আয়নাবাজির পাইরেসি নিয়ে সমালোচনার ঝড়
চলতি বছর তো বটেই, ২০০৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মনপুরা’ ছবির পর সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্র অমিতাভ রেজার ‘আয়নাবাজি’। ছবিটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি প্রথমে ২১টি হলে মুক্তি পেলেও তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত তুমুল ব্যবসা করায় চতুর্থ সপ্তাহে সারাদেশের প্রায় ৭৪টি হলে মুক্তি পায় ছবিটি। বেশির ভাগ হলেই দেখা গেছে, হাউজফুল শো শেষে দর্শকদের হাসিমুখ। ঢাকার সিনেপ্লেক্সগুলোতে ছবিটির টিকিট নিয়ে হাহাকারও হয়েছে।
নতুন করে চতুর্থ সপ্তাহে যখন ছবিটি দেশব্যাপী হলে মুক্তি পেয়ে দেশীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসে নতুন রেকর্ডের পথে হাঁটছিলো তখন হুট করেই পাইরেসিতে আক্রান্ত হলো ‘আয়নাবাজি’।
গতকাল রোববার (২৩ অক্টোবর) থেকে মিডিয়ার সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এটিই; পাইরেট হয়ে গেছে আয়নাবাজি, অনলাইনে মিলছে ছবিটির ডাউনলোড লিংক। শুধু তাই নয়, ছবিটি ফেসবুকে লাইভেও প্রদর্শনী করা হয়েছে! এই ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছে চলচ্চিত্রাঙ্গনের মানুষসহ দেশের দর্শকও। একটি ছবি যখন ইতিহাস সৃষ্টি করে দর্শকদের হলে টেনে আনছিলো তখন কেমন করে হলো সিনেমার এই প্রাণঘাতি সর্বনাশ! শোনা যাচ্ছে, ছবিটি পাইরেট করার দায়ে ইতোমধ্যে জড়িত দুজন অপরাধীকে আইসিটি ধারা ৬৮, ৬৯ (২) এবং সামাজিক মাধ্যম ধারা ৫৭, আইনের আওতায় আটক করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যদিও তদন্তের স্বার্থে এই দুজনের নাম প্রকাশ করেনি পুলিশ।
তবে এই ছবিটি পাইরেট হবার জন্য সবাই অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন ‘আয়নাবাজির’র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানকেই। কেননা, ৫০ লাখ টাকার লোভে পড়ে ছবিটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কন্টেন্ট ম্যাটারস লিমিটেড ও হাফ স্টপ ডাউন রবি টিভির গ্রাহকের কাছে বিক্রি করল আয়নাবাজির স্পন্সরশিপ। আর এখান থেকেই ছবিটি মাত্র ৩৬ টাকার বিনিময়ে দেখার সুযোগ পেয়েছেন অনলাইন বা মোবাইল দর্শকরা। তারাই ছবিটি পাইরেসি করেছেন।
পাইরেসি করাটা চলচ্চিত্রের জন্য মারাত্মক অপরাধ। এর জন্য কঠিন শাস্তির বিধানও রয়েছে। কিন্তু ঘরের দরজা-জানালা খুলে রেখে চোরকে চুরি করার জন্য উৎসাহ দিয়ে তাকে শাস্তি দেয়াটা হাস্যকর- এই কথাই এখন চলচ্চিত্রপাড়ার মুখে মুখে। পাশাপাশি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কন্টেন্ট ম্যাটারস লিমিটেড ও প্রযোজক গাউসুল আলম শাওন এবং পরিচালক অমিতাভ রেজা সমালোচনার মুখে পড়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। সবাই দাবি করছেন, বিজ্ঞাপন নির্মাণ করতে করতে নিজেদেরকে পেশাদার ব্যবসায়ী ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেন না তারা। নইলে যে ছবিটি দেদারছে সিনেমা হলে ব্যবসা করে চলেছে কেন সেটিকে বিক্রি করে দিলেন অনলাইনে মোবাইলে টিভির কাছে? নগদ এককালীন ৫০ লাখ টাকার লোভই কী এই সিদ্ধান্ত নিতে উস্কে দিয়েছে? যদি তাই হয় তবে যারা এত এত টাকা খরচ করে হলে গিয়ে ছবি দেখলেন তাদের কেন ঠকানো হলো? শাওন বা ছবির পরিচালক অমিতাভ চাইলে শুরুতেই ছবিটি রবি টিভিতে মুক্তি দিতে পারতেন। ৬০ লাখ টাকা বাজেটের ছবি ৫০ লাখ টাকা তো এখানেই পেয়ে যেতো। বাকী ১০ লাখ টাকা সিনেপ্লেক্সগুলোতে খুব সহজেই হয়তো পেয়ে যেতো আয়নাবাজি।
কিন্তু এখন রবি টিভির কাছে ছবিটি বিক্রি করে পাইরেসিকে যেভাবে সহযোগিতা বা উৎসাহ যোগালেন তার দায় কে নেবে? মাত্র ৩৬ টাকা কিংবা ১০ টাকার ইন্টারনেট খরচ করে হাতের কাছে পেলে কে চাইবে লাইনে দাঁড়িয়ে ৩-৪ শত টাকা খরচ করে ছবি দেখতে হলে যেতে! আর এমন একটি সুন্দর ছবি এত সহজে নিজে দেখতে পেলে অন্যদেরকেও দেখানোর জন্য উৎসাহিত হবে সবাই এটাই স্বাভাবিক। কেননা, ভালো যে কোনো কিছু প্রচারের দায়িত্ব মানুষ নিজ তাগিদেই নেয়। ঠিক যেমনটি হয়েছে ‘আয়নাবাজি’র বেলাতে। দর্শক নিজে দেখে এসে অন্যদেরকেও উৎসাহিত করেছেন ছবিটি দেখার জন্য। যার ফলে সিনেমাহলে দেখা গেছে দীর্ঘ লাইন। একইভাবে দর্শক অনলাইনে ছবিটি দেখে ও এটিকে অন্যদের জন্য উন্মুক্ত করে বিভিন্ন সাইটে আপলোড করে দিয়েছেন। সেখান থেকে মুহূর্তের মধ্যেই দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে ‘আয়নাবাজি’র লিংক। আবার নিষিদ্ধ সবকিছুর প্রতিও মানুষের আগ্রহ থাকে অনেক। তাই আয়নাবাজি পাইরেটেড হবার সবটুকু দায় পাইরেটকারীদের উপর দেয়া যায় না। মূল দায়টা বর্তায় ছবিটির কর্তৃপক্ষের উপর। যারা অবিবেচকের মতো টিকিট কেটে দেখা দর্শকদের ভালোবাসার প্রতি সম্মান না দেখিয়ে, সিনেমা হলমালিকদের ব্যবসায়ের মুখে লাথি মেরে এককালীন কিছু টাকার জন্য ছবিটি রবি টিভির কাছে বিক্রি করে দিলেন। সেই দায় কী নেবে না ‘আয়নাবাজি’? কন্টেন্ট ম্যাটারস লিমিটেডের কর্ণধার ও আয়নাবাজির কাহিনীকার-অভিনেতা গাউসুল আলম শাওন আত্মপক্ষই সমর্থন করলেন। তিনি সংবাদ মাধ্যমে বললেন, ‘মোবাইল দর্শদের কথা চিন্তা করে পরীক্ষামূলকভাবে ছবিটি আপ করেছিলাম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অনেকেই সফটওয়্যারের সহায়তায় ফেসবুক-ইউটিউবসহ নানান ওয়েবসাইটে ছবিটি আপ করে দিয়েছে। এর ফলে দ্রুত ছবিটি অনলাইনে ছড়িয়ে গেছে। যেহেতু হলে দর্শক ছবিটি এখনো দেখছে তাই আমরা রবি টিভি থেকে আপাতত নামিয়ে দিয়েছি।’
কিন্তু ছবিটি তো এখন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছেই। এ বিষয়ে শাওন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৩৫টির মতো ওয়েবসাইটে রিপোর্ট করে ছবিটি নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটি অব্যাহত থাকবে।’
এদিকে ছবিটি পাইরেসি হওয়ার পর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন পরিচালক অমিতাভ রেজা। তিনি এই বিষয়টির জন্য অনুতপ্ত- বোঝা গেল তার স্ট্যাটাসের বক্তব্যে। অমিতাভ লিখেছেন, ‘আজ আপনাদের সামনে খুব ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই । আয়নাবাজি আমার আর আমার প্রযোজকের প্রথম সিনেমা। সুতরাং সকল ভুল ত্রুটি সীমাবদ্ধতাসহ আমি গত চার বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে সিনেমাটা বানিয়েছি। যার এক বিন্দু ছাড় দেই নাই কোনো কিছুতে। আমি একা কিছুই করতে পারতাম না। অনেক মানুষের পরিশ্রম এখানে আছে। এই সবকিছু সম্ভব হয়েছে যখন আমার উপর ভরসা করে কেউ লগ্নি করেছে। সিনেমা মুক্তির আগে আয়নাবাজি কেউ স্পনসর করতে এগিয়ে আসে নাই। আমার আপত্তি ছিলো কোনো নিবেদিত আয়নাবাজি হতে দিবো না। মাত্র ২০ হলে আমাদের সিনেমা নিয়েছিল, যা আয়নাবাজির লগ্নি আসার অসম্ভব কিছু। তারপর ভরসা করে আমরা মুক্তি দেই। কোনো প্রিমিয়ার শো ছাড়া সারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য মুক্তি দেয়া হয়েছে। টিকিট কেটে সিনেমা দেখাই ছিল আমের ক্যম্পেইনের উদ্দেশ্য।’
তিনি আরো বলেন, ‘ছবিটির অভিনেতা চঞ্চল ভাইসহ সবাই টিকিট কেটে সিনেমা দেখেছে। আমাদের ডিজিটাল পার্টনার হলো শুধু রবি। রবির কাছে সিনেমার রাইট বেঁচার প্রশ্নই আসে না। শুধুমাত্র রবি টিভিতে অর্থাৎ মোবাইল ডিভাইস ছাড়া এটা আর কোথাও দেখা যাবে না। তাও তিনদিনের জন্য। কেউ সাবস্ক্রাইব করলে আমরা আয়ের একটা ভাগ পাবো। আর কিছু না। শর্ত ছিলো আমাদের কাছেই থাকবে ছবিটির সম্পূর্ণ প্রাইভেসি প্রোটেকশান। যা আমাদের মতো নতুন পরিচালকদের জন্য জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের সাইবার ক্রিমিনালরা অনেক মেধাবী।’
ছবিটি রবি টিভিতে দেয়ার সিদ্ধান্তকে ভুল স্বীকার করে অমিতাভ বলেন, ‘ভুল সিদ্ধান্ত অবশ্যই ছিলো আমাদের, কিন্তু গেল দুই দিন যাবত ‘লোভী’ ‘প্রতারক’ বলে আমাদের মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছেন যখন সবাই তখন খবর পাই যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল চলচ্চিত্র উৎসবে বেস্ট ন্যারেটিভ ফিল্ম’র অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে আয়নাবাজি। এটাই আয়নাবাজি প্রথম পুরস্কার। কিন্তু আমি সেরা পুরস্কারটা পেলোম এ দেশের মানুষের কাছ থেকে যখন ২০ হল থেকে ৭৪টা হলে নিয়েছেন ছবিটি। আমাদের ভুলের কারণে কষ্ট পেলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। যে যতো গুজব ছড়াক আমি বলছি আয়নাবাজির একমাত্র পাওয়া আপনাদের ভালবাসা। সবাই ভাল থাকুন। বাংলা সিনেমা দেখুন।’
সর্বশেষ তিনি বলেন, ‘যদি আবার আপনাদের সহযোগিতা কোনদিন পাই সেইদিন পরবর্তী সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দিবো।’
এলএ/এবিএস