে! চিন্তা করাটা যে একটা কাজ, এই কথাটা টিভি চ্যানেলের কোন কোন কর্তা ব্যক্তি জানে, আমার সন্দেহ আছে। তারা নিজেরা করে চুরি, আবার যখন কোনো চিন্তক পরিচালক বা রাইটার তাদের কাছে কাজের জন্য যায় তখন সেই চোরেরাও সেই ভালো লোকদের চুরির পথ দেখায়। বাতাসের বিপরীতে নৌকা বাওয়া লোকের বড়ই অভাব। দেখা যায়, কয়েকজন গুন টানছে, আর বাকী মানুষ নৌকার ছৈ- এ বসে বাঁশি বাজাচ্ছে বা গপসপ করছে। প্রতিটি চ্যানেলে যেমন গুণ টানা লোকের অভাব আছে, তেমনি, টেলিভিশন নাটক-সিরিয়াল বাঁচানোর মানুষেরও অভাব রয়েছে।

১০. টিভি সিরিয়ালে দীপ্ত টিভির ভূমিকা ও আমাদের করণীয়:
দীপ্ত টিভি’র লক্ষ ছিল, দেশের দর্শক ফিরিয়ে আনা। সে ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছে। ভালো মানের কাজ করলে দর্শক আমাদের দেশীয় অনুষ্ঠান দেখবেই। দীপ্ত টিভি এখানে অগ্রণী ভুমিকা পালন করছে। প্রথমে দরকার বড় প্রজেক্ট করার মনমানসিকতা। তারপর সঠিক ও দূরদর্শী পরিকল্পনা, স্ট্যান্ডার্ড বিনিয়োগ, দক্ষ ও আন্তরিক জনবল, তবেই ভালো কিছু আশা করা যায়। দীপ্ত টিভি এর সবটাই করেছে।

দীপ্ত টিভির চারটি সিরিয়ালে প্রায় তিনশত মানুষ নিশ্চিত কাজ করছে, কোনো চ্যানেল এর আগে কখনো করেনি। এছাড়া টিভি চ্যানেলের নিজস্ব একাধিক ডাবিং স্টুডিও রয়েছে। সেখানে প্রায় অর্ধশত মানুষ কাজ করছে। এই ইন্ড্রাস্ট্রি দিন দিন বড় হবে।

শিল্পচর্চা তো থাকবেই। কিন্তু শিল্পের মাধ্যম ইন্ডাস্ট্রিকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে যেসব প্রজেক্ট তৈরি করা হবে তাকে প্রডাক্ট ভাবতে হবে। ভাবতে হবে ইন্ড্রাস্ট্রি গতিশীল করা এবং বাঁচিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়, পেশাদারী মনোভাব নিয়ে দূরের পথ দেখলে আমাদের টিভি নাটক ও সিরিয়ালে দর্শক আসবে, এটা নিশ্চিত। সেই আশার পথে দীপ্ত টিভি একটি ভালো উদাহরণ হয়ে থাকলো।

লেখক : নাট্যকার ও পরিচালক।

এলএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।